অবেলার বর্ষা

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ ।।  

মেঘলাকাশ৷ গুড়ুম গুড়ুম শব্দে কান ভারী হয়ে উঠছে দিব্যি৷ বর্ষাকালে এমন মুহূর্ত দিনে বার কয়েক আসে। আজ যেন প্রকৃতিতে সেই রঙ নেমে এসেছে৷ আকাশটা বড্ডোরকম গোমরামুখো হয়ে আছে। যেকোনো সময় হুড়মুড়িয়ে নামবে আষাঢ়ে ঢল। শীতের প্রকোপ বাইরে। কম্বল মুড়িয়ে ঘরের ভেতর শুয়ে থাকতে হচ্ছে দিবানিশি। তার ওপর থেমে থেমে বৃষ্টির রিমঝিম তান। কী আজব! হঠাৎ বৃষ্টি চমকে দিচ্ছে পাগলমন৷ প্রশ্ন জাগছে, বৃষ্টিও কি খেয়ালি বালকের মতো উল্টো ধারায় গড়াতে আরম্ভ করলো! মেঘমালা থেকে বৃষ্টিফোঁটা পৃথিবীর বুকে ঝরে— কখনও ঘাসের ওপর, কখনো বা বনাঞ্চলে, কখনও স্রোতধারা নদীতে, কখনও কিশলয়ের সবুজে, কখনো বা গৃহাঞ্চলে৷

আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারিমে বৃষ্টিকে বরকতময় বলেছেন৷ বৃষ্টির গুণাবলি ও নানান উপকারিতা বর্ণনা করেছেন। কোথাও বলেছেন, ‘আমি বৃষ্টির সাহায্যে শুকনো জমিন উর্বর করে তুলি।’ কোথাও বলেছেন, ‘সবুজ শ্যামল শস্য এবং রকমারি ফলফলাদি উৎপাদন করি, অনাবাদ শহরকে আবাদ করি, ইত্যাদি।’ আবার কোথাও বলেছেন, ‘আমি আকাশ থেকে বরকতপূর্ণ জল অবতীর্ণ করেছি। তা দিয়ে বাগান ও খাদ্য শস্য উৎপাদন করেছি।’

বৃষ্টি দেখতে বেশ লাগে। মুষলধারে বৃষ্টিতে গাছপালা তরুলতা পুনরুজ্জীবিত হয়। ধানের শীষগুলো ন্যুয়ে পড়ে। আবার সজীব হয়ে ওঠে। জমিন থেকে সবুজ শ্যামল ঘাস উদ্গত হয়। এরশাদ হচ্ছে, ‘তিনি আকাশ থেকে বিশেষ পরিমাণে জল বর্ষণ করেছেন এবং তার সাহায্যে মৃত ভূমিকে জীবিত করে তুলেছেন। এভাবেই একদিন মাটির ভেতর থেকে তোমাদের বের করে আনা হবে।’ অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তুমি কি দেখো না, আল্লাহতায়ালা আকাশ থেকে জল বর্ষণ করেন৷ ফলে জমিন সবুজ শ্যামল হয়ে ওঠে। মূলত তিনি সুক্ষ্মদর্শী ও সর্বজ্ঞ।’ আরও বলেন, ‘তোমাদের জন্য তিনিই আকাশ থেকে জল বর্ষণ করেন। যা পান করে নিজেরা পরিতৃপ্ত হও এবং যার সাহায্যে তোমাদের গবাদি পশুর জন্য খাদ্যও উৎপন্ন করা হয়। এ জলের সাহায্যে তিনি শস্য উৎপাদন করেন এবং জয়তুন, খেজুর, আঙ্গুর ও বাহারি ফলফলাদি জন্মান। এ নিয়ে যারা চিন্তাভাবনা করে, তাদের জন্য এতে রয়েছে বড়ো নিদর্শন।’ রাসুল (সা.) বরকতময় বৃষ্টির জন্য দোয়া করেছেন৷ অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, রাসুল (সা.) বৃষ্টি দেখলে ‘হে আল্লাহ! আমাদেরকে উপকারী বৃষ্টি দান করুন’ বলে প্রার্থনা করতেন।

বৃষ্টিমুখর কোলাহল

পুকুরজলে বৃষ্টি পড়ায় টুপটুপ শব্দ শোনা যায়। টিনের চাল থেকে বৃষ্টির টাপুর টুপুর শব্দ ভেসে আসে। আনন্দে ছেলেমেয়েরা সারি বেঁধে মিছিল করে। হৈহুল্লোড়ে মাতিয়ে তোলে চারপাশ। উঁচু স্থান থেকে পিচ্ছিল কাটে। কেউ বা আবার খোলা আকাশের নিচে হা করে দাঁড়িয়ে থাকে। বৃষ্টিজল ফোঁটা ফোঁটা গিলতে থাকে। কেউ বা দু-হাত বাড়িয়ে বৃষ্টিজল ছুঁয়ে দেখে৷ কিশোর-কিশোরীর মুখে ধ্বনিত হয়— ‘আয় বৃষ্টি ঝেপে/ ধান দেবো মেপে/ যা বৃষ্টি ঝরে যা/ লেবুর পাতা করমচা।’

বাদলা দিনে ইচ্ছে জাগে খুব খুব করে লিখতে। তবে কেনো যেনো হুটহাট হুমায়ূনের মতো ‘বৃষ্টিবিলাস’ লিখে ফেলতে পারি না কিংবা সৈয়দ আলী আহসানের মতো ‘যখন বৃষ্টি নামলো’ দিয়ে ‘জীবনের শিলান্যাস’ আঁকতে চাই না৷ তবে সবার মতো নিজেও বৃষ্টির মাঝে খুঁজে ফিরি ‘জীবনের ছন্দকাব্য’। বসে বসে আঁকি প্রিয়জনের চিত্রছবি। যে মনের আল্পনা নীল শাড়ি পরে উঠোনে দাঁড়িয়ে৷ পূর্ণিমার চাঁদের ওপর দৃষ্টি পড়ছে। লজ্জায় বারবার বৃষ্টি থেমে যাচ্ছে। গাছপালা খুশিতে হেলছে-দুলছে। চেঁচামেচি করে বেহালাসুরে কাকগুলি কী যেনো গাইছে। সেই নীল শাড়ি বেয়ে বৃষ্টিজল চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে৷ মুগ্ধ চোখে রূপসী বাংলা দেখা হচ্ছে। কী যে অপরূপ লাগছে! নিজেকে আর ধরে রাখা যায় না। মনমহুয়া ছটফট করে।

বৃষ্টি দেখে ছেলেবেলার স্মৃতি খুব করে চোখের তারায় ভাসে। বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে ফুটবল খেলতাম। পাড়ার সবাই মিলে নদীতে ঝাঁপ দিতাম। মা রাগ করে বলতেন, ‘ঠাণ্ডা লাগলে এক আনার ওষুধও কিনে দেবো না কিন্তু! ঘরে যেনো একটু কাশির শব্দও না শুনি!’ নদীতে থেকে থেকে শৈলডুবি খেলতাম। শরীরে বৃষ্টিফোঁটা পড়লে মনে হতো কে যেনো কামড়ে দিচ্ছে৷ দুষ্টুমি করে যাকে বলতাম, ‘চিমটি মাছ কামড় দিয়েছে।’ জলে ডুব দিয়ে হারিয়ে যেতাম কোথাও। সহজে মাথা তুলতাম না। অবশ্য ক্ষণিকের জন্য মাথা তুলে নিশ্বাস নিতাম। কেউ না দেখার আগে আবার দিতাম ডুব। এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে যেতো। মা লাঠি নিয়ে নদীর পারে হাজির হতেন। ঘাড় ধরে পিটিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসতেন। কতো কান্না করতাম। তবু নদী থেকে আসতে মন চাইতো না। পেছনে ফিরে ফিরে তাকাতাম৷ আজও হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয় সেই বৃষ্টির জলধারায়। কিন্তু শীতের অদৃশ্য প্রাচির বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। মনের বাসনা তাই মনের মাঝেই লুকিয়ে থেকে গুমরে গুমরে কাঁদায়৷ #

পূর্ববর্তি সংবাদওমরাহ পালনকারীদের ভিসার শর্ত সহজ হল
পরবর্তি সংবাদপ্রফেসর হজরতের সঙ্গে একদিন সারাদিন