একটা গল্প এবং আরও কিছু খুচরা গল্প ।। হাসান ইনাম

হাসান ইনাম ।।  

ছোট একটা গল্প দিয়ে শুরু করি। সমুদ্রে জাহাজ চলছে। জাহাজে অনেক যাত্রী। এর ভিতর এক কোণে চুপচাপ বসে আছে এক কিশোর। কিশোরের সাথে কেউ নেই। একা একাই যাচ্ছে সে। হঠাৎ এক লোক এসে বসলো ছেলেটার পাশে। ছেলেটার সাথে গল্প জুড়লো। অনেক কথার মাঝখানে জেনে নিলো ছেলেটার কাছে কয় টাকা আছে।

তারপর হঠাৎ জাহাজের ডেকে গিয়ে ঘোষণা করলো তার টাকা হারিয়ে গেছে। ছেলেটার কাছ থেকে শুনে আসা নির্দিষ্ট সংখ্যাটাই বললো লোকটা। তারপর ঘোষণা করলো সে সবাইকে সার্চ করতে চায়। দেখতে চায় কে নিয়েছে টাকা। একে একে সার্চ করতে করতে এক পর্যায়ে ছেলেটাকেও সার্চ করা হলো। কিন্তু দেখা গেলো তাঁর কাছে একটা টাকাও নেই।

চতুর লোকটা খুব হতাশ হয়ে অনুসন্ধান পর্ব শেষ করে ছেলেটার পাশে এসে বসলো আবার। জিজ্ঞেস করলো কেন মিথ্যে বলেছিলো ছেলেটা। ছেলেটা এবার জবাবে বললো ‘আমার কাছে সত্যিই টাকা ছিলো। কিন্তু যখন আপনি ঘোষণা করলেন তখনই আমি টাকার থলি সমুদ্রে ফেলে দিয়েছি। এর কারণ হলো যদিও টাকাটা আমার। কিন্তু আমাকে চোর সাজিয়ে টাকাটা বাগিয়ে নিবেন। এতে করে সবাই আমাকে চোর মনে করবে। বিরূপ প্রভাব পড়বে আমার স্বজাতির উপর। সবাই মনে করবে আমাদের সবাই বোধহয় এমনই হয়। চুরি করে। তাই আমি ফেলে দিয়েছি।’

যারা গল্পটা জানেন তাঁরা চিন্তা করছেন কেন আমি এভাবে উপাস্থাপন করছি। কেন নামধাম ছাড়া গল্পের মতো বলছি সত্য ঘটনাকে। হ্যাঁ, এটা ইমাম বোখারীর ঘটনা। ইমাম বোখারী খুব ছোট বয়সেই এই ঘটনা ঘটিয়েছিলেন শুধু মাত্র নিজের জাতির গায়ে যেন কালিমা লোপন না হয়। যারা মাদরাসায় পড়েছেন, পড়ছেন সবাই জানেন এই ঘটনা। অসংখ্যবার শুনেছেন। কিন্তু আমি এভাবে বললাম কেন?

শুরুতেই যদি মাদরাসার কথা বলতাম। ইমাম বোখারী (রহঃ) এর নাম বলতাম তাহলে অনেকেই এড়িয়ে যেতেন। কেন যেতেন? অনীহা কেন? আসেন আলাপ করি।

দিনান্তর এই নীল সাদা জগতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে এসে অস্তিত্ব হারাচ্ছি আমরা অথবা আমি। ধুর, তাতে কী! আমি শেকড় ছাড়ি আর শেকড় ধরি তাতে মাদরাসার কার কী আসে যায়? আমার কাজ আমি করবো। আমার যা ইচ্ছা আমি করবো। আমাকে নিয়ে কথাবার্তা বলার রাইট অন্যদের কে দিয়েছে?
ওকেই। এইতো আলাপ। এটাই তো সবাই বলেন। আমিও বলি; বলতাম।

নটরডেমের এক ছেলে কদিন আগে নটরডেমে পড়া লেইম নাম ওয়ালা আইডি খুঁজে বের করে পোস্ট দিয়েছিলো একটা। কারণ? কারণ ওদের জন্য ইমেজ সঙ্কটে পড়তে হয়। মানুষজন ট্রল করে। এইতো নাকি?

এরকম আলাদা আলাদা অসংখ্য জিনিস ঘটছে আশেপাশে। আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠান। আলাদা স্কুল, আলাদা কলেজ, আলাদা ভার্সিটি। কিন্তু মাদরাসার প্রসঙ্গ আসলে? মাদরাসা তো মাদরাসাই। ক্বওমী এবং আলিয়া। দেওবন্দ এবং হাটাজারি। চরমোনাই এবং ছারছিনা। অমুক বনাম তমুক। লালবাগ, ফরিদাবাদ, ইকরা। এসবের কিছুই মানুষ বুঝে না। জানে না এবং জানতেও চায় না। আগ্রহ নেই। যে হিফজখানায় পড়ছে তাকে যেমন মাদরাসার ছাত্র হিসাবে দেখা হয় ঠিক যে ইফতা পড়ছে সেও তেমন। দাখিলে যে পড়ছে সে যেমন, কামিলে যে দিয়েছে সেও তেমন। এত পরিভাষা, এত ভাগ, এত শ্রেণিভেদ মানুষ জানে না। জানতে চায় না। আগ্রহও নেই। সমাজে এমন মানুষ নয়জন। আমি, আপনি একজন।

এজন্য দোষ একজন করলে সবার উপর চাপে। চুরি একজন করলে সবাইকে চোর বলা হয়। আর সাদা জামায় তো ঝোল বেশিই পড়ে।

এখন এই বোধটা তো যে তাইসীরে পড়ে তার মাথায় নেই। যে হিফজ পড়ে তার মাথায় নেই। কিন্তু সেতো ফেইসবুক চালায়। ফেইসবুকে এসে নিজেকে আলাদা প্রমাণ করতে চায়। নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে চায়। এবং যথারীতি ভুল করে আর দোষ চাপে গোটা মাদরাসার। ওকে, হতেই পারে। করতেই পারে। সে তো ছোট।

নিজেকে আলাদা প্রমাণ করতে এসে সবাই সৃজনশীলতা চর্চা করে। কেউ ছবি আঁকে। কেউ ছবি তোলে। কেউ গল্প লেখে। কেউ গল্প পড়ে। সুন্দর সুন্দর প্রতিভা বের হয়ে আসে। এই বের হয়ে আসার জার্নিটা খুব সহজ না। আর তেমন কেউ সাপোর্টও করে না সাকসেসফুল হওয়ার আগ পর্যন্ত। সেই আলাপ বাদ। পুরোটাই স্ট্রাগলের বিষয়। মানুষিক শক্তির বিষয়।

এই সৃজনবাদ দেখে অনুকরণপ্রিয় মাদরাসার ছাত্ররা খুব অনুপ্রাণিত হয়। অনেকেই শুরু করে। নিজের যোগ্যতা বা শক্তির বিচার না করেই শুরু করে। যেটা সামনে পায় সেটাই করে। করুক, সবাই চেষ্টা করুক। অসুবিধা নেই। সবাইকে পারতে হবে এমন কথা কোথাও নেই। তাই সবাই পারেও না। কিন্তু চুরি কেন ভাই?

মানুষের ক্রিয়েটিভিটি চুরি করে হয়তো আপনি হাজারটা লাভ রিয়্যাক্ট কামালেন। ইনবক্সে চুমুর ইমোজি পেলেন। এইতো নাকি? রাস্তায় হাঁটার সময় আমরা কেউ লাইক,ফলোয়ার আর ফ্রেন্ডস নিয়ে ঘুরি না। কিন্তু এই হাঁটার সময় যদি কেউ আপনাকে দূর থেকে দেখে বলে ‘আরে এটা ওই ছেলেটা না? ওইযে ওই আকামটা করছিলো?’ কী লাভ? লাভটা কী?

আমি নিজে ভালো না। স্বীকার করি। দুই তিনবছর আগে আমার একটা গল্প নিয়ে খু্ব সমালোচনা হয়েছিলো। তখন সাইফ ভাই বলেছিলেন ‘ সবচেয়ে সমস্যা হচ্ছে ওরা শুধু গল্পই লেখছে না। পাশাপাশি নিজেকেও হারাচ্ছে।
সেইটে খেয়াল করছি না। ওদের ভেতরে দ্রুত প্লেস পাওয়ার একটা প্রবনতা এসেছে। সেই থেকে ওরা এমন সব বিষয় নির্বাচন করছে বা করতে চাচ্ছে যেগুলো দিয়ে দ্রুত লাইম লাইটে আসা যায়। ‘অপরাধ করেছি আমি একা। অথচ সাইফ ভাই বললেন একটা সার্কেলকে। একটা সময়কে। কেন বললেন? এখানেই বিষয়।

সেসময় আমি গল্পটা লিখে খুব বড় লেখক গিয়েছিলাম? মোটেও না। কিছুদিন পরেই বুঝতে পেরেছিলাম বিষয়টা অন্যভাবে বলা যেতো। এইযে অপরিপক্বতা। এটার জন্য কে দায়ী? আমিই তো। কিন্তু দোষারোপ হলো সবাই। এই বোধটা আমার অর্জন করতে সময় লেগেছে। এরকম কিছু হয়েছে বলেই সম্ভব হয়েছে। কিন্তু লাইটলি বাইরের কেউ জানে না বিষয়টা। আমি সেই থেকে নিজেকে খুব গুটিয়ে রাখি। একটা কাজ করার আগে ভাবি, এটার জন্য অন্যকে দোষী হতে হবে কীনা।

আমি গতকালকেও বলেছি, ফেইসবুকে আবেগ, ক্রোধ, প্রেম, কাম সবকিছু আছে এখানে। কোনোটাই ছোঁয়া যায় না, স্পর্শ করা করা যায় না কিন্তু স্পর্ধা দেখানো যায়। নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার স্পর্ধা। মানুষ থেকে অমানুষ হওয়ার স্পর্ধা।

যারা নিজে চুরি করে, নিজে বেহায়াপনা করে পুরো একটা সম্প্রদায়কে দায়ী করছেন তারা সতর্ক হোন। এই মাদরাসাওয়ালারা আপনার কিছু চায় না। কোনো উপকার করতে হবে না। আপনি মাদরাসায় না পড়লে কারো কোনো আসে যায় না। শুধুমাত্র বদনাম করা থেকে বিরত থাকুন। আপনার প্রেম টেকানোর জন্য অথবা লাভ রিয়্যাক্ট কামানোর জন্য এত বিশাল জনগোষ্ঠীকে দোষারোপ করার অধিকার আপনার নেই। নিজের অঙ্গনকে সম্মান করতে শিখুন। ঘর থেকে এসব না শিখলে বাইরে কিছুই পাবেন না। সবাই ছুঁড়ে ফেলবে। এখনও সময় আছে। দাগ রেখে যেতে এসে দাগী হওয়া থেকে বিরত থাকুন।

পূর্ববর্তি সংবাদমদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম দিন
পরবর্তি সংবাদপল্টন টু মিরপুর : দুস্তর পারাবার