বিএনপির সঙ্গে কি ইসলামি দলগুলোর দূরত্ব বেড়েছে?

আতাউর রহমান খসরু ।।  

২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয় ইসলামি ধারার অধিকাংশ দল। ইসলামী ঐক্যজোটের ব্যানারে মন্দের ভালো হিসেবেই তারা বিএনপিকে বেছে নেয়। বিএনপিও ঘোষণা দেয় তাদের ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসের কথা। নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। জোটের সুবাদে সংসদে প্রতিনিধেত্বের সুযোগ পান কয়েকজন আলেম রাজনীতিক।

কিন্তু জোট সরকারের শেষ আমলেই অস্বস্তি দেখা দেয় শরিক ইসলামি দলগুলোর মধ্যে। তাদের সঙ্গে মানসিক দূরত্ব তৈরি হয় অন্যদের। এর পেছনে কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় বি-বাড়িয়ার শহিদদের হত্যার বিচার না হওয়া, ফতোয়া বিরোধী রায়ের নিষ্পত্তি না হওয়া, কওমি স্বীকৃতির বিষয়টি চূড়ান্ত না করা, শীর্ষ ইসলামি রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে আওয়ামী সরকারের সময় করা রাজনৈতিক মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া ইত্যাদি।

চারদলীয় জোট সরকারের শেষ আমলেই জোট থেকে বের হয়ে যায় শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস এবং মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন নেজামে ইসলাম পার্টি। যদিও ভিন্ন ব্যানারে উভয় দলের একটি অংশ জোটে থেকে যায়।

এক সময় ইসলামি ধারার দলগুলোর ভেতর বিএনপিমুখী যে প্রবণতা ছিলো ফিলহাল তা আর দেখা যাচ্ছে না। বিপরীতে আওয়ামী লীগের দিকেই ঝুঁকছে অনেক ইসলামি দল। যাদের কেউ সরাসরি আওয়ামী লীগের সাথে জোট করতে চাচ্ছে আবার কেউ কেউ আওয়ামী লীগের সহযোগীদের সঙ্গে জোট করছে। ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে কি তাহলে বিএনপির দূরত্ব বাড়ছে?

ইসলামী ঐক্যজোটের সাংগঠনিক সম্পাদক মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন মনে করেন, দল হিসেবে বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব বাড়েনি ইসলামি দলগুলোর।

তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না বিএনপির সঙ্গে ইসলামি দলগুলোর দূরত্ব বেড়েছে। ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব বাড়লো কোথায়? যারা আগে ছিলো তারা এখন পর্যন্ত আছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বরং আমি বলবো, আওয়ামী লীগের কিছু ইতিবাচক কাজের কারণে তাদের ব্যাপারে ইসলামপন্থী ভোটারদের মনোভবে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। এর মধ্যে কওমি শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি অন্যতম। কারণ এর সাথে বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রত্যাশা জড়িয়ে আছে।’

কওমি শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি ভোটের রাজনীতিতে কেমন প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে এ ইসলামি রাজনীতিক বলেন, ‘ভোটারদের মনোভবে যে পরিবর্তন এসেছে তাতেও আওয়ামী লীগ খুব বেশি উপকৃত হবে বলে তিনি মনে করেন না।’

অবশ্য মুফতি সাখাওয়াত স্বীকার করেন ভোটারদের ঝোঁক পরিবর্তনের কারণে কোনো কোনো ইসলামি দলের নেতাদের মনোভবেও কিছুটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। তবে তাকে বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্যতার পর্যায়ে যাওয়া বলতে রাজি নন তিনি।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অন্যতম অংশীদার খেলাফত মজলিস। এ দলের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আহমদ আলী কাসেমীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, বিএনপির প্রতি ইসলামি দলগুলোর ঝোঁক কেন কমেছে? কোনো কোনো ইসলামি দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার আগ্রহী হলো কেন?

তিনি বলেন, ‘এ প্রশ্নের উত্তর দুটি। একটি তাদের উত্তর। আরেকটি হলো বাস্তবতা। তারা ঘরোয়া পরিবেশে আমাদেরকে যে উত্তর দেয় তাহলো, আমরা সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান করলে দল অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। আর সরকারের সাথে জোট করলে দলের অবস্থান শক্তিশালী হবে। দলের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই আমরা সরকারের সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে আগ্রহী।’

‘বাস্তবতা হলো, এসব দলের নেতারা বিভিন্ন সময় সরকারের সঙ্গে সখ্যতা গড়তে গিয়ে এমন একটি ফাঁদে পড়ে গেছে যে, তাদের আর বের হয়ে আসার উপায় নেই। হতে পারে তারা রাজনৈতিক আপসের চিন্তা থেকে এসব সুবিধা গ্রহণ করেননি।’

তবে কওমি শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি, ফতোয়া বিরোধী মামলার নিষ্পত্তি না করার মতো বিষয়গুলো যে বিএনপির ভুল ছিলো তা স্বীকার করেন নেন মাওলানা আহমদ আলী।

তার ভাষায়, ‘ক্ষমতায় থাকার সময় বিএনপি নিজের জন্য যা যা করা দরকার ছিলো তাও করেনি এবং আমাদের (ইসলামপন্থী) জন্য যা যা দরকার ছিলো তাও করেনি। সুতরাং ভুলের মাশুল বিএনপিও দিচ্ছে এবং আমরা যারা তার সাথে আছি আমরাও দিচ্ছি।’

বিএনপি কি ইসলামি দলগুলোকে এড়িয়ে যাচ্ছে? মাওলানা আহমদ আলী বলেন, ‘না। তাদের সঙ্গে দীর্ঘদিনের উঠ-বস থেকে আমাদের তেমন মনে হয় না। বরং মনে হয়, তাদের ইচ্ছে ইসলামি দলগুলো তাদের সঙ্গেই থাকুক।’

তবে বিএনপি ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে ‘অতি সখ্যতার তকমা’ থেকেও বেড়িয়ে আসার চেষ্টা করছে বলে মনে করেন এই আলেম রাজনীতিবিদ। ড. কামালদের সঙ্গে জোট করে ডান-বামের ভারসাম্য আনার চেষ্টা করছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে বিএনপির শরিক ইসলামি দলগুলোর মধ্যে কোনো অস্বস্তি আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না। আমাদের মধ্যে কোনো অস্বস্তি নেই। কারণ আমরা এখনও মনে করি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট কোনো নির্বাচনী জোট নয়। এটা আন্দোলনের জোট। ক্ষমতার অংশিদারিত্বের প্রশ্ন এখানে নেই। বিএনপি তার রাজনৈতিক নানান স্বার্থ বিবেচনা করে এ জোট করেছে।’

‘এছাড়াও বিএনপি কোনো ইসলামি দল নয় যে, বিএনপি আমাদের সব প্রত্যাশা পূরণ করবে। ধর্মের জায়গা থেকে তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের দূরত্বও খুব বেশি বলেও আমরা মনে করি না। তাদের আমরা মন্দের ভালোই বলি।’ বলেন মাওলানা আহমদ আলী কাসেমী।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে মাওলানা আহমদ আলীর মতো মুফতি সাখাওয়াতেরও কোনো অস্বস্তি নেই। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, অভিন্ন দাবি আদায়ের জন্য এমন জোট হতে পারে। তবে ড. কামালের নেতৃত্ব নিয়ে আামার আপত্তি আছে। আমি এ ব্যাপারে ইসলামি দল ও নেতৃবৃন্দকে সতর্ক থাকতে বলেছি।

পূর্ববর্তি সংবাদখাশোগিকে হত্যার পর তার জামা-কাপড় পরেই বেরিয়ে আসে হত্যাকারী
পরবর্তি সংবাদপ্রধানমন্ত্রীর সম্মানে ৫ নভেম্বর শুকরিয়া মাহফিল