আতাউর রহমান খসরু ।।
গ্রাম মানেই নির্মল এক ছায়াছবি। গ্রাম যেন স্নিগ্ধ আর শহরের কদর্যমুক্ত শান্ত এক পরিবেশ। শহুরে জীবনের ঢেউয়ে ঢেউয়ে মিশে থাকা কলুষতা, চিন্তা ও বিশ্বাসের আবর্জনা, অবাধ-উচ্ছৃংখল উপেক্ষার মানসিকতা থেকে মুক্ত গ্রাম। গ্রামের মানুষ তাদের প্রকৃতি ও পরিবেশ, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, ধর্ম, বিশ্বাস ও সংস্কার রক্ষায় যত্নশীল। গ্রামের প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে এমন ধারণাই সর্বজনবিদিত। তবে এ চিত্র ও ধারণায় পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে ইদানীং।
নীতি-নৈতিকতার জায়গায় সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও আধিপত্য, সাধারণ মান্যতার পরিবর্তে বেপরোয়া ভাব, পর্দা ও শালীনতার স্থানে অশালীন ও উদ্ভট চাল-চলন এবং ধর্মীয় অনুশাসনের জায়গায় নীরব উদাসীনতা দিন দিন যেন জায়গা করে নিচ্ছে গ্রামীণ জীবনেও।
এক সময় গ্রামের সাধারণ দ্বীনপ্রাণ মানুষ টিভি-ভিসিআরকে ঘৃণার চোখে দেখলেও তা এখন গ্রামীণ জীবনের সাধারণ বিনোদন মাধ্যম। গ্রাম্য বাজারে কিংবা তিন রাস্তার মোড়ের দোকানে দোকানে টিভি। তাতে দেখানো হচ্ছে দেশি-বিদেশি সিনেমা-সিরিয়াল। এসব দোকানে ভীড় করছে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই। আবার খেলার মৌসুমে এসব দোকানই হয়ে ওঠে প্রকাশ্য জুয়ার আড্ডা।
গ্রামের পরিবেশের এ পরিবর্তন নিয়ে কথা বলেছিলাম দুই প্রজন্মের দুই আলেমের সঙ্গে। যাদের একজন মাওলানা নজরুল ইসলাম। সিরাজগঞ্জ রেলওয়ে মাদরাসার প্রিন্সিপাল মধ্যবয়সী এ আলেম বেড়ে উঠেছেন গ্রামের চিরচেনা আবহে।

মাওলানা নজরুল ইসলামের কাছে জানতে চেয়েছিলাম আপনার শৈশবে দেখা গ্রাম এবং আজকের গ্রামের পার্থক্য কেমন? উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমাদের শৈশবের গ্রামের সঙ্গে এখনকার গ্রামের পার্থক্য অনেক। সবকিছুতেই পার্থক্য তৈরি হয়েছে। আমাদের সময় গ্রাম ছিলল ঠিক গ্রামের মতোই। রাস্তাঘাট ও যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল না, মানুষ তুলনামূলক অনেক গরিব ছিল এবং শিক্ষার হারও ছিল অনেক কম। দ্বীনি শিক্ষারও তেমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না।’
আর দ্বীনদারির ক্ষেত্রে? ‘দ্বীনদারির ক্ষেত্রেও মানুষের অবস্থা খুব ভালো ছিল না। মানুষ না জেনে অনেক শিরক ও বিদআতে লিপ্ত হতো। দ্বীনের ব্যাপারে অজ্ঞতা ছিল চরম পর্যায়ে। তবে হ্যাঁ, মানুষের মধ্যে দ্বীনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ছিল, ভালোবাসা ও আন্তরিকতা ছিল, না জানলেও তারা দ্বীন পালনের চেষ্টা করতো সব সময়। বিশেষত মান্যতা ও শালীনতা ছিল গ্রামের সাধারণ শোভন।
আমাদের সময় গ্রামের রাস্তায় দিনের বেলা মেয়েদের দেখাই যেত না। নারীরা সাধারণত রাতেই চলাফেরা করত। এখন গ্রাম আর গ্রাম নেই। গ্রামের মানুষগুলো এখন চলতে চায় শহরের মতো করে। চাল-চলন, আচার-আচরণ সবকিছুতেই কেমন যেন ধর্মহীনতার গন্ধ ছড়াচ্ছে।’ উত্তর দেন মাওলানা নজরুল ইসলাম।
মাওলানা নজরুল ইসলামের মতে নেতিবাচক এ পরিবর্তনের জন্য প্রধানত দায়ী টিভি ও মোবাইল ফোন। তিনি বলেন, ‘মোবাইল ফোনে কী নেই? পাপের সব আয়োজন আছে তাতে। আর টিভি দেখে দেখে মানুষ টিভির মতো হতে চায়। হওয়ার চেষ্টা করে। পাপ কাজ শেখে, অন্যকে শেখায়।’
তরুণ আলেম মাওলানা ইলিয়াস জাবের। মানিকগঞ্জ ফতেহপুর মাদরাসার শিক্ষাসচিব ও ফতেহপুর জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব। পরিবর্তিত সমাজে বেড়ে ওঠা এ নবীন আলেম সামাজিক পরিবর্তনের অন্যতম সাক্ষী। তিনিও মনে করেন, গ্রামীণ পরিবেশ থেকে দ্বীনদারি ও শিষ্টাচার চলে যাচ্ছে টিভি, ইন্টারনেট ও মোবাইলের কারণেই।
গ্রামীণ জীবনে সামাজিক অবক্ষয়ের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে তরুণ প্রজন্মের উপর। উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েরাই বেশি অনুকরণপ্রবণ হয়। তারা তাদের ব্যক্তিজীবনে তাদেরই অনুসরণ করার চেষ্টা করে যারা তাদের চোখে নায়ক বা আদর্শ। সে সিনেমার নায়কও হতে পারে আবার খেলাধুলা বা অন্যকিছুর নায়কও হতে পারে। অনুকরণের এ প্রবণতা দেখা যায় সবকিছুতেই। খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে শুরু করে পারস্পরিক আলাপচারিতায়ও দেখা যায় এর প্রভাব।

মাওলানা ইলিয়াস জাবের তরুণ প্রজন্মের কিছু পরিবর্তনও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আপনি দেখবেন, এখন গ্রামের ছেলে-মেয়েরা গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকে। ঘুম থেকে ওঠেও দেরি করে। ফজরের নামাজ ও সকালের মক্তবে আসতে পারে না অধিকাংশ। চলাফেরায়, পোশাক-আশাকেও তাদের ঔদ্ধত্ব প্রকাশ পায়। শিষ্ট-শালীন-ভদ্র জীবন থেকে তারা দূরে চলে যাচ্ছে দিন দিন। গ্রামের ছোট ছোট বাচ্চারাও ধূমপান করছে, বিভিন্ন নেশায় আসক্ত হচ্ছে; এমনকি আপনি দেখবেন, সাধারণ এক বোতল পানিও পান করছে মদ খাওয়ার ভঙ্গিতে ‘
এ বিষয়ে মাওলানা নজরুল ইসলাম বললেন অন্যকথা। তার মতে, শুধু তরুণ প্রজন্ম নয় গোটা সমাজই এর অবক্ষয়ের শিকার। সমাজের সব স্তরের, সব বয়সী মানুষের উপরই এর প্রভাব পড়ছে। উদাহরণ টেনে বলেন, ‘এই যে গ্রামে প্রেম-পরকীয়ার ব্যধি ছড়িয়ে পড়েছে, ঘরে ঘরে অশান্তি, ঘর ভাঙছে মানুষের সেখানে আপনি সব ধরনের মানুষ পাবেন। এসব হচ্ছে কারণ আজ কোথাও পারিবারিক অনুশাসন নেই, নিজের মধ্যে ও পরিবারের মধ্যে লজ্জা-শরমের বালাই নেই। অনেকে মনে করেন পর্দা-শালীনতা বাইরের জন্য। কিন্তু পরিবারের মধ্যেও মার্জিতভাবে জীবনযাপন করতে হয়। না হলে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে।’
গ্রামের রক্ষণশীল পরিবেশে এমন পরিবর্তন কিভাবে সম্ভব হলো? মাওলানা ইলিয়াস জাবের বলেন, ‘পরিবর্তনটা আসে ধীরে ধীরে। সহজে চোখে পড়ে না। যখন চোখে পড়ে তখন এত বেশি মানুষ অভ্যস্ত হয়ে যায় যে তা রোধ করা যায় না। তাছাড়া আগে সমাজের প্রবীণরা নবীনদের শাসন করত, অন্যায় কাজে বাধা দিত। কিন্তু দেখা যায় বড়রা নিজেরাই পাপকাজে লিপ্ত হয়ে পড়ছে। তারা কিভাবে ছোটদের শাসন করবে?’
মাওলানা নজরুল ইসলাম এ প্রশ্নের উত্তরে কিছুটা আত্মসমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদেরও (আলেমসমাজ) অনেক অমনোযোগিতা আছে। আমরাও মানুষকে দ্বীনের পথে আনার জন্য যথাযথ সময় ও শ্রম দিচ্ছি না। যেখানে দ্বীনের মেহনত আছে সে সমাজের চিত্র কিন্তু এখনও ভিন্ন। আমাদের মধ্যে উদ্যোগী ভূমিকা রাখার মতো লোক তো চোখে দেখছি না।’
গ্রামের মসজিদ-মাদরাসাসহ দ্বীনি প্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিক অবক্ষয় রোধে কেন ভূমিকা রাখতে পারছে না? এর উত্তরে মাওলানা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রামের দ্বীনি প্রতিষ্ঠানগুলোর চেষ্টা আছে, আন্তরিকতা আছে, অনেক ক্ষেত্রে তারা সফলও হচ্ছে। আবার ব্যর্থও হচ্ছে। এবং ব্যর্থতার পরিমাণটা বেশি। কারণ, যারা গ্রামে দ্বীনি খেদমতে থাকেন তাদের অনেকেই গঠনমূলক কাজের যোগ্যতা রাখেন না। তাদের সঠিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণের অভাব আছে। আমি গ্রামের অনেক ইমামকে দেখেছি তারা জ্ঞানগত অপূ্র্ণতার কারণে আধুনিক বিষয়ে মুখ খুলতে চান না। তারা ভাবেন, কী বলতে কী বলবো আর বিপদে পড়ে যাবো।
মাওলানা নজরুল ইসলাম গ্রামীণ জীবনের নির্মল আবহ রক্ষায় তিনটি প্রস্তাব দেন। ১. গ্রামে দায়িত্বরত আলেমদের যোগ্যতা বাড়াতে সভা-সেমিনার ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। তাদেরকে সচেতন করে তোলা।
২. আলেমদের ছোট ছোট আঞ্চলিক ঐক্য গড়ে তোলা এবং যেকোনো সামাজিক অন্যায় ও দ্বীনি সমস্যার সমাধানে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা রাখা।
৩. জাতীয় পর্যায়ের আলেমদের এ বিষয়ে উদ্যোগী হওয়া। ওয়াজ, মাহফিল ও দ্বীনি মজলিসে সামাজিক অবক্ষয় নিয়ে আলোচনা করা।’
মাওলানা ইলিয়াস জাবেরের একটি কথা দিয়েই শেষ করছি। তিনি বলেন, ‘গ্রামের আদি আবহে যে পাপমুক্তির স্বস্তি ছিল, সামাজিক জীবনের সুখ ছিল; সেগুলো সামাজিক রীতি-নীতিতে মিশে থাকা ইসলামি মূল্যবোধের কারণেই ছিল এবং সে মূল্যবোধ রক্ষা না করলে যে সামাজিক বন্ধন মূল্যহীন হয়ে পড়বে সে কথাটাই সমাজের মানুষের কাছে তুলে ধরতে হবে। তারা যদি এ সত্যটি অনুধাবন করতে পারে, তবে সামাজিক অবক্ষয় রক্ষা করা যাবে। ইনশাআল্লাহ!’
