শরীফ মুহাম্মদ ।।
তাকে একনামেই সবাই চিনত। প্রিন্সিপাল হাবীবুর রহমান। সিলেট কাজীর বাজার মাদরাসার প্রিন্সিপাল। সময়ের সঙ্গে জড়িত ইসলামের বহু আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি অকুতোভয়ে সামনে এসেছেন। লড়াই করেছেন। রাজপথে নেমেছেন। নেতাকর্মী ও ইসলামপ্রেমী মানুষদের সংগঠিত করেছেন। আওয়াজ উঠিয়েছেন। সিলেটের রাজপথে, সিলেটের মাটিতে। জাতীয় অঙ্গনের বহু দ্বীনি ইস্যুতেও তাঁর জাতীয় ও আঞ্চলিক অংশগ্রহণ দেশব্যাপী স্পন্দন ও আলোচনার ঝড় তুলেছে। বারবার, বরাবর। এই উনসত্তর বছরের মহীরূহ বৃহস্পতিবার (১৮ অক্টোবর) দিনশেষে রাত সাড়ে বারোটায় ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
আশির দশকের শুরুতে হজরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর সঙ্গে খেলাফত আন্দোলনের সঙ্গে ইসলামি রাজনীতির অঙ্গনে কাজ করেছেন। এরপর শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.-এর সঙ্গে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসে যুক্ত হয়েছেন। একপর্যায়ে এই দলের আমির মনোনীত হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি দলটির সঙ্গে থেকেই ইসলামের রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর অবদান রেখে গেছেন।
তার সঙ্গে আমার আরও আগে থেকেই হয়তো পরিচিত হওয়া উচিত ছিল। অথবা দেখা-সাক্ষাৎ শুরু হওয়ার পর আরো অনেকবার তার সঙ্গে দেখা হওয়ার দরকার ছিল। হয়নি। কিন্তু কয়েক বছর আগে হজরত নূরুদ্দীন গহরপুরী রহ.-এর স্মারকগ্রন্থের কাজে যখন তার স্মৃতিকথা নেওয়ার জন্য গেলাম, আন্তরিক সম্ভাষণ ও আপ্যায়নে তিনি মুগ্ধ করলেন। সাক্ষাৎকারটির ব্যবস্থা করেছিলেন হজরত গহরপুরীর সাহেবজাদা মাওলানা মুসলেহুদ্দীন রাজু। তিনিও সঙ্গে ছিলেন। যখন আমরা তার সামনে বসা, তার কয়দিন আগে তিনি কারাগার থেকে মুক্ত হয়েছেন। শান্ত ও স্থিরভঙ্গিতে স্মৃতিকথা বলছিলেন। আমরা শুনছিলাম। বৈঠকী সেই বসার পর সময়ে সময়ে তুমুল সাড়া জাগানো এই ব্যক্তিত্বের সামনে আর বসা হয়নি। সেই স্মৃতির সৌরভ আমার বুকে জমে আছে।
তাকে আমরা সবচেয়ে বেশি শুনেছিলাম ১৯৯৪-এর নাস্তিক-মুরতাদ বিরোধী আন্দোলনের সময়। তসলিমা নাসরিনের অপকর্ম ও অপরচনার বিরুদ্ধে সিলেটে তিনি আন্দোলনের প্লাবন সৃষ্টি করেছিলেন । হুঙ্কার ও চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন। ঢাকার রাস্তায় মিছিল করতে থাকা আমাদের কানে সেসব কথা এসে পৌঁছত তখন। দৈনিক পত্রিকায় আগের দিনের খবর পরের দিন পাওয়ার যুগ চলছিল। আমরা পত্রিকার পাতায় সিলেটের হরতাল ও আন্দোলনের ছবি দেখতাম। তার সেই তুখোড় সময়ের কথা আমার স্মৃতিতে আজও অক্ষত।
সিলেটে তার বহু ছাত্র ও ছাত্রতুল্যদের মুখে তার কথা শুনেছি। রাজনীতি ও লেখালেখিতে বিচরণশীল বহু তরুণ আলেমের মুখে দ্বীনি ইস্যুতে তার অনমনীয়তার চর্চা হয়েছে। মুগ্ধ হয়ে সে-সব শুনেছি ও দেখেছি। নব্বই ও শূন্য দশকে ঢাকার বাইরে বাংলাদেশের যে দুয়েকজন মানুষ ইসলামের কোনো আন্দোলনে গোটা জনপদকে জাগ্রত করতে ভূমিকা রেখেছেন, আসলে তিনি ছিলেন তাদেরই অন্যতম। তার রাজনীতি চর্চার মূল বিষয়টিও ছিল ইসলামকেন্দ্রিক বিভিন্ন আন্দোলন ও জাগরণের জায়গা তৈরির একটি ধারাবাহিক চেষ্টা।
এই মানুষটিই চলে গেলেন গতরাতে। গণমাধ্যমে দেখেছি, বিভিন্ন ইসলামি দল ও আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে বাণী দিয়েছেন। দেশ-বিদেশ থেকে অনেকেই দোয়া ও শোক প্রকাশ করেছেন। আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি এরশাদের জাতীয় পার্টির সঙ্গে তার দলের একটি ঐক্য হয়েছে। এরশাদ সাহেবও শোক প্রকাশ করেছেন।
এই মানুষটির জন্য আমাদের শোক ও দোয়া। আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন। আল্লাহ তাআলা এই শংকা ও সঙ্কটপূর্ণ সময়ে একে একে চলে যাওয়া এমন ব্যাঘ্রপুরুষদের শূন্যতা আমাদের অঙ্গন ও দেশে পূরণ করে দিন।
