কবি ও কবিতা

মুহাম্মাদ তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব ।। 

হিজল বনে পালিয়ে গেছে পাখি / যতোই তারে করুণ সুরে ডাকি

দেয় না সাড়া নীরব গহীন বন / বাতাসে তার মৃদু গুঞ্জরণ

হিজল বনে পালিয়ে গেছে পাখি….

কণ্ঠশিল্পী সাইফুল্লাহ মানসুরের গাওয়া এই গানটি প্রথম শুনেছি আজ থেকে প্রায় এক যুগ আগে। শরহে বেকায়ার বছর। আমার বয়স তখন খুব বেশি হলে সতেরো। সেই বয়সে আমি তখনও হিজল গাছ চিনিনা। একদিন ঢাকার একটি গার্ডেনে গিয়ে কেবল এই গানটির কথা স্মরণ করে হিজল গাছ দেখলাম। হিজল বন। এই বনে একটি পাখি পালিয়ে গেছে। করুণ সুরে সেই পাখিকে ডাকা হচ্ছে। পাখি সাড়া দিচ্ছেনা। গহীন বন। নীরব।

কিন্তু পাখিটি কেন পালিয়ে গেল? তাকে কি বন্দী করে রাখা হয়েছিল? কে বন্দি করে রেখেছিল? কেন বন্দি করে রেখেছিল? এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই আমার কাছে। তবুও বড় আবেগ নিয়ে গানটি গাইতে থাকি। একাকী। আনমনে।

হিজল বনে পালিয়ে গেছে পাখি….

একদিন মনে হলো, বাস্তবে এই পাখিটি কোনো বনের পাখি নয়। তাহলে কি কল্পনার পাখি? ভাবনার প্রতিচিত্র? কী?

কবিতা গানের এই এক বিপদ। নির্দিষ্ট কোনো অর্থ থাকবে না। উদ্দেশ্য থাকবেনা। হয়তো ব্যাখ্যাও থাকবে না কখনো। থাকবে শুধু ভাব, মর্ম, কিংবা দূর দূরান্তের অনুভূতি, দোল দোলা। তবুও কবিতার মোহ! কবিতার প্রতি আমাদের টান! যত্তোসব!!

বর্তমান ভারতের বরেণ্য একজন কবির নাম ড. নাওয়ায দেওবন্দী। বড় সুন্দর কিছু কবিতার জনক তিনি। কবিতা পড়ার স্টাইলও মাশাআল্লাহ সুন্দর, আবেগী, জীবন্ত। তার কয়েকটি ভিডিও রেকর্ড আমার দেখার সুযোগ হয়েছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ভিডিও। তাতে যথেষ্ট রসবোধেরও পরিচয় দিয়েছেন তিনি।

তার একটি কবিতার বই ‘পেহলা আসমান’। সেখানের একটি পঙক্তি এমন—‘গুনগুনাতা জা রাহা থা এক ফকীর/ ধূপ রেহতী হে না ছায়া দের তক।’ (গুনগুনিয়ে যাচ্ছিল এক উদাস ফকীর- (বলছিল সে) রোদ বা ছায়া রয়না কিছুই দীর্ঘসময়!)

বড়ই চমৎকার কথা এবং অতি সুন্দর একটি চিত্র। কিন্তু এই কথা আর এই চিত্রের দ্বারা কবির উদ্দেশ্য কী, সেটা জানার জন্যে গিয়েছিলেন আমার এক উস্তায মাওলানা নূরুল ইসলাম সাহেব দামাত বারাকাতুহুম। ভারতের মতো দেশে, উর্দূ কবিতার মর্ম জানার জন্যে একজন বাঙালি! তা আবার সোজা কবির কাছে! ড. নাওয়ায অবাক না হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তিনি উত্তরে শুধু একটি ঘটনা শোনালেন। মরহুম কবি ইকবালের ঘটনা। ভারতের কোনো এক কবিতা মজলিসে মহাকবি ইকবালের কোনো এক কবিতা প্রসঙ্গে নাকি মজলিসে উপস্থিত ষাটজন কবি ষাট রকমের ব্যাখ্যা প্রদান করেন। ইকবাল তখনো জীবিত। পাকিস্তানে। তাঁর কাছে চিঠি পাঠানো হলো এই কবিতার আসল মর্ম-উদ্দেশ্য জানতে চেয়ে। ইকবাল চিঠির উত্তরে লিখলেন—‘কবিকে তার কবিতার মর্ম-উদ্দেশ্য কখনো বলতে নেই। তাতে কবিতা সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। কবিতা থাকা উচিৎ মুক্ত। যে কেউ যেন নিজের মতো করে সেটাকে ব্যবহার করতে পারে। তা থেকে উপকৃত হতে পারে।’

সে হিসাবে ‘পেহলা আসমান’ বইয়ের ঐ কবিতাটির উদ্দেশ্য বলা হলোনা আমার হুজুরকে। এবং একই কারণে হয়তো আমাকেও কোনোদিন বলা হবেনা এই গানের পাখিটির আসল পরিচয়।

কবি নাওয়াযের প্রসঙ্গ যখন এলোই তার আবৃত্তি করা একটি কবিতা তুলে দিই। কবিতাটি আমার খুবই পছন্দের। একটি অনুষ্ঠানে তিনি এটা আবৃত্তি করেছেন । আমি দেখেছি ভিডিও চিত্রে-

জু সফর ইখতিয়ার কারতে হেঁ

ওহি দরিয়া কো পার কারতে হেঁ

চলকে দেখিয়ে তো মুসাফির কা

রাস্তে ইনতিযার কারতে হেঁ  …

(যে ব্যক্তি পথ চলতে শুরু করে সে-ই তো দরিয়া পাড়ি দেয়। তুমিও চলতে শুরু কর। দেখবে, পথগুলো পথিকের অপেক্ষায়।)

-এসএন

পূর্ববর্তি সংবাদকলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদের মৃত্যু
পরবর্তি সংবাদদিল্লিতে মুসলিম গণহত্যা: এক বছর পরেও তদন্ত অসম্পূর্ণ, মুসলিমরাই বেশি গ্রেফতার