জঙ্গলবাড়ির খোঁজে

islamtimes24

আমিন আশরাফ  ।।  

জঙ্গলবাড়ির পথে…

ছোটবেলা কেটেছে ইতিহাসের বই পড়ে। ইতিহাসের আগ্রহের কারণে বাবা-চাচার বকাও শুনতে হয়েছে। নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে মাথা নুয়ে হাজারো পৃষ্ঠার বই শেষ করে ফেলেছি। বই যত বড় হত আমার তত আনন্দ হতো। মনে মনে তৃপ্তি, বেশ কিছু সময়ের খোরাক হয়ে গেল।

দুই হাজার পাঁচ কি সাতের দিকে মুসলিম জাহানের ঈদসংখ্যায় পেলাম শফীউদ্দীন সরদারের ‘বারো ভূঁইয়ার উপাখ্যান’ নামে ইতিহাসাশ্রয়ী উপন্যাস। ঈদের আমেজ শেষ হওয়ার আগেই ঈদসংখ্যা পড়ে শেষ করে ফেললাম। উপন্যাস পড়ে জানা হলো, মসনদে আলা ঈসা খাঁর দ্বিতীয় রাজধানী আমাদের বাড়ির খুব কাছেই ছিল। কালের জ্বলন্ত সাক্ষী নরসুন্দার পাড় ঘেঁষেই এর অবস্থান। বিষয়টা নিয়ে আমার আগ্রহ ও আফসোসের শেষ রইল না। এত কাছেই ইতিহাসের গৌরবময় ঐতিহ্যের সিংহদ্বার! অথচ আমি জানিই না।

অটো আর সিএনজিওয়ালাদেও হরদম ‘জঙ্গলবাড়ি-জঙ্গলবাড়ি’ শুনতে শুনতে কানে তালা লাগতো। কিন্তু এর আড়ালে হার না-মানা এক মহাবীরের নাম রয়েছে আগে জানতাম না।

রমজানের এক কুয়াশাভেজা ভোরে বের হলাম জঙ্গলবাড়ির উদ্দেশে। সঙ্গী হলো আমার তারাবির ক’জন ক্ষুদে মুসল্লি।

পাড়াগাঁয়ের ছেলে হলেও বড় হয়েছি মফস্বল শহরে। অনেকদিন পর গ্রামের পথে নেমেছি। ছেলেগুলো বললো বেশি দূরে নয়, হাঁটতে হাঁটতেই ঈসা খাঁর রাজ্যে পৌঁছা যাবে। ভোরের তিরতির করে বয়ে চলা বাতাসে বেশ চনমনে হয়ে উঠছিলাম। হাঁটতে অনেক আরাম লাগছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল আনন্দে একটু দৌড়াদৌড়ি করি।

যতই কাছে আসছিলাম আমার সঙ্গে ছেলেগুলোও যেন উৎফুল্ল হয়ে উঠছে। বলছে, এই যে দেখুন! এটা রাজপথ ছিল। এ পথ দিয়ে ঈসা খাঁ ও তাঁর বাহিনী আসা-যাওয়া করত। চেয়ে দেখি পথটা এখন আর রাজপথ নেই। ভাঙা ইট-সুরকিই যেন সাক্ষী দিচ্ছে-তার বুক চিরে ইতিহাসের এক মহানায়ক এককালে ঘোড়া ছুটিয়েছেন। কল্পনায় দেখছিলাম, মসনদে আলা ঈসা খাঁর দুর্গজয় দৃশ্য।

১৫৮৫ সালে মসনদে আলা ঈসা খাঁ বর্তমানে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার জঙ্গলঘেরা এ দুর্গে আক্রমণ করেন। সে সময় এ দুর্গে কোচ রাজা লক্ষ্মন হাজরা ও রাম হাজরা রাজত্ব করতেন। তিনি তাদের পরাজিত করে জঙ্গলবাড়ি দুর্গটি দখল করেন।

ইসলাম টাইমস
বাংলাপিডিয়ায় ব্যবহৃত ঈসা খাঁর ছবি

জঙ্গলবাড়ির একেবারে সিংহদ্বারে যখন পৌঁছলাম মনে হলো সত্যিই আমি কোনো চমৎকার একটি জঙ্গলে পৌঁছে গেছি। যাকে পরিপাটি জঙ্গলরাজ্য বলা চলে। প্রকৃতির সব আয়োজন আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। অপূর্ব ছায়াঢাকা জঙ্গলবাড়ি। ভাবা যায়, এক সময় এই গ্রামটা একজন বীরের রাজ্য ছিলো, যাদের ঘোড়ার খুরধ্বনি প্রতিনিয়ত আলোড়ন তুলত এখানকার গাছ-লতায়। বাতাসে উড়ে বেড়াত ঘোড়ার খুরের ধূলিঝড়! রাস্তার চারপাশে নাম না জানা গাছগুলো আমাদের স্বাগত জানাচ্ছিল। নেপথ্যে যেন ডেকে বলছে, হে তরুণেরা! এসো আমার কাছে। আমিই তোমাদের বলতে পারবো, মসনদে আলা ঈসা খাঁর জানা-অজানা সাচ্চা দাস্তান।

 

পেছন ফিরে দেখা

ঈসা খানের পিতামহ বাইশ রাজপুত সম্প্রদায়ভুক্ত ভগীরথ প্রথমে অযোধ্যা থেকে বাংলায় আসেন এবং বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ-এর অধীনে দেওয়ান হিসেবে চাকরি গ্রহণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র কালিদাস গজদানী পিতার দেওয়ান পদ লাভ করেন। পরবর্তীতে কালিদাস ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সোলায়মান খাঁ নাম ধারণ করেন। সোলায়মান বাংলার সুলতানের কন্যা সৈয়দা মোমেনা খাতুনকে বিয়ে করেন এবং সরাইলের জমিদারি লাভ করেন। এ সরাইলেই সোলায়মানের পুত্র ঈসা খাঁ জন্মগ্রহণ করেন।

সোলায়মান খাঁ পরবর্তীতে একান্ত নিজের চেষ্টায় ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলার উত্তর-পূর্ব অংশ নিয়ে এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাধীন রাজত্ব প্রতিষ্ঠার পর দিল্লির মুঘল সম্রাট আকবরের একাধিক সেনাপতি তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। সোলায়মান খাঁ দুবার ইসলাম শাহ শূরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং ১৫৪৮ সালে মর্মান্তিকভাবে নিহত হন। ঈসা খাঁর বয়স তখন ১৯ (কোনো কোনো ঐতিহাসি বয়স আরও কম বলেছেন) বছর। বাবার মৃত্যুর পর ঈসা খাঁর পিতৃব্য কুতুবউদ্দীনের আশ্রয়ে তিনি লালিত হন।

ইতিহাসের পাতা উল্টালে পাবেন, মুঘল সম্রাট ও ভাসমান বিদেশি বণিকদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে অসহায় বাংলার জমিদাররা গোপনে ঈসা খাঁকে আমন্ত্রণ জানান নতুন এক স্বাধীন বঙ্গদেশ গড়ার। যে বঙ্গদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন তার বাবা সোলায়মান খাঁ। সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন করতে তার হাতে হাত রেখে দিল্লির মুঘল সালতানাতকে তাড়িয়ে দেবার সংকল্প করেন বাংলার জমিদাররা।

বাংলার জমিদারদের এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঈসা খাঁ আফগানিস্তান থেকে চৌদ্দশো অশ্বারোহী, ২১টি নৌবিহার ও প্রচুর গোলাবারুদ আনার ব্যবস্থা করেন। ত্রিপুরা রাজ্যে আশ্রয় নিয়ে সেখান থেকে কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি দূর্গ দখল করে পরবর্তীতে সোনারগাঁও দূর্গও দখল করেন। সোনারগাঁয়ের প্রাচীন নাম ছিল সুবর্ণ গ্রাম।

পরবর্তীতে ঈসা খাঁ ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা চাঁদরায়ের কন্যা এবং কেদার রাজার বোন স্বর্ণময়ীকে বিয়ে করেন। স্বর্ণময়ী পরে ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেন। ঈসা খাঁ তার নাম রাখেন সোনাবিবি বা সোনামনি। সেই নাম অনুসারে বাংলার রাজধানী সোনারগাঁও নামকরণ করা হয়।

ইসলাম টাইমস
সোনারগাঁওয়ে নির্মিত ঈসা খাঁর দুর্গ

ষোড়শ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে মুঘলদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঈসা খাঁর সফল সংগ্রাম তাকে বাংলার প্রধান ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল। তার সাহসী নেতৃত্বে এগিয়ে আসেন বাংলার আরও অনেক জমিদার। ধারণা করা হয়, বারোজন জমিদার বা ভূঁইয়া একত্রিত হন তখন। এ কারণে তাদের বরো ভূঁইয়া নামে ডাকা হয়। এসব জমিদারদের সহযোগী বাহিনী নিয়ে গঠিত হয় সম্মিলিত বাহিনী। ঈসা খাঁর নেতৃত্বে এ বাহিনী দিল্লির বাহিনীকে বার বার পরাভূত করে।  

ঈসা খাঁ সোনারগাঁও ও মহেশ্বরদীর জমিদারিকে সাফল্যের সঙ্গে এক স্বাধীন রাজ্যে পরিণত করেন। এ রাজ্য বৃহত্তর ঢাকার বেশ কিছু অংশ, প্রায় সমগ্র বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা এবং ত্রিপুরা জেলার এক ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে গঠিত হয়। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের খিজিরপুর এবং কিশোরগঞ্জ জেলার জঙ্গলবাড়ি ও এগারসিন্দু ছিল তার দূর্ভেদ্য ঘাঁটি। এই দুর্গ থেকে পরে তিনি একে একে সোনারগাঁওসহ মোট ২২টি পরগণা দখল করেন।

 

যা যা চোখে পড়ল

ঈসা খাঁর দুর্গে ঢুকে দেখি দৃষ্টিনন্দন একটি মসজিদ। মসজিদটিতে রয়েছে মুঘল স্থাপত্যশৈলীর ছাপ। ৪৪ ফুট দীর্ঘ ও ১৮ ফুট প্রস্থ মসজিদের ছাদে রয়েছে তিনটি গম্বুজ। মসজিদের প্রতিটি কোণেই একটি করে চোখ ধাঁধানো মিনার। মসজিদের পুব দিকে রয়েছে ১১ ফুট খোলা বারান্দা। মুসল্লিরা এখানে নিয়মিত নামাজ পড়তে আসেন। মসজিদের পাশেই ঈসা খাঁর বংশধরদের বাঁধানো পাকা কবর। ক্ষুদে মুসল্লিরা বলছে, এখানে কোনো একটা কবর ঈসা খাঁর হয়ে থাকবে। কিন্তু বড় হয়ে জেনেছি, এই পাকা কবরগুলো ঈসা খাঁর আত্মীয়দের। ঈসা খাঁ জঙ্গলবাড়ির কোথাও ঘুমিয়ে নেই। তিনি মারা যাবার আগে বিভিন্ন দুর্গে আসা-যাওয়া করতেন। ১৫৯৯ সালে মহেশ্বরী পরগনার অন্তর্গত বক্তারপুর দুর্গে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৫৯৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর প্রায় ৭০ বছর বয়সে তিনি মারা যান। গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ থানায় বক্তারপুর গাঁয়ে তিনি সমাহিত হয়ে আছেন।

islamtimes24
জঙ্গলবাড়ি দুর্গ সংলগ্ন সংস্কার করা মসজিদ

জঙ্গলবাড়ি দুর্গটি দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ৪০ এক জমির উপর। ঈসা খাঁ সামন্ত রাজার কাছ থেকে দুর্গ কবজা করার পর এটিকে সংস্কার করেন। দুর্গের তিনদিকে পরিখা খনন করে নরসুন্দা নদীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে জঙ্গলবাড়িটিকে একটি ব-দ্বীপের মতো করেছিলেন। 

দুর্গটির জৌলুস এখন আগের মতো নেই। ইতিহাস এখানে ঘুমিয়ে আছে। একটু সামনে এগিয়ে উত্তর-দক্ষিণে লম্বা ইটের পাঁচিল দিয়ে ভাগ করা দুটি চত্বর দেখা যাবে। স্থানীয়দের কাছে পাঁচিলটি ‘প্রাসাদ প্রাচীর’ নামে পরিচিত। দুর্গের দক্ষিণে একটি তোরণ। তোরণটির সামনে ‘করাচি’ নামে একটি পূর্বমূখ একতলা ভবন দাঁড়িয়ে আছে। তোরণের পেছনে ‘অন্দরমহল’ নামে একটি একতলা দক্ষিণমুখী ভবনও আছে। বাড়ির সামনে ঈসা খাঁর সময়ে খনন করা একটি দীঘি। দুর্গের ভেতরের দরবার ঘরটি সংস্কার করে স্থানীয় প্রশাসন ‘ঈসা খাঁ’ স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার স্থাপন করেছে। সেখানে ঈসা খাঁর বিভিন্ন ছবি, তাঁর বংশধরদের তালিকা এবং বিভিন্ন নিদর্শন রয়েছে।

দুর্গ এলাকার বাইরে তাকালে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য ইটের টুকরা ও মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ দেখতে পাওয়া যায়। প্রত্নতত্ত্ব গবেষকরা লিখেছেন, এসব নিদর্শনাবলি মুসলমানরা আসার আগে দুর্গটি নির্মিত হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। তবে দুর্গের ভেতরে বেশ কিছু স্থাপনা রয়েছে ঈসা খাঁর। আছে তাঁর বাসভবনের ধ্বংসাবশেষও। ছাদ ধ্বসে গেলেও দরবার কক্ষের অনেকটাই টিকে আছে। দরবারসংলগ্ন পান্থশালায় এখনো ১০-১২টি কক্ষের অস্তিত্ব রয়েছে।

 

এবার যাবার পালা

ভগ্নপ্রায় প্রাসাদের ভেতরে গেলে লোকজন জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। বললাম, দেখতে এসেছি। হুজুর দেখে চেয়ার এনে বসতে দিল। আলাপে জানতে পারি, সর্বশেষ জঙ্গলবাড়ির এ বাড়িটিতে থাকতেন ঈসা খাঁর ১৪তম বংশধর দেওয়ান ফতেহ আলী দাদ খাঁ। ২০১৩ সালে তিনি মারা যান। বর্তমানে তাঁর ছেলে দেওয়ান মামুন দাদ খাঁ পরিজন নিয়ে কিশোরগঞ্জ শহরের রথখোলা এলাকায় বসবাস করেন। মাঝে মাঝে এসে তারা দুর্গটি দেখে যান। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে দুর্গটি সংস্কারের ব্যাপারে। বলা যায়, খুব তাড়াতাড়িই দুর্গটি সংস্কারের কাজ শুরু হবে।

চোখ ভরে দেখে, মন ভরে কথা বলে ফিরে আসার পথ ধরলাম।

ইসলাম টাইমস
সোনারগাঁওয়ে ঈসা খাঁর হাতে গড়া পানাম নগরী
পূর্ববর্তি সংবাদউত্তর গেটের সিঁড়ি : মুঠো মুঠো স্মৃতির জোনাকি
পরবর্তি সংবাদকেন নিজস্ব মিডিয়া হাউস