এলাহাবাদের নাম বদলে ফেলা হলো, ইতিহাসও কি মুছে ফেলা যাবে?

সাদ আবদুল্লাহ মামুন  ।।  

৭১ বছর আগে ভারত ভাগ হওয়ার সময় সীমান্তের দুদিকেই মানুষ পাড়ি জমিয়েছে। ভারতের বিভিন্ন শহর থেকে বিপুল সংখ্যক মুসলমান পাকিস্তানে চলে গেছেন। কিন্তু তারা তাদের বাপ-দাদার শহরের স্মৃতি আজও ভুলতে পারেননি। এ রকমই একটি শহর এলাহাবাদ।

১৬ অক্টোবর ‘এলাহাবাদ’ শহরের নাম বদল করে বিজেপি সরকার নাম দিয়েছে প্রয়াগরাজ।

কোনো শহরকে হিন্দু বা মুসলমানের নামে নামকরণ করা যেতে পারে। কিন্তু পুরনো নামের সঙ্গে মিশে থাকা স্মৃতিকে তো আর বদলে দেওয়া যায় না!

এলাহাবাদের সঙ্গে স্মৃতি জড়িয়ে থাকা এমনই একজন হলেন মুহাম্মদ সুলাইমান। ১৯৪৮ সালে দেশ ভাগের সময় যিনি ৮ বছর বয়সে ভারত থেকে পাকিস্তানে পাড়ি জমিয়েছিলেন। নিজের বাপ-দাদার শহর এলাহাবাদের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে হিন্দু-মুসলিমদের মাঝে দাঙ্গা বাধার খবর আসে। কিন্তু আমাদের এই শহরে আজ পর্যন্ত কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। ভারত ভাগ হওয়ার আগে থেকেই এলাহাবাদ সব সময় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা থেকে মুক্ত ছিল।

‘আমাদের বড় চাচা পুলিশের কর্মকর্তা ছিলেন। তার বাড়ির পাহারায় বেশিরভাগ সময়ই থাকত হিন্দু সিপাহি। আমরা কখনোই তাদের ভয় পেতাম না। পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু এবং তার মেয়ে ইন্ধিরা গান্ধী এলাহাবাদ থেকে নির্বাচন করতেন। এলাহাবাদে এসে তাদের ভোট চাইতে হতো না। তারপরও মানুষ তাদের ভোট দিতো।’

এই নাম আর হয়তো উৎকীর্ণ থাকবে না কোনো স্টেশনে

ভারতে বিজেপি সরকারের আমলে স্টেশন থেকে শুরু করে শহর, বহু কিছু থেকেই মুসলমানি নাম পাল্টে ফেলা হয়েছে বা হচ্ছে। এবার সেই তালিকায় যোগ হলো ভারতের উত্তরপ্রদেশের ইতিহাসছোঁয়া শহর এলাহাবাদ।

শহরটির মুসলিম নাম এলাহাবাদ পরিবর্তন করে হিন্দু নাম দেওয়া হয়েছে প্রয়াগরাজ। পরিষদে নাম পাল্টানোর প্রস্তাব তোলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ যোগী। বিরোধী কংগ্রেস দলের সব প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে প্রস্তাবটির অনুমোদন দেয় রাজ্য সরকার।

কংগ্রেস দলের মুখপাত্র ওঙ্কার সিং বলেন, ‘নাম বদল হলে এলাহাবাদের ইতিহাসের ওপর প্রভাব পড়বে। এই নাম পরিবর্তনের ফলে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বড় রকম ভূমিকা রাখা শহরটির ঐতিহাসিক ভূমিকাকে খাটো করা হবে।

‘স্বাধীনতা-আন্দোলন চলাকালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এলাহাবাদ। ১৮৮৮, ১৮৯৩ ও ১৯১০ সালে সেখানে মহা অধিবেশন হয়েছে। ইতিহাসে যার উল্লেখ রয়েছে। এ শহর থেকেই প্রথম প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে ভারত। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিতি হারিয়ে যাবে যদি এর নাম বদলে প্রয়াগরাজ বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়।

‘কংগ্রেস মুখপাত্র ওঙ্কার সিং আরও বলেন, যদি সরকার একান্তই ‘প্রয়াগরাজ’ নামটি চায়, তা হলে আলাদা শহর গড়ে তার নাম প্রয়াগরাজ করা হোক। কিন্তু এলাহাবাদের নাম বদল করা উচিত নয়।’

অনেকেই বলছেন, নরেন্দ্র মোদির সরকার যে ভারত থেকে মুসলিম ঐতিহ্য মুছে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন এই নাম পাল্টানোর মাধ্যমে তা আবার প্রমাণিত হলো।

বিজেপিবিরোধীরা বলছেন, আগামী বছর অনুষ্ঠেয় লোকসভা নির্বাচনের আগে হিন্দু আবেগ উসকে দেওয়ার জন্যই যোগী আদিত্যনাথ সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

কংগ্রেস নেতা প্রমোদ তিওয়ারি বলেন, লোকসভা ভোটের কথা মাথায় রেখে হিন্দুত্বের তাস খেলতে চাইছে যোগী আদিত্যনাথ সরকার। কারণ, বুঝতে পারছে কাজের নিরিখে আর জিততে পারবে না বিজেপি। তাই এখন হিন্দুত্বকে ভরসা করে এগোতে চাইছে তারা।

মোগল আমলে নির্মিত এলাহাবাদ দুর্গ

উল্লেখ্য, গঙ্গা ও যমুনার মিলনস্থলের কাছে ১৬০০ শতকে মুঘল সম্রাট আকবর একটি দুর্গ তৈরি করেন। সেই দুর্গ ও তার আশপাশের অঞ্চলকে তিনি নাম দেন এলাহাবাদ। এরপর তার নাতি সম্রাট শাহজাহান গোটা শহরের নামকরণ করেন এলাহাবাদ।

এর আগে বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ সরকার গত ২০১৭ সালের ৫ জুন রাজ্যের প্রাচীন রেলস্টেশন মোগলসরাই’র নাম বদলে ফেলে। সরকার নতুন নাম দেয় পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় নগর জংশন।

পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ভারতীয় জনসংঘের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক (আরএসএস)-এর নেতাও ছিলেন এই ব্যক্তি। মোগলসরাইয়ের পর এবার গোটা এলাহাবাদ শহরের নামই বদলে দেওয়া হলো।

মোগলসরাই রেলস্টেশনের প্রতিষ্ঠা ১৮৬২ সালে আর এলাহাবাদ রেলস্টেশনের প্রতিষ্ঠা ১৮৫৯ সালে। এ ছাড়া বেরেলি, কানপুর ও আগ্রা বিমানবন্দরগুলোর নামেও হিন্দুত্ববাদের ছাপ রাখার প্রস্তাব করেছে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার। অথচ এ রাজ্যের ২২ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশই মুসলিম।

ভারতের ৮০ শতাংশ হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে হিন্দুত্ববাদ জাগিয়ে দিয়ে বিজেপি আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আবারও ক্ষমতায় আসার পরিকল্পনা আঁটছে বলে মনে করছেন দেশটির রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতে মুসলিম শাসনের হাজার বছরের ইতিহাসকে হিন্দু ধর্মের জন্য একটি কালো অধ্যায় হিসেবে উপস্থাপন চলতে থাকে। মুসলিম ইতিহাসের বাস্তবতাকে একের পর এক বদলে দিয়ে নতুন নতুন বিকৃত ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হয় এবং মুসলিম শাসকদের জীবনচরিত্রকে অত্যাচারী ও নিষ্ঠুর হিসেবে চিত্রিত করা হতে থাকে।

শিক্ষিত হিন্দুদের একটা শ্রেণি মুসলিম শাসকদের অবদান ও কীর্তি মুছে ফেলার নাম দিয়েছে ‘ইতিহাসের ভুল সংশোধন।’

বিদ্বেষ পোষণ করে কোনো স্টেশন বা শহরের নাম কাগজ থেকে হয়তো মুছে ফেলা যাবে, কিন্তু ইতিহাস থেকে এবং মানুষের হৃদয় থেকে কি মোছা যাবে এতদিনকার ঐতিহ্যের পরিচয়?

।। বিবিসি উর্দু অবলম্বনে

পূর্ববর্তি সংবাদখাশোগি ডিল : সৌদির ১০০ মিলিয়ন ডলারে ট্রাম্পের সুর নরম
পরবর্তি সংবাদ‘আল্লামা তাকি উসমানি আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, তুমি আমার মন ভরে দিয়েছো’ -মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন