বন্দীদশায় শহুরে শিশু, কীভাবে তারা মুক্তি পাবে?

আতাউর রহমান খসরু ।।

স্কুলের অফিসকক্ষে মাথা নিচু করে আছে জিয়াদ। টেবিলে ওপাশে প্রধান শিক্ষক আর ঠিক ডানপাশের চেয়ারে বসে আছে তার মা। তার ভেতরও ভীষণ আড়ষ্ট ভাব। জিয়াদের নামে নালিশ করতেই মাকে ডেকে পাঠিয়েছেন প্রধান শিক্ষক। সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তাকে আর এ স্কুলে রাখতে চান না তিনি।

আজ জিয়াদের মাকে প্রধান শিক্ষক যা বললেন তার সারকথা এমন, বেশ কয়েকদিন ক্লাসের শিক্ষার্থীদের ব্যাগ কাটছিলো কেউ। এ পর্যন্ত প্রায় ছয়জনের ব্যাগ কাটা হয়েছে। কিন্তু কেউ দোষ স্বীকার করছিল না। আজও টিফিনের সময় একটি ব্যাগ কাটা হয়। এরপর স্যাররা সিদ্ধান্ত নেন সবার ব্যাগ তল্লাশি করা হবে। তল্লাশি করে জিয়াদের ব্যাগে কাটার খুঁজে পান তারা। অফিসে এনে জিজ্ঞাসাবাদের পর দোষও স্বীকার করেছে সে।

জিয়াদ উত্তরার নামকরা একটি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। বাবা মেরিন ইন্জিনিয়ার। মা সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা। পরিবারে অভাবের কোনো ছাপ নেই। বলা যায় প্রাচুর্যর মধ্যেই বড় হয়েছে জিয়াদ। তার কোনো চাওয়াও অপূর্ণ রাখেন না তার বাবা-মা। তবুও জিয়াদের অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে দিন দিন। স্কুলে ওর নামে নালিশ লেগেই আছে। পরিবারের মানুষদের সঙ্গেও আচরণে অসংযত সে। বাবা-মা বোঝেন না ‘না চাইতেই সব পাওয়ার’ পরও দিন দিন কেন বখে যাচ্ছে জিয়াদ!

শুধু জিয়াদ নয় শহরে বেড়ে ওঠা অনেক শিশুই দিন দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। উগ্র, অসংযত ও অসহিষ্ণু। যার ঠিক কারণ বুঝতে পারেন না অনেক অভিভাবকই। সন্তানকে একটি উন্নত ও আধুনিক জীবন উপহার দেয়ার পরও কেন তারা অসহিষ্ণু ও উগ্র হয়ে ওঠে? কেন তাদের মধ্যে বাড়ে অপরাধপ্রবণতা? ধরতে পারেন না তারা। অভাবে যদি এদের স্বভাব নষ্ট না হয়, তবে কিসে নষ্ট হচ্ছে তা? যেমন জিয়াদের মা ঠিক বুঝতে পারছেন না অন্যের ব্যাগ কেটে তার ছেলের লাভ কী। এদের সাথে তো জিয়াদের ঝগড়া নেই তো? জিয়াদ তো কারো সাথে ঝগড়া করে না। তাহলে?

বন্দীদশায় শহুরে শিশু
জিয়াদের মায়ের মতো এমন অসংখ্য মায়ের প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন এ সময়ের সমাজবিদ ও মনোচিকিৎসকগণ। তারা বলছেন, শিশুর সুস্থ বিকাশের জন্য বস্তুগত প্রাচুর্যই যথেষ্ট নয়। তাদের প্রয়োজন আনন্দময় ভুবন। ভালোবাসার সাহচর্য। কিছুটা মুক্ত ও স্বাধীন পরিবেশ। শহুরে শিশুরা ভালোবাসা ও আনন্দের প্রায় সব উপকরণ থেকেই বঞ্চিত। তাদের নেই খেলাধুলার স্বাধীনতা, তারা পায় না আত্মীয়-স্বজনের ভালোবাসা এবং প্রকৃতির সান্নিধ্য থেকেও বঞ্চিত তারা। এমনকি অনেকেই মা-বাবার ভালোবাসা থেকেও বঞ্চিত। চার দেয়ালের বন্দী জীবনই যেন তাদের নিয়তি।

উপরন্তু শহুরে শিশুর উপর চাপিয়ে দেয়া হয় প্রত্যাশা ও প্রতিযোগিতার বোঝা। জীবন বুঝে ওঠার আগেই তাদের বোঝানো হয় জীবন মানেই প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতায় তাকে বিজয়ী হতেই হবে। একাকী, বদ্ধ জীবন ও যুদ্ধ জয়ের ভয় শিশুর মানসিক বিকাশকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করছে বলে মনে করছেন মনোবিজ্ঞানীরা।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর মনে করেন, বিচ্ছিন্নতা ও একাকিত্বের কারণে শিশু একরোখা হয়ে উঠতে পারে৷ তার ভেতরে জন্ম নিতে পারে আত্মহত্যার প্রবণতা৷ আর সে জড়িয়ে পড়তে পারে নানা অসামাজিক কাজে৷

শিশুর হাতে প্রযুক্তি!
শহুরে শিশুদের অপরাধপ্রবণ হওয়ার পেছনে প্রযু্ক্তির প্রতি আসক্তিকেও দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষত সহিংস ভিডিও গেমস ও কার্টুন এবং নৈতিকতা বিবর্জিত সিনেমা-নাকটসহ বিভিন্ন ভিডিও ক্লিপস শিশুর মনস্তত্ত্বে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে বলে মনে করছেন তারা।

অন্যদিকে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও শহুরে শিশুর ক্ষুদ্র পরিসরকে আরও ক্ষুদ্র করে ফেলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরিন শিশুদের সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় হওয়ার ব্যাপারে হুশিয়ারি দিয়ে বলেন, প্রযুক্তি শিশুকে আরও বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। যা তাদের অপরাধপ্রবণ করে তুলতে পারে৷

ভবিষ্যত হারানোর ভয়ে আড়ষ্ট শিশু
শহুরে বাবা-মা নিজের অজান্তে শিশুর মনে যে ক্ষতিকর উপাদান ঢেলে দেন তা হলো ভয়। চারপাশের পরিবেশ-প্রতিবেশ ও প্রতিবেশী; এমনকি সহপাঠীদের ব্যাপারে প্রচণ্ড রকম ভয় ঢুকিয়ে দেয়া হয় তাদের ভেতর। নিজের ভবিষ্যত হারানোর প্রচণ্ড ভয়ও থাকে শহুরে শিশুর মনে। পরীক্ষার ভালো ফল না করতে পারার ভয়, ভালো স্কুলে পড়তে না পারার ভয়, ডাক্তার বা ইন্জিয়ার হতে না পারার ভয়। এসব ভয় শিশুর কোমল মনকে ক্লান্ত করে ফেলে।

ফলে আপন মনোজগতেই কুঁকড়ে থাকে শিশু। রুটিনবদ্ধ জীবনে উচ্ছ্বাস প্রকাশের যে অবসরটুকু শিশু পায় তখনও নিজেকে গুটিয়ে রাখে। এভাবে এক সময় নিজের ব্যাপারেই হীনমন্যতার শিকার হয় তারা। সন্দেহপ্রবণ ও হিংসাত্মক হয়ে ওঠে অন্যদের ব্যাপারে। ফলে সে মন খুলে হাসতে পারে না, মিশতে পারে না এবং নিজেকে সহজ করে উপস্থাপন করতে পারে না অন্যের সামনে।

আছে ইসলামি শিক্ষার অভাব
তবে ইসলামি চিন্তাবিদরা মনে করেন, শিশুর শিক্ষা সিলেবাসে ইসলামি শিক্ষার অভাব ও পারিবারিক জীবনে ধর্মীয় আবহের অনুপস্থিতিই শিশুকে অনেক বেশি বিপথগামী করছে। পারিবারিক জীবনে ইসলাম পরিপালন এবং প্রয়োজনীয় নৈতিক শিক্ষা শিশুর মানসিক বিকাশে অপরিহার্য মনে করেন তারা।

তারা উদাহরণ টেনে বলেন, একাকিত্ব ও পারিবারিক শিক্ষার অভাব শহুরে শিশুর বড় একটি সমস্যা। ইসলাম শিশুর মাকে বলছে আপনি ঘরে থাকুন! সন্তানকে সময় দিন! একজন সুস্থ-সবল ও আদর্শ সন্তানই আপনার সবচেয়ে বড় সম্পদ।

ইসলাম অভিভাবকদের বলে, আপনারা শিশুর শিক্ষা-দীক্ষার জন্য চেষ্টা করুন। এটা প্রসংশনীয়। কিন্তু মনে রাখবেন, আপনার চেষ্টা শিশুর ভাগ্যোন্নয়নে সহায়ক হবে, তা পুরোপুরি বদলাতে পারবে না। তাই শিশুর উপর বাড়তি প্রত্যাশার অমানসিক বোঝা চাপিয়ে দেবেন না।

দুর্বল থেকে যাচ্ছে শিশুর শরীর
বদ্ধ ও একাকী পরিবেশে বেড়ে ওঠা শহুরে শিশু যে শুধু মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছে তা নয়; বরং তাদের শারীরিক কাঠামোও থেকে যাচ্ছে দুর্বল। পর্যাপ্ত খেলাধুলার অভাব শিশুর শারীরিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। ইনস্টিটিউট অব জেরিয়েট্রিক মেডিসিন (আইজিএম)-এর ইনচার্জ ডা. মহসীন কবির লিমন বলেন, ‘শহুরে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক উভয় প্রকার স্বাস্থ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের উভয় স্বাস্থ্যের বিকাশে অভিভাবকের সচেতন হতে হবে।’

এজন্য তিনি প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ থেমে ৪৫ মিনিট শিশুর জন্য খেলাধুলা ও দৌড়-ঝাঁপ করার সুযোগ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘এতে শিশুর হাড়, মাংপেশী, জয়েন্টগুলো আরও বেশি সক্রিয় হয়, শক্তিশালী হয়। শিশুকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। দৌড়ঝাঁপ রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়িয়ে দেয় কয়েক গুণ। মাংসপেশীগুলো কাজ করার ফলে শিশুর ঘুমও ভালো হয়।’

‘প্রতিটি জয়েন্ট ও মাংসপেশী নড়াচড়ার পাশাপাশি রক্ত সঞ্চালনের গতি থাকে স্বাভাবিক ও বাধাহীন। ফলে ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ডের কাজ করার ক্ষমতা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। অন্যদিকে ভালো ঘুমের কারণে মস্তিষ্ক আরাম পায়। শিশুর মনমেজাজ ভালো রাখতে ও অন্যান্য কাজে মনোযোগ বাড়াতেও শিশুর পর্যাপ্ত খেলাধুলা ও দৌড়ঝাঁপের বিকল্প নেই।’ যোগ করেন ডাক্তার লিমন।

অন্যদিকে পর্যাপ্ত শারীরিক কসরৎ না করায় শিশুরা বিভিন্ন রোগ-ব্যধিতে আক্রান্ত হচ্ছে বলে মনে করেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ আবিদ হোসেন মোল্লা। তিনি বলেন, শিশুরা এখন এমন সব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, যা বয়স্কদের রোগ৷ যেমন ডায়াবেটিস ও প্রিম্যাচিউর হাইপারটেনশন।

আনন্দময় ও উচ্ছ্বল শৈশব শিশুর অধিকার। শত ব্যস্ততার মধ্যেও শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাভাবিক বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে আমাদের। তাদেরকে ফুল-পাখি ও প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিয়ে যেতে হবে। ভয় নয় তাদের মনে রোপন করতে হবে জয় করবার দুর্দান্ত সাহস। শেখাতে হবে বিশুদ্ধ বিশ্বাস ও নৈতিকতা। তার চেয়ে বেশি দিতে হবে সময় ও সান্নিধ্য। খেয়ালি নিঃসঙ্গতা যেন নীরবে হত্যা না করে শিশু ও শিশুর ভবিষ্যত।

পূর্ববর্তি সংবাদপ্রধানমন্ত্রী এবং আল্লামা শফী পরস্পরকে দিলেন উপহার
পরবর্তি সংবাদআল্লামা তাকি উসমানির ‘শায়খুল ইসলাম’ হয়ে ওঠার গল্প