মুসলিমবিশ্বের খ্যাতিমান আলেম আল্লামা তাকি উসমানিকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট আলেম মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন। দারুল উলুম করাচিতে লেখাপড়া ও চাকরির সুবাদে আল্লামা তাকি উসমানির সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন একটা দীর্ঘ সময়। উপকৃত হয়েছেন তার অসামান্য পাণ্ডিত্য দ্বারা, অবলোকন করেছেন তার ব্যক্তিত্বের শোভা।
ইসলাম টাইমস পাঠকের জন্য নিজের পীর ও প্রিয় শিক্ষক সম্পর্কে সেই অসাধারণ অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি তুলে ধরেছেন মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন। তার স্মৃতিচারণের সঙ্গী ছিলেন আতাউর রহমান খসরু।
ইসলাম টাইমস : আপনার দৃষ্টিতে আল্লামা তাকি উসমানির ব্যক্তিত্বের শোভাগুলো কী?
মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন : হজরতের ব্যক্তিত্বের শোভা কাছ থেকে না দেখলে বোঝা যাবে না। আমার বিশ্বাস তিনি ‘মুওয়াফফাক মিনাল্লাহ’ (আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যপ্রাপ্ত)। আমি সেখানে থাকাকালীন একটি ঘটনা। তখন হজরতের নয়টি বইয়ের কাজ চলছিল। একটি বইয়ের কাজ একদম শেষ পর্যায়ে ছিল। পেস্টিংয়ের কাজ হওয়ার পর হজরহকে দেখাতে আনা হয়। উদ্দেশ্য, প্রচ্ছদে বইয়ের নাম কোন খতে লেখা হবে। তিনি হঠাৎ করেই বইটি খুললেন এবং একটি পৃষ্ঠা ছিড়ে ফেললেন। বললেন, এই পৃষ্ঠা কোথা থেকে এলো? তিনি সেদিন প্রায় ১৫টি পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেললেন।
কুতুবখানার দায়িত্বশীল আমাকে জানান, ছিঁড়ে ফেলা পৃষ্ঠাগুলো ছিলো অন্য বইয়ের। এটা ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ। না হলে এই বই খোলার কথা ছিল না।
দুই. তার প্রখর ব্যক্তিত্ব। হজরতের ব্যক্তিত্ব এত প্রখর যে কেউ তার সামনে এসে ভুল কথা বলতে পারেন না। আমার দেখা একজন সাহসী ব্যক্তি মাওলানা আবদুল মালেক। যাকে আমি যুগের বিস্ময় মনে করি। তিনিও হজরতের ব্যাপারে বলতেন, আমি হুজুরের সামনে যাওয়ার আগে কী বলবো সেটা জপতে জপতে যাই। তবুও সামনে গিয়ে গুলিয়ে ফেলি। দারুল উলুম করাচির কুতুবখানার নাজেমও (লাইব্রেরিয়ান) একই কথা বলতেন।
তিন. আমি তাদেরকে কখনো সময় নষ্ট করতে দেখিনি। তাদের ২৪ ঘণ্টা সময় রুটিনমাফিক পরিচালিত হয়।
চার. মানুষের প্রতি সহমর্মিতা। বিশেষত ছাত্রদের প্রতি। আমি একবার অসুস্থ হয়ে পড়ি। মোটা অঙ্কের টাকার প্রয়োজন হয় তখন। দারুল উলুম করাচির নিয়ম হলো চিকিৎসার জন্য নাজেমে দারুল ইকামা (ছাত্রাবাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক) এর বরাবর আবেদন করতে হয়। আমি আবেদন করলে আমার অনুকূলে সুপারিশ করলেন না। তখন আমাদের নেগরান (অভিভাবক শিক্ষক) মুফতি আবদুল্লাহ বর্মি আমাকে সরাসরি শায়খ তাকি উসমানির কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। আমি করলামও তাই। তিনি দরখাস্ত রেখে দিয়ে বললেন, যত টাকা খরচ হয় আমার কাছ থেকে নিয়ে নিবে। চিকিৎসার জন্য আমার খরচ হয় সাতশো রুপি। তিনি খরচের পুরো অর্থটাই দিয়ে দিলেন। তখন পাকিস্তানের মাদরাসা শিক্ষকদের বেতন ছিল বারো শ থেকে তেরো শ রুপি। অর্থাৎ বেতনের অর্ধেক অর্থ।
পাঁচ. নিয়মানুবর্তিতা। তারা সব সময় নিয়মের অনুসরণ করতেন। একবার এক ছেলে দারুল উলুমে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হল না। কিন্তু মুফতি রাফি উসমানি স্বপ্নে দেখলেন, আল্লাহর রাসুল সা. এই ছেলের ভর্তি নেয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। তিনি বিপাকে পড়ে গেলেন। তখন দারুল উলুমের মুহতামিম ড. আবদুল্লাহ আরেফি রহ.। তিনি বললেন, নিয়মানুযায়ী কাজ করো। স্বপ্নের পিছু ছুটো না। সেই ছেলের ভর্তি নেয়া হল না।
ছয়. ইহতিয়াত তথা শরিয়তের ব্যাপারে সতর্কতা। যে কোনো টাকা গ্রহণ ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা। একবার এক লোক চেক মারফত ১০ হাজার টাকা পাঠালেন। কিন্তু খরচের খাত লিখল না। হিসাবরক্ষককে নির্দেশ দেয়া হল এ চেক আলাদা করে রাখতে। খরচ না করতে।
কিছুদিন পর লোকটি এসে চেকের খবর জানতে চাইল। চেক খরচ হয়নি জেনে আনন্দিত হলেন এবং বললেন, আমি মুফতি শফি রহ.-এর সময় থেকে প্রতি বছর ১ লাখ টাকার চেক পাঠাই। তার ইন্তেকালের পর আপনারা তার নীতির উপর অটল আছেন কিনা তা পরীক্ষার জন্য খরচের খাত না লিখে ১০ হাজার টাকার চেক পাঠাই। এখন থেকে আবার ১ লাখ টাকার চেক পাঠাবো।
সাত. আতিথেয়তা। আমরা দেখতাম দারুল উলুম করাচির মেহমানখানায় মাদরাসার মেহমানদের সাথেই শায়খুল ইসলামের পরিবারের মেহমানরা খেতেন। একবার আমি প্রশ্ন করলাম, মাদরাসার মেহমানখানায় কেন পারিবারিক মেহমানদের আপ্যায়ণ করা হয়? হজরত রাগ করলেন না। বললেন, মেহমানখানার যাবতীয় খরচ তারা দুই ভাই বহন করেন। এমনকি অফিসের যাবতীয় আসবাবপত্র তাদের নিজস্ব অর্থায়নে কেনা হয়।
আরও পড়ুন : (১ম পর্ব) ‘আল্লামা তাকি উসমানি আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, তুমি আমার মন ভরে দিয়েছো’ -মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন
ইসলাম টাইমস : আপনি নিশ্চয় আল্লামা তাকি উসমানির শিক্ষকদের দেখে থাকবেন। শিক্ষকগণ তাকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন : আমাদের সময় পাকিস্তানের প্রধান মুফতি বলা হতো আল্লামা ওয়ালি হাসান খান টুংকিকে। তিনি আল্লামা তাকি উসমানির শিক্ষক। বলতেন, ‘আমার একজন ছাত্র (তাকি উসমানি) আমার চেয়ে বহু এগিয়ে গেছে।’
আল্লামা রশিদ আহমদ লুধিয়ানভি রহ. হজরতের শিক্ষক। তিনি দারুল উলুম করাচির ফিকহ বিষয়ক মাসিক বৈঠক ‘মাজলিসে মাসায়েলে হাজিরাহ’ –যাতে পাকিস্তানের শীর্ষ আলেমরা অংশগ্রহণ করেন- তাতে তিনি আল্লামা তাকি উসমানিকে বলেন, ‘আপনার যেকোনো লেখা প্রকাশ পেলে আমি তা পড়ি এবং উপকৃত হই।’
হজরতের আরেকজন শিক্ষক ছিলেন মাওলানা গোলাম মুহাম্মদ রহ.। তিনি মাঝে মাঝে বলতেন, ‘এই মাওলানা মুজতাহিদ ফিল মাসায়েল। আল্লাহর অনন্য দান।’
ইসলাম টাইমস : আল্লামা তাকি উসমানিকে শায়খুল ইসলাম কেন বলা হয়?
মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন : দারুল উলুম করাচির এক অনুষ্ঠানে হজরতের নাম ঘোষণার সময় এক ছাত্র নামের সাথে ‘শায়খুল ইসলাম’ যোগ করে দেয়। হজরত মঞ্চে উঠে খুব রাগ করলেন। নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন যেন কেউ তার নামের সাথে শায়খুল ইসলাম যুক্ত না করে। বললেন, আমার নামের সাথে এ উপাধি যুক্ত করলে শব্দের অপমান হবে।
আল্লামা তাকি উসমানির পরই আলোচনার জন্য আসলেন তাকি উসমানির বড়ভাই মুফতিয়ে আজম আল্লামা রাফি উসমানি। উনি উঠেই বললেন, নিষেধাজ্ঞা ছাত্রদের জন্য প্রযোজ্য। আমাদের জন্য নয়। সাথে সাথে তিনি বললেন, এই উপাধি দেয়ার আগ মুহূর্তেই আমাদের শিক্ষক আল্লামা সাহাবান মাহমুদ আমাকে বললেন, আমার মন চায় মাওলানা তাকি উসমানিকে শায়খুল ইসলাম উপাধি দেই। আমি বললাম, আমারও ইচ্ছে করে। আর এর মধ্যেই এক ছাত্রও তা ঘোষণা করে দিল।
আল্লামা আতাউল্লাহ বোখারি রহ.-এর যুগে এক অনুষ্ঠানে এক আহলে হাদিস আলেমের নামের শুরুতে শায়খুল ইসলাম ঘোষণা করা হয়। তিনি তখন তার প্রতিবাদ করে বললেন, তাকমিলায়ে ফাতহুল মুলহিম যে লিখবে তার উপাধি হবে শায়খুল ইসলাম। পরে আল্লামা তাকি উসমানি এ গুরুদায়িত্ব আঞ্জাম দেন।
মাবহাসুল ফিকহিল ইসলামি, জেদ্দাহ-এর আমিনুল আম শায়খ হাবিব আল খোজাহ আমাদের সময়ে একবার পাকিস্তানে আসেন। তিনি তার বক্তৃতায় আল্লামা তাকি উসমানির নাম এলে শায়খুল ইসলাম ব্যবহার করেন। তখন থেকে শায়খুল ইসলাম উপাধি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
ইসলাম টাইমস : আরব-আজমে তার এই অসামান্য মর্যাদা লাভের রহস্য কী বলে মনে হয় আপনার?
মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন : এক তো আল্লাহর ইচ্ছা ও অনুগ্রহ। আমরা শুনেছি ছাত্রজীবনে আল্লামা তাকি উসমানি প্রচুর মেহনত করেছেন। দারুল উলুমের ছাত্ররা দুপুর বেলা বিশ্রাম করে। কিন্তু মুফতি শফি রহ. এ সময় তার দুই ছেলেকে কুতুবখানায় ঢুকিয়ে তালা দিয়ে রাখতেন। মুফতি শফি রহ. কোনো বুজুর্গ পেলেই ছেলেদের জন্য দোয়া চাইতেন। শায়খুল ইসলামও তার শিক্ষকদের প্রতি কখনো শিষ্টাচার বহির্ভূত কোনো আচরণ করেননি। মতের অমিল হলেও। এছাড়াও তিনি উসমানি বংশের লোক।
(এখানেই শেষ নয়)
