অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা দিন

ইয়াসির পীরজাদা  ।। উর্দু থেকে অনুবাদ করেছেন দিলাওয়ার হোসাইন

অক্সফোর্ড আমার অত্যন্ত পছন্দনীয় একটি শহর। এমন  শহর সম্পর্কে কলম ধরা খুবই জটিল বিষয়। কোথা থেকে লেখা শুরু করব, বুঝে উঠতে পারি না।

যেদিন আমরা অক্সফোর্ড পৌঁছি সেদিনটি ছিল ফ্রেশারের প্রথম দিন। অক্সফোর্ডে নতুন ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের ফ্রেশার বলা হয়। একদিকে লক্ষ্য করলে আমরাও ফ্রেশার। পার্থক্য শুধু আমরা কোনো কলেজে ভর্তি হইনি।

অক্সফোর্ড কয়েকটি কলেজের সমষ্টি। এটাকেই অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি বলা হয়। কয়েক বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে অক্সফোর্ডের মালিকানাধীন এলাকা। সেখানকার সমস্ত সম্পদের আয় অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফান্ডে জমা হয়।জগদ্বিখ্যাত বড় বড় বিজ্ঞানী এবং নেতা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিপ্রাপ্ত।

এই কলেজসমূহের ইতিহাসও খুবই চমকপ্রদ। অজ্ঞতার যুগে ইংল্যান্ডের গোত্র এবং খ্রিষ্টানধর্মের ধর্মীয় প্রধানরা ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে অক্সফোর্ড এলাকায় একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এই কলেজগুলোকে তাই খ্রিষ্টান মাদরাসা বলা যেতে পারে। যেমন বর্তমানে আমাদের দেশে বিভিন্ন মতাদর্শের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজেদের মতাদর্শের যুবকদের পাঠদান করে থাকে।

সেই রকমই অক্সফোর্ডের কলেজগুলো বিভিন্ন মতাদর্শের শিক্ষা প্রদান করতো। সেখানে জাগতিক শিক্ষাও দেওয়া হতো। এই কলেজসমূহে স্থাপিত স্কুলগুলোর নাম আজও  ল্যাটিন ভাষায় তাই আছে যা কয়েক শ বছর পূর্বে ছিল। কলেজের ব্যাজও তেমনটি আছে যা ওই ধর্মীয় গোত্রগুলোর ছিল। এই ব্যাজেও পরিবর্তন করা হয়নি।

আপনি যে কলেজের প্রবেশপথ দিয়েই ভেতরে আসবেন আপনার কাছে মনে হবে স্বপ্নের কোনো আঙ্গিনায় আপনি এসে পড়েছেন। প্রতিটি কলেজের স্থাপনার গায়ে প্রাচুর্যের চিহ্ন। তাতে পর পর আরো কয়েকটি স্থাপনা আছে। সবুজ শ্যামল সতেজ ঘাসের মাঠ। কিন্তু ঘাসের উপর পা মাড়ানো নিষেধ। কোনো শিক্ষার্থীর এই দুঃসাহস নেই যে সে ঘাসের উপর পা মাড়াবে। তবে শিক্ষার্থীরা যেদিন শিক্ষা সমাপন করে চলে যায় সেদিন ইচ্ছেমত ঘাস জুতোর তলায় পিষ্ট করে। এটা এক ধরণের ইতিহাস।

কলেজের স্থাপনাসমূহের ফটক বাইরে থেকে ততটা বড় মনে হয়নি। মনে হয়েছিল, হয়তো ভেতরে কয়েকটি রুম আর এক আধটি হলরুম হবে। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করে দেখলাম, ভেতরে বিশাল পৃথিবী আবাদ হয়ে আছে।

প্রতিটি কলেজে একটি চার্চ রয়েছে। কোনো এককালে এখানে শুধুমাত্র খ্রিষ্টানরা উপাসনা করার সুযোগ পেত। কিন্তু বর্তমানে এ রুমকে নীরব কক্ষ বলা হয়। এখানে সব ধর্ম ও মতাদর্শের লোকেরা নিজেদের ধর্মমত অনুযায়ী উপাসনা করতে পারে।

বিগত রমজানে কয়েকটি স্থানকে মুসলিম শিক্ষার্থীরা সাহরি ও ইফতারের জন্য ব্যবহার করেছে। এ কলেজ যেহেতু শুরুতে ধর্মীয় বিদ্যালয় ছিল এজন্য প্রথম যুগে এখানে শুধু ছেলেদের ভর্তি করা হতো। পরবর্তীকালে ইংল্যান্ড যখন অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ অতিক্রম করে তখন এ প্রতিষ্ঠানে জাগতিক শিক্ষার হার বৃদ্ধি পায়। মেয়েদের শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ অবারিত হয়।

এই তো, মাত্র এক শতাব্দী পূর্বে এখানে যৌথ শিক্ষাব্যবস্থার সূচনা হয়। অক্সফোর্ডে এ ঘটনার স্মরণে আনন্দ অনুষ্ঠান উদযাপন করা হয়।

অক্সফোর্ডের প্রসিদ্ধ স্থান ব্রড স্ট্রিটে গেলে সেখানকার সড়কে ক্রসচিহ্ন এবং একটি স্মৃতিসৌধ দৃষ্টিগোচর হয়। যাকে স্মৃতিসৌধ বলে ডাকা হয়। এটা তিনজন পাদ্রীর স্মরণে তাদের মৃত্যুর তিন শ বছর পর নির্মাণ করা হয়েছে। এই প্রোটেস্ট্যান্ট পাদ্রীদেরকে নিজেদের ধর্মবিশ্বাসের কারণে রোমান ক্যাথলিক রাণী মেরির সময়ে ১৫৫৫-৫৬ খ্রিষ্টাব্দে এই স্থানে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। ভাবতে অবাক লাগলেও এটাই অক্সফোর্ড।

অক্সফোর্ডে অগণিত চার্চ রয়েছে। কিন্তু মসজিদ মোটে পাঁচটি। গির্জা বিরান পড়ে থাকে কিন্তু মসজিদগুলো আবাদ। ভরপুর থাকে মুসল্লিতে। এর মধ্যে একটি মসজিদ সালাফিদের। একটি শিয়াদের। একটি বেরলভিদের। একটি বাংলাদেশি মুসলিমদের। আর একটি কোনো এক আরব রাষ্ট্রের।

অক্সফোর্ডে অনেক মুসলিমের বসবাস। এর মধ্যে দু’চারজন তো বিলিয়নিয়ার। যাদের কয়েকটি করে বাড়ি রয়েছে। তারা সে বাড়িগুলো অক্সফোর্ডকে ভাড়া প্রদান করে। যেহেতু এখানে বহির্বিশ্ব থেকে প্রতি বছর প্রায় পয়ত্রিশ হাজার শিক্ষার্থী আগমন করে, সে জন্য এখানে বসবাস খরচ খুবই ব্যয়বহুল। লন্ডনের পর এটি ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যয়বহুল শহর।

মজার ব্যাপার হলো, অক্সফোর্ড সারা পৃথিবীর শিক্ষাকেন্দ্র হওয়ার পরও এখানকার অন্যান্য সরকারি বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষামান সন্তোষজনক নয়। আর এর কারণ এই উচ্চমূল্য।  এখানকার শিক্ষাসমাপনকারীরা তৎক্ষনাৎ অক্সফোর্ড ছেড়ে অন্য কোথাও চাকরি খোঁজাকে জরুরি মনে করে। এজন্য স্কুলগুলোতে দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক পাওয়া যায় না। তবে এর অর্থ এই নয় যে আমরা এ স্কুলগুলোকে আমাদের দেশের ভগ্নদশা স্কুলের সাথে তুলনা করবো।

আপনি যদি অক্সফোর্ড অধ্যয়ন করতে চান তবে এর অসংখ্য পদ্ধতি রয়েছে। এখানকার কলেজে চান্স পেতে হলে আপনার বয়স আঠার-বিশ বছর হতে হবে এটা জরুরি নয়। আপনি যদি পূর্ব থেকে কোনো ডিগ্রি গ্রহণ করে থাকেন আর এখন চান যে ভিন্ন কোনো বিষয়ে এবং শাখায় নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করবেন তাহলে আপনার জন্য অক্সফোর্ডে ‘এ্যাকসেস টু হায়ার এডুকেশন’ প্রোগ্রাম রয়েছে।

অক্সফোর্ড একটি মনোহরী অভিনব শহর। তবে অক্সফোর্ড নির্দিষ্ট কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নয়। এটা এমন এক পরিবেশ যা আপনি আপনার চারপাশে অনুভব করতে পারেন। অক্সফোর্ড ইতিহাস এবং অতীত বর্ণনার নাম। ইংল্যান্ডে যখন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির এই কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় তখন ইংল্যান্ডের অন্ধকার যুগ। কিন্তু অক্সফোর্ডের ইমারত দেখে এবং ভেতরে স্থাপিত দর্শন ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের স্কুল দেখে মানুষের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে যে, এই ডিজাইনগুলো কি সেই সময়ের যখন ইউরোপ অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল?

সূর্য ঢলে পড়ার সময় হলো। সোনালি রোদের তাপ কমে যাচ্ছিল। আমরা হাই স্ট্রিটের একটি ক্যাফের সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে এলাম। এ বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলার ছাদে বসার ব্যবস্থা ছিল।  আমরা ছাদে বসে অক্সফোর্ড শহরের দিকে তাকালাম। সারা শহর চোখের সামনে। মনে হলো, এ যেন কোনো জাদুর শহর।

[ইয়াসির পীরজাদা পাকিস্তানের বিশিষ্ট লেখক ও কলামিস্ট। তিনি পাকিস্তানের দৈনিক জং- এ নিয়মিত কলাম লেখেন।]

পূর্ববর্তি সংবাদউন্মুক্ত জায়গায় সংবর্ধনা হচ্ছে না : হাইয়াতুল উলয়া
পরবর্তি সংবাদশরণখোলায় মাদরাসা ছাত্রের মৃত্যু