কুরআন হেফজের সঙ্গে সেক্যুলার শিক্ষা!

মুহাম্মাদ আদম আলী   ।।  

এক

শনিবার। এক সরকারি বড় কর্মকর্তার ফোন পেয়ে দুপুরের ঘুম ভেঙে গেল। চাকরিজীবীরা দুপুরে ঘুমান না। অফিসে থাকেন। বেকারদের কথা তাদের মনে থাকে না। বেকারদের সময়ের ঠিক নেই। যখন-তখন ঘুমানো বাতিক হয়ে যায়। অসময়ে ফোন এলে পরিচিত কণ্ঠও অচেনা লাগে। আমি তার কণ্ঠও চিনতে পারলাম না। ভদ্রলোক আমার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলছে যেন আমি তার পড়শী। আমিও একই তালে কথা বলে গেলাম। চিনলাম না। তবে তার আবদার রাখলাম। তিনি প্রফেসর হজরতের সঙ্গে একটি জরুরি পরামর্শ করতে চান। এজন্য একটা প্রোগ্রাম ঠিক করে দিতে হবে। তিনি খুলনা থেকে আসবেন। পরামর্শ করে আবার ফিরে যাবেন।

হজরতকে ফ্রি পাওয়া এখন কঠিন। ফজরের নামাজে দেখা হয়। তখন এত মানুষ ঘিরে ধরে, কথা বলাই মুশকিল। মানুষের ভীড় ঠেলে তিনি গাড়িতে উঠেন। তারপর বাসায় গিয়েই অন্দরমহলে ঢুকে পড়েন। ডাক্তার সাহেব তাকে খুব বেশি বিশ্রাম নিতে বলেছেন। বিশ্রামে তার কোনো আগ্রহ নেই। সারাদিন বিভিন্ন প্রোগ্রামে দৌড়াদৌড়ি। রাতেও তেমন ঘুমান না। ইদানিং প্রায় দিনই রোজা রাখছেন। এজন্য ফজরের পরে বাসায় গিয়েই শুয়ে পড়েন। আমি পরদিন হজরতকে ফজরের নামাজের পরই ভদ্রলোকের কথা বলব বলে ঠিক করে রাখলাম।

রাতে আবার ভদ্রলোক ফোন করলেন। এবার আমি তাকে চিনতে পারলাম। পুরোনো কলিগ। অনেক কথা হলো। তার দুই ছেলে। মাদরাসায় পড়ে। তানযীমুল উম্মাহ মাদরাসা। সারাদেশেই এর শাখা রয়েছে। প্রথমে ঢাকায় ভর্তি হয়েছিল। সেখান থেকে খুলনা। এখন ছেলেরা আর মাদরাসায় পড়তে চাচ্ছে না। স্কুলে পড়ার বায়না ধরেছে।

তিনি ছেলেদের হাফেজ বানাতে চেয়েছিলেন। একই সাথে ইংরেজি-বাংলাও শেখানোরও আগ্রহ ছিল। এজন্য এরকম একটা মাদরাসায় ভর্তি করিয়েছেন। এখনো তারা হাফেজ হয়নি। এজন্য স্কুলে পড়াতে তার কোনো আগ্রহ নেই। এ বিষয়েই হজরতের সঙ্গে পরামর্শ করতে চান। এখন তিনি কী করবেন?  

পরদিন সকালে হজরতের সঙ্গে কথা হলো। ভদ্রলোকের ব্যাপারে বিস্তারিত বললাম। তিনি সময় দিলেন। আগামী সোমবার। সকাল এগারোটায়। ভদ্রলোককে জানিয়ে দিলাম। তিনি পুরো পরিবার নিয়ে আসবেন। ঢাকায় কোথাও রবিবার রাতে থাকবেন। সোমবার সকালে উত্তরায় হজরতের বাসায় এসে উপস্থিত হবেন।

আরও পড়ুন : কুরআন হেফজের সঙ্গে সেক্যুলার শিক্ষা! (শেষ পর্ব)

দুই

সোমবার। সকাল এগারোটা বেজে গেছে। ভদ্রলোকের কোনো সাড়া-শব্দ পাচ্ছি না। মাদরাসার দিকে গেলাম। গিয়ে শুনি তিনি সপরিবারে সময়মতো এসে হাজির হয়েছেন। হজরতের মেহমানখানায় বসে আছেন। আমি এ প্রোগ্রামে থাকতে চাই। হজরত নিশ্চয়ই আমাকে থাকার সুযোগ দিবেন। বেরও করে দিতে পারেন। লোকটা ব্যক্তিগত ব্যাপারে পরামর্শ করতে এসেছেন। আমি গেলাম। হজরত তখনো আসেননি।

একটু পর হজরত এলেন। আমাকে বসতে বললেন। বসলাম। ভদ্রলোক তার দুই ছেলেকে নিয়ে পাশে বসলেন। হজরতের সঙ্গে কথা শুরু  হলো : 

: আসসালামু আলাইকুম স্যার।

: ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আপনার সঙ্গে কি আমার আগে দেখা হয়েছে?

: জি স্যার। ঢাকায় পোস্টিং থাকতে অনেকবার সোমবারের মাহফিলে এসেছি।

: আমার কিছু মনে থাকে না। বসেন। বলেন, কী জন্য এসেছেন?

: আমার দু-ছেলে তানযীমুল উম্মাহ মাদরাসায় দিয়েছিলাম। এখন তারা আর মাদরাসায় পড়তে চাচ্ছে না। স্কুলে পড়তে চাচ্ছে।

: ন্যাচারাল আউটকাম (যা স্বাভাবিক, তা-ই হয়েছে)। আদম আলীর সঙ্গে পরিচয় থাকতে এ ভুল কেন করলেন? কতদিন ধরে পড়ছে?

: সাড়ে তিন বছর।

: পুরো সাড়ে তিন বছর নষ্ট করলেন। হেফজ হয়েছে কতখানি?

: বড় ছেলের ৬ পারা। আর ছোটটার ৫ পারা।

: আমাদের এখানে কিছুদিন আগে চৌদ্দ মাসে এক ছেলে হাফেজ হয়ে গেছে। স্বাভাবিক মেধার ছাত্রদের দু-তিন বছর লাগে।

তারপর হজরত তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু কথা বললেন। ভদ্রলেকের স্ত্রী ডাক্তার। এখন এফসিপিএস করছেন। পার্ট-১ শেষ করে পার্ট-২ পড়ছেন। পার্ট-২ খুব কঠিন। এজন প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়। চাপও বেশি। ফ্যামিলিকে স্বভাবতই সময় বেশি দিতে পারেন না। আর ভদ্রলোকও অফিসের কাজে সারাদিন ব্যস্ত। দু-জনের চাকরির মনোভাব ও আর পার্থিব চাহিদা ছেলেদের উপর প্রভাব ফেলেছে। এদিকে দ্বীনদারীর যেটুকু প্রভাব ছিল, তা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের কারণে পূর্ণতা পাচ্ছে না। একটা জগাখিচুরী অবস্থা। কোনোদিকেই সুবিধা করতে পারছেন না। শেষমেষ দুনিয়া-আখেরাত দুটোই খোয়াতে হয় কিনাভয় পেয়ে গেছেন।

হজরতের সঙ্গে আগে থেকে পরিচয় ছিল। এজন্য উপায়ন্তর না দেখে পরামর্শ করতে এসেছেন। তবে যখন পরামর্শ প্রয়োজন ছিল, তখন আসেননি। এখন দেরি হয়ে গেছে। তবু ইসলামে দেরি বলে কিছু নেই। ফিরে আসার সময় সবসময় খোলা। এখনো যদি বুঝ এসে থাকে, ভালো। হজরত সে উদ্দেশেই কথা বললেন।

তারপর তিনি তার স্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলার প্রয়োজন অনুভব করলেন। এ ধরনের সিদ্ধান্তে স্ত্রীর প্রভাব থাকেই। হজরতের তৃতীয় ছেলে মাওলানা আরীফুর রহমান কাছেই ছিলেন। তিনি তাকে বললেন, তুমি তার স্ত্রীর সঙ্গে পর্দার আড়াল থেকে কথা বলার ব্যবস্থা কর। আমি কথা বলব।

: আব্বা, ফোনে কথা বলতে পারেন। ফোন করব?

: না। পর্দার আড়াল থেকে কথা বলব। আমি তো ফোনে আমেরিকায়ও বয়ান করেছি। এতে তেমন ফায়দা হয় না। সরাসরি কথা বলার ফায়দা বেশি। সোহবতের একটা গুরুত্ব আছে।

: জি আব্বা। আমি ব্যবস্থা করছি।

পর্দার আড়ালে ভদ্রলোকের স্ত্রীকে বসানো হলো। সঙ্গে হজরতের স্ত্রীও বসলেন। এমনই হয়। যখন কোনো মহিলা হজরতের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চান, তখন পর্দার আড়ালে হজরতের স্ত্রীর সঙ্গেই মহিলারা বসেন। পর্দার এপাশ থেকে হজরত কথা বলেন। তারা শোনেন।

 

তিন

আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। পর্দার এক পাশে মহিলারা বসেছেন। আরেক পাশে হজরতের সঙ্গে আমি, ভদ্রলোক ও তার দুই ছেলে। হজরত কথা বলা শুরু করলেন :

আমি অসুস্থ। পারকিনসন ডিজিসের কারণে অনেক ওষুধ খেতে হয়। কোনো একটা মেডিসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় জিব বেরিয়ে আসে। এজন্য কথা স্পষ্ট হয় না। ভাঙাচোরাভাবে দু-একটা কথা বলছি।

আল্লাহ তাআলা বলেন,(অর্থ)মনে করিয়ে দাও। নিশ্চয়ই মনে করিয়ে দেওয়া আমার ঈমানদার বান্দাদেরকে উপকৃত করবে।

এটি সুরা যারিয়ার আয়াত। আল্লাহ তাআলা এ কথা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলছেন। ভালো কথা, আল্লাহর কথা, রাসুলের কথা মানুষকে শোনাও। বান্দাদের তা শোনালে, তাদের মনে করিয়ে দিলে তা তাদের উপকৃত করবেই। ব্যাপারটা পুরোপুরি মনে করিয়ে দেওয়া। আর পুরোনো কথাই মনে করিয়ে দেওয়া হয়। আমিও এই আয়াতের অনুকরণে আপনাকে কিছু কথা মনে করিয়ে দেব।

আপনার ছেলেদের কুরআন হেফজ করা ভার্সাস তাদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা প্রসঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। আল্লাহ তাআলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন কীভাবে? আপনি তো ডাক্তার। আমার চেয়ে ভালো জানেন। মেয়েদের ওভাম শত শত। মাত্র একটি ওভাম প্রয়োজন হয়। পুরুষের শুক্রাণু আছে লক্ষ লক্ষ। মাত্র একটি প্রয়োজন। মায়েদের একটি ওভাম আর পুরুষের একটি শুক্রাণু মিলে হয় নুতফা।

নুতফার ডায়ামিটার কত? ১০/১ মিলিমিটার। মানে এক মিলিমিটারের দশ ভাগের এক ভাগ। কত ছোট! বলপয়েন্ট কলমের নিব দিয়েও আপনি এত ছোট ফোঁটা দিতে পারবেন না। সোনামুখী সুঁই দিয়ে হয়তো পারবেন। ওইখান থেকে আমাদের শুরু। আল্লাহ তাআলা সুরা মুমিনে বিস্তারিতভাবে এ বিষয়টি বলেছেন।

আমরা দুনিয়ার চারিদিকে যা দেখি তা দেখেই প্রভাবিত হয়ে যাই। সাহাবায়ে কেরাম তো এভাবে দ্বীন পালন করেননি। তারা পুরো সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। সারা মক্কা ছিল তাদের বিরুদ্ধে। আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর মতো সম্মানিত ব্যক্তিমক্কার লোকেরা তাকে ভালোবাসত, শ্রদ্ধা করততাকেও মার খেতে হয়েছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বাঁচাতে গিয়ে কাফেররা তাকে এত মার মেরেছে যে, তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। কিসের বিরুদ্ধে তাদের এভাবে লড়াই করতে হয়েছে? অবিশ্বাস, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে।

এই জমানায় আমরা যারা ছেলে-মেয়েদের কুরআনের হাফেজ বানাতে চাই, তাদের মনে কেবলই আসে, বাচ্চারা খাবে কী করে? এটা আল্লাহ রহস্য করে রেখেছেন; দেখি আমার বান্দারা কী করে। তাদের একটু পরীক্ষা করে দেখি। তিনি আমাদের বিবেক-বিবেচনার দিকে ইশারা করেছেন। আমাদের কোত্থেকে বানিয়েছেন তিনি? কুরআনে বার বার বলেছেন,(অর্থ) মানুষ কি ভেবে দেখে না তাকে একটি ফোঁটা থেকে তৈরি করেছি আমি। সে প্রকাশ্যে ঝগড়া করে। মানুষ কি একটু চিন্তা করে না কি থেকে তাকে বানিয়েছি আমি? তারপর সে আমার সঙ্গে অহংকার করে। পুনরুত্থানকে অবিশ্বাস করে। জান্নাত-জাহান্নামকে অস্বীকার করে।

আপনি বলতে পারবেন, একজন মায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব কী? (পর্দার আড়াল থেকে ভদ্রলোকের স্ত্রী বললেন, সন্তান লালন-পালন করা।) বাচ্চাদের লালন-পালন করা তো সহজাত। কিন্তু তার আসল দায়িত্ব কী? মাওলানা আশরাফ আলি থানভি রহ. কুরআন মাজিদের একটি আয়াতের উদ্ধৃতি দেন। আল্লাহ বলেন,(অর্থ) তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও।

আল্লাহর চিহ্নগুলোর মধ্যে একটি চিহ্ন হচ্ছে আমাদের স্ত্রীগণ। স্ত্রীর কর্তব্য হচ্ছে স্বামীকে শান্তি পৌঁছানো। রান্না-বান্না করাও না। লালন-পালন করাও না। বাচ্চা লালন-পালনের জন্য দাঈ রাখতে বলা হয়েছে। যে কোনো মায়ের প্রধান কাজ হচ্ছে, স্বামীর দেখভাল করা (Of any mother, her only duty is to look after her husband)। সমাজে এ কথার কি কোনো দাম আছে? আধুনিক লোকেরা এ কথা শুনলে হাসে।

(আগামী পর্বে সমাপ্য)

পূর্ববর্তি সংবাদকুষ্টিয়ার মিরপুরে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত ২৫
পরবর্তি সংবাদঅমৃতসরের ট্রেন দুর্ঘটনা, নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৬০