গল্প ।। কবি হওয়া এত সহজ না ।। শামীম আহমাদ

‘আচ্ছা নিজাম, তুই তো বহুদিন ধরে কবিতা লিখিস, মাঝে মধ্যে গল্প-উপন্যাসও। চশমার মোটা গ্লাস সাক্ষ্য দেয় পড়েছিসও পাহাড় সমান। এতদিনের এত পড়া, এত চর্চা ও অভিজ্ঞতা, এবার বল তো একে কি কবি বলা যায়?’

‘কাকে?’

‘যে ছেলেটি একটু আগে আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল।’

‘একে বলতে হবে কবি? এই হুজুরকে!’

‘এমন করে ঠোঁট উল্টানোর কী আছে, কবিতা লিখলে কবি হবে!’

‘এই পাঞ্জিবিওয়ালা হবে কবি?’

‘কেন, না হওয়ার কী আছে? মানুষ কি পোশাক দিয়ে লেখে? লেখা হয় পোশাকের নিচের হৃদয় দিয়ে, বিশ্বাস দিয়ে।’

‘তবু এই আমাকে টুপি-পাঞ্জাবিওয়ালা হুজুরকে বলতে হবে কবি?’

‘আর্শ্চয! পোশাকের ক্ষেত্রে তোর যে এত এলার্জি রয়েছে তা তো জানতাম না। বাঙালি ছেলে-মেয়েদের শার্ট-প্যান্ট-গেঞ্জি-স্কার্ট – এমনকি বিকিকিনি কিংবা শিল্পীত নগ্নতাতেও তোর ও তোদের কত উদারতা…। তা কেন এই পায়জামা-পাঞ্জাবিতে এসে আটকে পড়ছে? তাছাড়া খাতা-কলমে এখনো এটাই তো বাঙালির জাতীয় পোশাক; কী বলিস!’

‘না দোস্ত, ব্যাপারটা এমন নয়।’ বক্তার কণ্ঠে কিছুটা ইতস্তত ধরাখাওয়া ভাব।

‘আমি আসলে বোঝাতে চাচ্ছিলাম, এ ধরনের পোশাকের কেউ কবিতা লেখে বা ভালো কবিতা লেখে বলে ভাবতে পারছি না।’

‘বললাম তো, কবিতা তোর পোশাকে লেখে নাকি? কবিতা লেখে পোশাকের আড়ালের একফোঁটা থরোথরো আবেগের কম্পমান হৃদয়। রবি ঠাকুর, রুমি ফেরদৈৗসি, খৈয়াম-আরো কত কত মহান কবি ও  সাহিত্যিকের পোশাক তো এমনই ছিল। এই অতি সম্প্রতি সুভাস দত্তের দাড়ি টুপি ও ঢুল্লা জামার বাহার দেখেছিস? তাতে কি তিনি বাতিলের খাতায় পড়ে গিয়েছেন? সাংস্কৃতিক-ব্যক্তিত্বরা তো সব সময় নিজেদের উদার বলেই পরিচয় দিয়ে থাকেন। সেই তোরাও যদি এভাবে মত ও দর্শনের ভিন্নতাকে ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যের চোখে দেখিস; তবে আর উদারতার বাণী আউড়িয়ে লাভ কী?’

‘থাক থাক, এ নিয়ে তর্ক করে লাভ নেই। ছেলেটার পরিচয় তো আগে দে।’

‘একজন কবির পরিচয় হলো তার কবিতা। কবিতা লেখে। এর চেয়ে বড় পরিচয় আর কী হতে পারে?’

‘পড়াশোনা?’

‘সব সময়ই তো দেখি পড়ে। পাশেই কোথায় যেন শিক্ষকতা করে। একটা টিউশনি… বাকি সময় পড়ে আর লেখে।’

‘বলছি একাডেমিক পড়াশোনা কোথায় বা কতটুকু?’

‘মাদরাসায় পড়েছে এবং এখনো কী যেন পড়ছে।’

‘মা…দরাসায় পড়েছে?’

‘হ, মাদরাসায়। ওই যে কওমি মাদরাসায়।’

‘কী বললি, কওওওমি মাদরাসায়! তার মানে হেফাজতি আখড়ায়!! তাকে বলছিস তুই কবি!!! তোর মাথা ঠিক আছে তো। টাকা না থাকলে বল আমি নিজেই পাবনা যাবার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’

‘ডাক্তার কার লাগবে সেটা পরের কথা। কিন্তু দোস্ত, তুই বোধহয় ভুলে যাচ্ছিস আমরা আসলে কওমি মাদরাসা বা হেফাজত নিয়ে কথা বলছি না। আমরা একটি তরুণের কথা বলছি যে কবিতা লেখে। গল্পও লেখে মাঝে-মধ্যে। এখন কথা হলো, তাকে কবি বলা যাবে কি না?’

‘আচ্ছা, আগে কবিতার কয়েকটি নমুতা তো দেখা।’

‘এই দেখাচ্ছি। আমার টেবিলেই আছে। এই যে একটি কবিতা; শিরোনাম, নীলচোখ সাগর…

তপ্ত বালুকার পরে রক্ত-বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছে যেই শিশুটি আজ

তার কথা যদি বলি,

কিংবা যদি বলি দীর্ঘ ডানা-মেলা কিছু হৃদপিণ্ডভোজী শকুনির কথা

তোমার কাছে কিছুই নয়কো আড়াল, হে দয়াময় খোদা,

সাগরের নীল নয়নে বারবার জমিছে ক্ষোভ…

‘এই থাম.. থাম… হয়েছে। অনেক হয়েছে… এভাবে আল্লাহ খোদা করে বেড়ালে তাকে কি কখনো কবিতা বলা চলে! এ তো ভীষণ সাম্প্রদায়িকতা। কবিতা লিখছে নাকি ধর্মচর্চা করছে?’

‘কিন্তু এটা তো নতুন নয়। বিষ্ণু দে, মধুসূধন, জন মিল্টন আরও কত কবিই তো এসব করেছে। রবি ঠাকুর তো জীবনভর দেবীর ‘বর’ প্রত্যাশায় মুখে ফেনা উঠিয়ে ফেলেছেন। তারও আগে ধর্মের রুদ্র মূর্তি নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন ‘মহামতি’ বঙ্কিম চন্দ্র। সাম্প্রদায়িকতার তকমা মেরে তাদেরকে বর্জনের কথা তো কেউ তোলেনি।’

‘আরে তুই কিসের সাথে কী মেলাচ্ছিস। সেগুলো ছিলো সাহিত্য-রচনা। লেখার ক্ষেত্রে চলনসই সেন্টিমেন্ট নিয়ে মানুষের মন ভজিয়েছেন মাত্র। সমাজ যেভাবে চলেছে, যেভাবে চেয়েছে তারা সেভাবেই লিখেছেন।’

‘একজন হিন্দু বা অন্য ধর্মের লোক যদি তাদের সেন্টিমেন্ট নিয়ে লিখতে পারে, মুসলমান পারবে না কেন?’

‘তুই ধর্ম আর সাহিত্যকে এক সাথে মেলাচ্ছিস কেন? দুটি একেবারে আলাদা ব্যাপার।’

‘উহু.. আমি কিছুতেই তোর এ কথার সাথে একমত হতে পারছি না। সাহিত্য যেহেতু জীবনের কথা বলে, মানুষের বোধ বিশ্বাস আশা আকাঙ্ক্ষা কামনা বাসনা ও ব্যর্থ-বেদনার কথা বলে… জীবনে যা ঘটে, সেটা নিয়েই কথা বলে, তাহলে ধর্ম তো জীবনেরই অংশ। এটি তার বিশ্বাস। তার জীবন চলার নির্দেশক। বাংলা সাহিত্যের সূচনাই হয়েছে ধর্মের বন্দনা গেয়ে। ধর্ম পালনের বৈষ্ণব পদাবলী দিয়ে। ধর্মহীনতা যেমন মানুষের একটি মত ও বিশ্বাস, নিজের বিশ্বাসকে সে মূল্য দেয়। ধর্মবিশ্বাসও তেমন। যে বিশ্বাসের দ্বারা সারা বিশ্ব আলোড়িত, হৃদয় স্পন্দিত; যার জন্য মানুষ জীবন পর্যন্ত দিতে পারে, তাকে তো খাটো করে দেখা যায় না। একটা মানুষ-তার বিশ্বাস যদি ধ্বংসাত্মক না হয়, কবিতার ভাব ভাষা তাল লয় ছন্দ ও শব্দের উপযোগিতা ঠিক রেখে হৃদয়ের সকল আকুতি-নিবেদন যদি উপস্থাপিত হয়, সেটা যদি সাহিত্য না হয় তবে আর সাহিত্য কী?’

‘আমি আসলে তা বলতে চাচ্ছি না। আমি বলছি যে, সাহিত্য দিয়ে তো আর ধর্মচর্চা হয় না। ধর্মচর্চা করতে হলে মসজিদে বসে বসে জিকির করো গিয়ে।’

‘সাহিত্য দিয়ে ধর্মচর্চা করা যায় কিনা আমি তা ভালো বুঝি না। কিন্তু ধর্ম নিয়ে যে সাহিত্যচর্চা করা যায়, তার উদাহরণ শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়; বিশ্বসাহিত্যেও ভুরি ভুরি। অধর্ম অবিশ্বাস অসামাজিকতা বিদ্রোহ, এমনকি যৌনতার উদগ্র বোধের কথায় যদি কবিতা হয় তবে মনুষের রক্তের আদরে গঠিত উষ্ণ বিশ্বাসের কথা বললে তা সাহিত্য হবে না কেন?’

‘দোস্ত, আমি তোর কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।’

‘না বোঝার কী আছে! আচ্ছা তোকে একটি উদাহরণ দেখাই। এই দেখ পশ্চিমবঙ্গের ‘দেশ’ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যা। আর এই দেখ আমাদের বাংলাদেশের ঈদসংখ্যা। প্রচ্ছদ ও বিন্যাসে কী আকাশ-পাতাল পার্থক্য। ‘দেশ’-এর দিকে দৃষ্টি দিতেই চোখের সামনে লালিয়ে উঠবে প্রতিমা-পূজোর রগরগে প্রকাশ। প্রতিমার প্রকট প্রভাব। পাতার পর পাতা হিন্দু দেবতাদের বিভিন্ন কারিশমা, তাদের অলৌকিকতা এবং ধর্মগুরুদের বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে মাথা ঝালাপালা হওয়ার অবস্থা। অথচ আমাদের ঈদ সংখ্যাগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে দেখ ‘ঈদ আমাদের ধর্মীয় উৎসব’ তবুও ঈদসংখ্যাগুলো থেকে ধর্ম বা ধর্মীয়তার প্রভাব তো দূরের কথা; সামান্য আভাস-ইংগিতও ধুয়েমুছে সাহিত্যকে ধর্মের ছোঁয়া থেকে পবিত্র রাখা হয়েছে। কী হলো? কারো ক্ষেত্রে ধর্মীয় বাতাবরণ ঠেলে সাহিত্যকে গ্রহণ করতে কোনো প্রশ্ন উঠছে না। অন্যদিকে ধর্মের সামান্য আভাস পেলেও সাহিত্য বলতে আর কিছুই থাকছে না। দুটি ধর্মের ক্ষেত্রে আমাদের বাংলাদেশী কবি-সাহিত্যিকদের দৃষ্টির এই ভিন্নতা কেন? এটা আমাদের দুর্বল দুষ্ট চরিত্রের পরিচয় প্রকাশ করে দিচ্ছে। নাকি গোপন কোনো সন্ধি?…’

‘তুই কি হুজুরটার সাথে খবু বেশি মিশিস নাকি?’

‘মাঝে-মধ্যে কথা হয়। কিন্তু তার অনেক কথারই আমি কোনো উত্তর দিতে পারি না। ছেলেটি দিনে দিনে প্রশ্নের স্তুপ জমিয়ে দিয়েছে আমার মাথায়।’

‘আচ্ছা, হুজুরের কবিতা কোথায় ছাপা হয়?’

‘বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা ছাপে। দৈনিকেও কিছু কিছু ছেপেছে। তবে ছাপানোর চেয়ে তার লেখা জমছেই বেশি।’

‘কোনো পার্টি-টার্টিতে যায় নাকি?’

‘পার্টি-টার্টি মানে?’

‘মানে এই মূলধারার সেসব প্রবীণ-নবীন কবি ও লেখক-তাদের সাথে মেলামেশা, চিন-পরিচয়-একটু ধোঁয়া ছাড়া… গলা ভেজানো… এই আরকি…’

‘এসব সে করবে কীভাবে? সে তো আর ফালতু হুজুর না, এগুলোকে সে হারাম মনে করে।’

‘তবে আর কোনোভাবেই আমি তাকে কবি বলতে পারছি না। এভাবে কি কবি হওয়া যায়!’

কী জানি! হয়তো তোর কথাই ঠিক, অতীতে দু একজন এদিক-ওদিক ফসকে গেলেও এই একবিংশ শতাব্দীতে লালপানি না খেয়ে কবি হওয়া সত্যিই সহজ কথা নয়। #

পূর্ববর্তি সংবাদসরকারি ওষুধ বিক্রির অভিযোগে সিরাজগঞ্জে আটক তিনজন
পরবর্তি সংবাদআশগাবাত : ধবধবে এক সাদা শহরের উত্থান