যায়েদ মুহাম্মদ ।।
হিন্দু উৎসবগুলোতে আধ্যাত্মবাদের চেয়ে উৎসবের প্রবল উপস্থিতি থাকায় তরুণ প্রজন্ম বিভ্রান্ত হচ্ছে। উৎসব বা বিনোদন তরুণ প্রজন্মের জন্য সবচে’ ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা। শক্তি সামর্থ্যে পূর্ণ উচ্ছল দিনযাপনের এই সময়ে বিনোদনের নানাধর্মী উপকরণ থেকে বেঁচে থাকা সত্যিই কঠিন। বয়সটাই যখন বিনোদনের তখন মানবিক প্রচণ্ড চাহিদা তাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করবে এই তো স্বাভাবিক।
মৌলিকভাবে বলা হয়ে থাকে, হিন্দুধর্মে মানবিক কামনাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সন্যাস ও বৈধব্যের ব্যাপক উদাহরণ টেনে এই ধরনের দাবি করা হয়ে থাকে। এই দাবি সত্য না মিথ্যা সেটা আদৌ আলাপের বিষয় হতে পারে না। বর্তমান হিন্দু উৎসবগুলো বিনোদনের নানা মাধ্যেমে পূর্ণ-এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, শাস্ত্রীয়ভাবে এর বিনোদনের কথা বলা হলেও প্রচলনে এই বিনোদনকে হিন্দুধর্মের বর্তমান অনুসারীরা অকুণ্ঠভাবে সমর্থন করে এবং এ ক্ষেত্রে তারা ধর্মের সাথে কোনরূপ সংঘর্ষ দেখতে পায় না। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে যেহেতু ভোগের নানা ধরনের প্রকার বেরিয়েছে, ফলে এই উৎসবগুলোও সেদিক থেকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ হয়েছে। এই ধরনের উৎসবগুলোতে যা হয় তার সবই জ্বলন্ত পাপের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ উৎসবের প্রধান বিষয়গুলো তো নিষিদ্ধতার অন্তর্ভুক্তই, এর বাইরে যে সব কার্যক্রম পুণ্যের আশায় না বরং উদযাপন হিশেবে করা হয় সেগুলোকেও ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। একজন মুসলিমের এই ধরনের কাজে লিপ্ত হওয়ার অনুমতি নেই। বলাবাহুল্য, এই উৎসবগুলোর কিছু বিষয় ধর্মের সাথে জড়িত আর কিছু বিষয় কেবলই পাপ হিসেবে বিবেচিত।
দ্বিতীয় শ্রেণীর কাজগুলোর ক্ষেত্র কেবল এই পূজোপার্বণ নয়; বরং একজন মুসলিম নানা সময়ে শয়তানের প্ররোচনায় এই ধরনের পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এবং কখনো কখনো অভ্যস্তও হয়ে যায়। ধর্মের সাথে জড়িত আচারগুলো তরুণ প্রজন্মের কাছে অতটা গুরুত্বপূর্ণ না। বরং নিজেদের ভোগচাহিদাকে মেটানোর জন্য যে বিষয়গুলো তারা প্রতিনিয়ত করে থাকে সেগুলোর অতি উত্তম পরিবেশ পাওয়ায় আপ্লুত হয়ে পড়ে। ভোগবাদিতার প্রবল আকাঙ্ক্ষার আড়ালে শিরকের মত একটা ভয়াবহ বিষয়ও তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়।
নিছক উদযাপন বলে তারা যে সমস্ত কাজে লিপ্ত হচ্ছে সেগুলো রীতিমত একটা শিরকি উৎসবের সহায়ক হিসেবে কাজ করে থাকে। ফলে মুসলিমদের এই অংশগ্রহণই নিঃসন্দেহে ভয়াবহ পাপের অন্তর্ভুক্ত। মুশকিল হলো, ধীরে ধীরে এই বিষয়গুলো অজান্তেই নিজেদের উৎসবের মধ্যে ঢুকে পড়ে।
সতেরো শতকের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব, সে সময়কার পরিস্থিতি ভয়ানক পর্যায়ের মন্দ ছিল। ইসলামের সাথে হিন্দুধর্মের নানা বিষয়ের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে ফেলেছিল বিভ্রান্ত মুসলিম সমাজ। এরই বিরুদ্ধে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়েছিল সে সময়কার ইসলামি ব্যক্তিত্বদের। মুজাদ্দিদে আলফে সানি থেকে নিয়ে থানভি রহ পর্যন্ত বিশাল এক কাফেলা জীবনভর মুসলিম সমাজে ছড়িয়ে পড়া শিরক বিদআতের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। তাঁদের ঐকান্তিক শ্রমের ফলেই উপমহাদেশে ইসলামের গা থেকে মুছে যায় শিরক বিদআতের গন্ধ।
বিভ্রান্ত মুসলিম সমাজ নিজেদের গাফলতি আর শিথিলতার জন্য সাংঘর্ষিক যে বিষয়গুলো ইসলামের সাথে জুড়ে দিয়েছিল সেগুলো দূর করতে কম কষ্ট পোহাতে হয়নি আমাদের পূর্বসূরীদের। অনুপম ত্যাগ আর প্রবল সহিষ্ণুতার পরাকাষ্ঠা ছিলেন তাঁরা। খুব ধীরে ধীরে অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে তাঁরা এই উপমহাদেশের মুসলিম সমাজের মন্দরূপ পাল্টাতে সক্ষম হয়েছিলেন। সন্দেহ নেই, এই উপমহাদেশে ইসলাম টিকে থাকার ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য।
আমাদের মনে রাখতে হবে, উপমহাদেশে ইসলাম বিপন্ন হওয়ার মৌলিক কারণ কিন্তু ঐ শিরক-বিদআতই। অন্য ধর্মের নানা বিষয়ের সংমিশ্রণের ফলেই ইসলাম তার প্রকৃত রূপ হারিয়েছিলো। ইসলামের প্রকৃত রূপ ফিরিয়ে আনবার জন্যই আমাদের মহান পূর্বসূরিগণ যথেষ্ট শ্রম ব্যয় করেছিলেন। বলাবাহুল্য, তাঁরা তাঁদের কার্যক্ষেত্রে সফল হয়েছেন।
বিধর্মীদের উৎসবগুলোতে না বুঝে তরুণদের অংশগ্রহণ অবশ্যই উদ্বেগজনক। এর চেয়ে দুঃখজনক এবং দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, ইসলামের উদযাপন প্রক্রিয়ার সাথে বিধর্মী উৎসবগুলোকে মিশিয়ে ফেলা। দুটোর পার্থক্য বুঝতে না পারা।
গত রোজার ঈদে বাড়িতে ফেরার পথে একটা বিষয় দেখে এর ভয়াবহতা বুঝতে পেরেছিলাম। বাস কুমিল্লা শহরে পৌঁছার পরস্থিতি দেখে থমকে যেতে হয়েছিল। স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ বসেছিলাম। বেশ কয়েকটা পিকআপ পুরো শহর চষে বেড়াচ্ছে। প্রায় সবগুলো পিকআপেই দুটো করে সাউন্ডবক্স। এত উচ্চ আওয়াজে গান চলছে যে কান পাতা দায়। বাদ্যের প্রবল আওয়াজে স্থির থাকা যায় না। শরীরের নিয়ন্ত্রণশক্তিও দুর্বল হয়ে পড়ে।
তাকিয়ে দেখি, তরুণ সম্প্রদায় বাদ্যের শক্তিতে আক্রান্ত হয়ে নানাভাবে শরীর নাচাচ্ছে। তাদের করুণ পরিস্থিতি দেখে দুঃখ হলো। এই ধরনের বিকলাঙ্গ উদযাপনে তাদের মত্ত হতে দেখে একটা অসুস্থ প্রজন্মের উপস্থিতির কথা ভেবে আঁতকে উঠতে হয়। অথচ ইসলামের উদযাপনের শিক্ষা আদতে এর কাছেও না।
অবাধ বিনোদনের ভয়াবহ পরিণতি এবং এ সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি আমরা যদি ছড়িয়ে দিতে না পারি তাহলে অল্পকাল পরেই আমাদের ঈদগুলো হয়ে পড়বে হিন্দু উৎসবের মতো। ইসলাম হারিয়ে ফেলবে তার স্বকীয়তা। পূর্বসূরীদের শ্রমের ফলে আমরা যে সমাজ পেয়েছিলাম তা আমাদের উপস্থিতিতে বিভ্রান্ত হওয়ার দায় আমরা কিছুতেই এড়াতে পারব না। নিদেনপক্ষে আমাদের ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে বিনোদনের সুযোগে যে সমস্ত ভ্রান্তি প্রবেশ করছে সেগুলোর ক্ষেত্রে আমাদের সচেতনতা অতি জরুরী।
যথার্থ পন্থা ও ভুল অবস্থান সম্পর্কে এই সম্প্রদায়কে অবগত করাতে না পারলে ব্যর্থতা আমাদের কাঁধেই এসে গড়াবে। বস্তুবাদের এই যুগে আমাদের দায়িত্ব কোনো অংশেই কম না। সর্বোপরি ব্যক্তিগত পরিশুদ্ধতার পাশাপাশি বর্তমান সমাজের সুস্থতার জন্য আমাদের প্রচেষ্টা সবসময় বিদ্যমান থাকতে হবে। আল্লাহ আমাদের মঙ্গল করুন।
