টঙ্গীতে ওয়াজাহাতি জোড় : ওলামায়ে কেরাম যা বললেন

শাহ মুহাম্মাদ খালিদ ।। টঙ্গী থেকে

টানা কয়েক দিন তীব্র দাবদাহের পর হঠাৎ সমুদ্রে নিম্নচাপ। তার প্রভাবে বৃষ্টিপাত। টঙ্গীর ওয়াজাহাতি জোড়ের আয়োজকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। এটি আরো বৃদ্ধি পায় শুক্রবার দুপুরেও যখন অবিরাম বৃষ্টি অব্যাহত থাকে। অবশ্য যাদের দৃঢ় বিশ্বাস আল্লাহই পালেন, আল্লাহই খাওয়ান, আল্লাহই সব করেন— সেই আল্লাহই তাদের জন্য সব সহজ করে দিয়েছেন।

ফলশ্রুতিতে ঠিক জোড় শুরু হওয়ার আগে আগে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায়। মুহূর্তেই লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় পুরো ময়দান। আসর নাগাদ প্যান্ডেল ছাড়িয়ে ময়দানের আশপাশও তাবলিগ-সাথী ও আলেম-ওলামায় পূর্ণ হয়ে যায়। ততক্ষণে একে একে স্টেজে এসে উপস্থিত হন মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীব, মাওলানা আবদুল মালেক, মাওলানা আবদুল কুদ্দুস, মুফতি কেফায়েতুল্লাহ আযহারী, মধুপুরের পীরসাহেব মাওলানা আব্দুল হামীদ, মুফতি মানসুরুল হক, মাওলানা মাহফুজুল হক, মাওলানা মিযানুর রহমান সাঈদ, মাওলানা নূরুল ইসলাম ওলীপুরীসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম এবং কাকরাইলের শুরার সাথীবৃন্দ।

তাবলিগের মুরুব্বি মাওলানা আব্দুল মতিন বলেন, এখন অনেক জায়গার কথা আমরা শুনি, যেখানে এতায়াতি ভাইয়েরা বাদ মাগরিব বয়ানে, গাশতের আদবে সাদ সাহেবের এতায়াত বা আনুগত্যের প্রতি দাওয়াত দেন। অথচ আমাদের এই মেহনতে মাখলুকের প্রতি কোনো দাওয়াত নেই। দাওয়াত কেবল আল্লাহর দিকে। হযরত আবু বকর রা. তার দুই বছরের খেলাফতকালে বহুবার আমিরুল মুমিনের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। হযরত ওমর রা. ১৫ বার আমিরের পদ ছেড়েছেন। হযরত হাসান রা. হকদার হওয়া সত্ত্বেও মুয়াবিয়া রা.-এর সঙ্গে সন্ধির জন্য আমিরের পদ ছেড়ে দিয়েছেন। সেখানে অন্যায় প্রক্রিয়ায় আমির হওয়ার জন্য সাদ সাহেব কেন এত উঠেপড়ে লেগেছেন তা আমাদের বুঝে আসে না। এতদিন সাহাবাওয়ালা কাজের কথা বলে এখন তিনি নিজেই সাহাবাদের কর্মপন্থার বিপরীত করছেন।

দেশের বরেণ্য ওয়ায়েজ মাওলানা নুরুল ইসলাম ওলীপুরী বলেন, এতায়াতি ভাইয়েরা বলে থাকেন সাদ সাহেবের কাছে নাকি এলহাম আসে। এলহাম হওয়ার কারণে এগুলো অন্যদের বুঝে আসে না। আমিও বলি সাদ সাহেবের কাছে এলহাম আসে। তবে সেই এলহাম আল্লাহর পক্ষ থেকে নয় বরং শয়তানের কাছ থেকে আসে। কারণ যেই এলহাম কুরআন-হাদীসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় তা কখনো আল্লাহর পক্ষ থেকে আসতে পারে না। তাদের একটি আপত্তির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা বলে আলেমরা কখনো চিল্লা দেয় নাই। সুতরাং তাবলীগ নিয়ে কথা বলার কোনো অধিকার তাদের নেই। এ রকম হলে সবার আগে মাওলানা সাদকে নিজামুদ্দিন ছাড়তে হবে। কারণ তিনিও কখনো তাবলীগে চিল্লা দেন নাই। আশ্চর্যজনক হলেও এটাই বাস্তব।

মারকাযুদ দাওয়ার আমীনুত তালীম ও বিশিষ্ট ফকিহ মাওলানা আবদুল মালেক বলেন, নবীগণের জীবনী আলোচনা করা হয় সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য, এতায়াত করার জন্য। অথচ সাদ সাহেব নবীগণের জীবনী আলোচনা করেন তাঁদের ভুল ধরার জন্য। মাওলানা সাদ সাহেবের ভুলগুলো যখন দেওবন্দ থেকে ধরিয়ে দেওয়া হলো তখন তিনি নামকাওয়াস্তে রুজু করেন। যাকে কোনোভাবে রুজু বলা যায় না। কারণ তিনি ভুলগুলো করেছেন বড় বড় ইজতেমায়। লাখ লাখ মানুষের সামনে। আর রুজু করেছেন মারকাযের চার দেয়ালের মধ্যে। উপরন্তু তার রুজু করার ধরন হলো, “যদি কেউ এমনটা বলে থাকেন, তা হলে তার রুজু করা উচিত।” তিনিই যে সেই ভুলের বলনেওয়ালা, এটা তিনি কোনোমতেই স্বীকার করেননি। তা ছাড়া যে রুজুর কথা বলা হচ্ছে, সেটা কেবল হজরত মুসা আ.-এর ব্যাপারে। হজরত ইউসুফ আ., হজরত যাকারিয়া আ. এবং রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন, সেসব ব্যাপারে তিনি কোনো ধরনের রুজুই করেননি।

জোড়ে অধিকাংশ আলোচক যে বিয়য়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তা হচ্ছে, এতায়াতিরা বলে এগুলো নাকি কেবল মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের জোড়। এখানে নাকি তাবলিগের কোনো সাথী নাকি নেই। মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক ব্যতিত যে সকল সাধারণ শিক্ষিত মানুষ তাবলীগে সময় লাগিয়েছেন আলোচকগণ তাদেরকে হাত উচু করতে বলেন। দেখা যায়, মজমার অধিকাংশ লোকই তাবলিগের সাথী। তাদের তুলনায় মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের পরিমাণ কম। গত কয়েকটি জোড়ের মতো টঙ্গীতেও পানি, শরবত, বিস্কিট, রুটি, কেক ইত্যাদির মাধ্যমে সাথীদের আপ্যায়ন করা হয়। বিশ্ব ইজতেমার ময়দান টঙ্গীতে হওয়ায় টঙ্গীর এই জোড়ের দিকে সংশ্লিষ্ট সবার নজর ছিল। বিশেষত স্থানীয় প্রশাসনের বক্তব্য ও মনোভাব জানতে আগ্রহী ছিলেন সবাই।

স্থানীয় সাংসদ জাহিদ আহসান রাসেল বলেন, সরকার ওলামায়ে কেরামের সঙ্গে আছেন। আগামী ইজতেমা নির্ধারিত সময়ে ওলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানেই হবে।

রাত দশটায় কাকরাইলের শুরা মুরুব্বী এবং বর্ষীয়ান আলেমে দ্বীন মাওলানা যুবায়ের সাহেব স্টেজে আসেন। উম্মাহ ও দেশের জন্য তাঁর দোয়ার মাধ্যমে দুপুর থেকে চলা জোড়ের সমাপ্তি হয়। দাওয়াত ও তাবলীগের চলমান সংকট নিয়ে স্থানীয় সাধারণ মানুষ ও তাবলিগি-সাথীদের মধ্যে যে অস্পষ্টতা, দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও প্রশ্ন ছিল, এই জোড়ের মাধ্যমে তা দূরীভূত হয়ে গেছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এ ধরনের ওয়াজাহাতি জোড় সারা দেশেই চলতে থাকবে বলে তারা জানান।

পূর্ববর্তি সংবাদঐক্যফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে গেলেন বি চৌধুরী
পরবর্তি সংবাদমুম্বাইতে আবার বাংলাদেশী খোঁজাখুজি চলছে