শরণার্থী জীবন : ‘একদিন সিরিয়ার প্রয়োজন হবে তাদের’

সিরিয়ায় যুদ্ধের ভয়াবহতা শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই আল-জাওরির বাড়িটি বোমার আঘাতে ধ্বংস হয়ে যায়। আল-জাওরি এবং তার ছেলে সুলায়মান নিজেদের বাঁচাতে আশ্রয় নেন পার্শ্ববর্তী দেশ লেবাননে। বাড়ি থেকে পালানোর সময় আল-জাওরির নেয়ার মতো অবশিষ্ট আর কিছুই ছিল না, শুধু বেঁচে গিয়েছিল তার কলেজের সার্টিফিকেট। তিনি সেটাই সঙ্গে নেন।

ছেলে সুলায়মানও কিছু দূর গিয়ে ফিরে আসেন। পোড়া বাড়ির ভেতর থেকে উদ্ধার করেন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ডটি। যত্ন করে সেটা ব্যাগে ভরে নেন। তার বাবাই তাকে শিখিয়েছিল, শিক্ষাই হলো সবকিছু। শিক্ষা দিয়েই তুমি বদলে দিতে পারো একটি জাতির ভবিষ্যত।

শিক্ষার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ছুটছেন সুলায়মান

সেই থেকে সুলায়মান নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন শিক্ষার ঝুলি। এখন লেবাননের তাল আব্বাস শরণার্থী শিবিরের একজন শিক্ষক তিনি।

লেবাননে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ১০ লাখ সিরিয়ান শরণার্থী। তাদের মধ্যে ৮০ ভাগই নারী ও শিশু। তাদের জন্য শিক্ষা-দীক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা নেই বললেই চলে।

আল-জাওরি বলছিলেন তার ছেলে সুলায়মানের ব্যাপারে, ‘তাকে নিয়ে আমার গর্ব হয়। এখানে আমাদের শিশুরা অনেক কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। খাবার নেই, ওষুধ নেই, জীবন ধারনের অনেক কিছুই নেই। তবু সে তাদের মুখে এক টুকরো হাসি ফোটানোর জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’

সিরিয়া যুদ্ধে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছে ৪ লাখ ৬৫ হাজার মানুষ। ১০ লাখের মতো মানুষ আহত কিংবা পঙ্গু। ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

সুলায়মানের শরণার্থী স্কুলের এক ছাত্রী বলছিল, ‘যখন পালিয়ে আসি তখন আমি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তাম। আমরা সবাই খুব হাসিখুশি ছিলাম। মনে পড়ে, তখন আমার বাবা আমাদের সঙ্গে থাকতেন। কিন্তু এখন কে কোথায় আছে, কোনো খবর নেই।’

তবুও সে আশা জিইয়ে রেখেছে। সে বলছিল, ‘এখন এই স্কুলই আমার দ্বিতীয় বাড়ির মতো। এই স্কুল আমাকে শত কষ্টের মাঝে কিছুক্ষণের জন্য হলেও আনন্দে সময় কাটানোর সুযোগ করে দেয়। যদি আমি আমার মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে পারতাম তাহলে আরও আনন্দিত হতাম। আমি আমার দেশে ফিরে যেতে চাই। সম্ভব হলে আজকেই, কালকের জন্য অপেক্ষা করাও আমার পক্ষে অনেক কঠিন।’

শিক্ষক সুলায়মানের ছাত্র-ছাত্রীর সবাই বয়সে ছোট। তারা সবাই আবার ফিরে যেতে চায় শান্ত সুন্দর সিরিয়ায়। যেখানে কোনো গুলির আওয়াজ, কোনো বোমা বা বিমানের শব্দ শোনা যাবে না। তারা আবার তাদের দেশকে গড়ে তুলতে চায়।

লেবাননের শরণার্থী শিবিরের শিশুরা আলোকিত হচে্ছ

তাদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তোমরা বড় হয়ে কী হতে চাও?

একজন বলল, আমি শিক্ষক হতে চাই।

একজন বলল, আমি ডাক্তার হতে চাই, আহতদের সেবা করতে চাই।

আরেকজন বলল, শিখতে চাই, আমি কেবল শিখতে চাই।

আল-জাওরি ভালো করেই জানেন যুদ্ধের ভয়াবহতা কীভাবে এই নিষ্পাপ প্রজন্মকে দলে পিষে একাকার করে দিয়েছে। তিনি বলছিলেন, ‘এখানে তারা শিক্ষা পাচ্ছে না। এটা নির্মম বাস্তবতা। এমন একটা প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে যারা শিক্ষার আলো থেকে দিন দিন দূরে সরে যাচ্ছে, যারা কখনোই স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায় না। এমন অবস্থা চলছে বিগত পাঁচ বছর থেকে। পুরো প্রজন্ম হারিয়ে যাচ্ছে অশিক্ষার অন্ধকারে। শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছুই করার নেই আমাদের।’

আল-জাওরির কণ্ঠে ঝরে পড়ে কান্নার শ্লেষ।

সুলায়মান তবু আশা নিয়ে বসে আছেন, ‘আমরা সিরিয়ার প্রজন্ম। আমি যতটুকু পারি এই প্রজন্মকে শিক্ষার আলো দিয়ে যাব। একদিন সিরিয়ার প্রয়োজন হবে তাদের। তখন যেন তারা দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারে। মাতৃভূমির জন্য এটাই আমার শেষ ভালোবাসা।’

সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর ।। আলজাজিরা অবলম্বনে

পূর্ববর্তি সংবাদমিয়ানমারে উগ্র বৌদ্ধদের মিছিল, জনসম্মুখে আবারও সেই কসাই
পরবর্তি সংবাদকাকরাইল মসজিদে সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভি রহ.-এর বয়ান ও কিছু কথা