[মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকার মিরপুরে এসএসসি পরীক্ষা সমাপনকারী ছাত্রদের নিয়ে দিনব্যাপী একটি দ্বীনী শিক্ষা মজলিস অনুষ্ঠিত হয়। মজলিসে মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা-এর আমীনুত তালীম মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বয়ান পেশ করেন। এতে মাদরাসার তালিবুল ইলম ও জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাকারী -উভয় শ্রেণির জন্য প্রয়োজনীয় পথনির্দেশনা বিদ্যমান। এখানে সেই বয়ানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ পেশ করা হলো।]
একটি হীনম্মন্যতা আমাদের মধ্যে কাজ করে যে, আমি যে শাস্ত্রে পড়াশুনা করছি এই শাস্ত্রে আমি পাণ্ডিত্য অর্জন করব, সবার আগে যাব, আমি সবাইকে পিছে ফেলব; শুধু মেহনত করে। শুধু মেহনত। মাদরাসার ছাত্রদের কিন্তু এভাবে বলা হয় না এবং বললে অবাস্তব কথা হবে। কী বলা হয়, তুমি সর্বোচ্চ মেহনত কর। সময়ের অপচয় করো না। মেহনত পুরা কর। কিন্তু আল্লাহ্র সাথে তোমার সম্পর্ক ভালো থাকতে হবে। জ্ঞান দান করবেন কে? আল্লাহ। যে কথা মাদরাসার ছাত্রের জন্য সেই কথাটাই জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্যও প্রযোজ্য কি প্রযোজ্য না? -জিজ্ঞাসা করি আপনাদেরকে- অবশ্যই প্রযোজ্য। তার কারণ, মনে করুন, একজন মাদরাসার ছাত্র হাদীসের ওপর উচ্চতর পড়াশুনা করছে। এই বিষয়ে তাকে পাণ্ডিত্য দান করবেন কে? আল্লাহ। সে মেহনত করতে পারে কিন্তু দান করবেন কে? আল্লাহ তাআলা। আপনি ডাক্তার হতে চাচ্ছেন, কতজনই তো ডাক্তারি পড়ে, কিন্তু সব ডাক্তারের দক্ষতা ও পাণ্ডিত্য কি সমান? এই যে মেধার ও প্রতিভার বিকাশ যে ঘটছে, একরকম ঘটছে না, তারতম্য হচ্ছে, কোত্থেকে হয়? কেন হয়? সমান সমান মেহনত করছে, দু’জনের মেধা একরকম, তারপরও পার্থক্য হয় কি হয় না? হয়। কেন? দান করছেন আল্লাহ। একজনকে বেশি দান করেছেন আরেকজনকে কম। জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে যারা অগ্রসর হচ্ছে তারা বিশ্বাস করুক আর না করুক দান করছেন কে? দান করছেন আল্লাহ তাআলা।
কিন্তু বুদ্ধিমান ছাত্র সে, যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাথে সম্পর্ক রাখে। ভালো সম্পর্ক রাখে। সে এ বিশ্বাস করে- আমাকে দান করবেন আল্লাহ। এজন্য আমরা যে যেই বিষয়েই পড়ি- একজন অংক নিয়ে পড়ছি, একজন কোনো এক ভাষার উপর পড়াশুনা করছি আর বিজ্ঞানের তো বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা আছেই; একেকজন একেক দিক নিয়ে পড়ছি; যে যেই দিক নিয়েই পড়ি আমাকে বিশ্বাস রাখতে হবে, আমি যে বিষয়ে আছি এ বিষয়ে আমাকে পাণ্ডিত্য অর্জন করতে হলে, সবাইকে ছাড়িয়ে যেতে হলে একমাত্র আল্লাহ্ই আমাকে সাহায্য করতে পারেন। আল্লাহ্ই দান করতে পারেন। এজন্য আমি আল্লাহর সাথে সম্পর্ক রাখব।
কী সম্পর্ক রাখব আল্লাহর সাথে? আমাকে সবসময় মনে রাখতে হবে, আমি আল্লাহ্র বান্দা। আল্লাহ্র বন্দেগী করা ভুলব না। ফরয ভুলব না। আল্লাহ যে সমস্ত ইবাদত ফরয করেছেন এটার জন্য আমাকে সময় বের করতেই হবে। ঘুমের জন্য আমি সময় বের করি না? ঘুমের জন্য সময় বের করি। তো ঘুম কি ফরয? খাওয়া-দাওয়ার জন্য সময় বের করি না? এটা কি ফরয? দৈনিক গোসল করি, গোসলের জন্য সময় বের করি না? এটা কি ফরয? এটা কে তো আমি জরুরি মনে করি। আমার দেহের জন্য জরুরি। আমার শারীরিক চাহিদা এগুলো। শারীরিক চাহিদাগুলো আমি জরুরি মনে করছি। এগুলোর জন্য সময় বের করেই ফেলছি। শত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় বের করছি।
শারীরিক চাহিদার জন্য আমি সময় বের করছি। এরকম আমার দিলেরও তো কিছু চাহিদা আছে। দিল ও কলব এবং রূহ ও আত্মার কিছু চাহিদা আছে। আমার রূহ যাতে সুস্থ থাকে, আমার রূহ যাতে শক্তিশালী হয়, আমার কলব যাতে পাক-পবিত্র থাকে, শক্তিশালী থাকে- এজন্য এগুলোর কিছু চাহিদা আছে। কলব আলোকিত হওয়ার জন্য কিছু চাহিদা আছে। সেটা কী? ঈমান, নেক আমল, গুনাহ থেকে বাঁচা, ইবাদত-বন্দেগী করা।
কলব ও রূহের চাহিদা; এই চাহিদাগুলোর জন্য যদি আমি সময় বের করি, এগুলো যদি যথাযথভাবে আদায় করি তো আল্লাহ্র সাথে আমার সম্পর্ক ভালো থাকবে। আমি আল্লাহ্র দরবারে দুআ করব, যিকির করব, কুরআন তিলাওয়াত শিখব, তিলাওয়াত করব। লম্বা সময়ের দরকার নেই। আমরা মাদরাসার ছাত্রদেরকে বলি, তোমরা কমপক্ষে তিন পারা করে তিলাওয়াত কর। আপনাদেরকে বলব, আপনি দৈনিক এক পারার চার ভাগের এক ভাগ তিলাওয়াত করবেন। এক পৃষ্ঠা করে তিলাওয়াত করবেন।
ইনসাফের সাথে কি বলবেন- আপনাদের পড়াশুনার জন্য বেশি গভীরতা দরকার, না আমাদের পড়াশুনার জন্য? ধারণা নেই আপনাদের- বলবেন কীভাবে। আমাদের যে পড়াশুনা- ইলমে ওহী, এটা অনেক বিস্তৃত, অনেক গভীর। এটার জন্য একাগ্রতা বেশি দরকার। এটা আপনাদের ধারণা থাকবে না। এজন্য আমি বলে দিলাম; আশা করি বিশ্বাস করবেন। আমরা মনে করি, আমরা যতই মেহনত করি, যতই সময় ও শ্রম ব্যয় করি, যদি আমি কুরআন তিলাওয়াত ঠিকমত না করি, যিকির-দুআ না করি, ফরয-সুন্নতের পাশাপাশি দুই-চার রাকাত নফল নামায না পড়ি, একটু আল্লাহ্র দরবারে মুনাজাত না করি, দু-চার ফোঁটা চোখের পানি না ফেলি তাহলে আমরা যতই মেহনত করব ইলমের লাইনে অগ্রসর হতে পারব না। আপনি বলবেন, ব্যস্ততার কারণে পারি না। ব্যস্ততা তো আমাদের বেশি। কারণ আমাদের এই বিভাগটা সময়ের দাবি রাখে। একাগ্রতার বেশি দাবি করে। কিন্তু ওটাতে বরকত আসবে কোত্থেকে? এই দুআর মাধ্যমে, যিকিরের মাধ্যমে। এজন্য যারা স্কুল, কলেজ বা ভার্সিটির ছাত্র তারাও নিজের লাইনে অগ্রসর হওয়ার জন্য, ভালো ডাক্তার বনার জন্য, ভালো ইঞ্জিনিয়ার বনার জন্য ভালো নামাযী হতে হবে। তিলাওয়াত শিখে, তিলাওয়াত করতে হবে দৈনিক; কম করেন আর বেশি করেন। যিকির, দুআ, দুই-চার রাকাত নফল নামায পড়া। সালাতুল হাজত একটা নামায আছে, হাজতের নামায। মানে আমার যা প্রয়োজন, নামায পড়ে আল্লাহর কাছে তা চাওয়া। পরীক্ষার জন্য যাচ্ছি, ভালো ফলাফলের জন্য দুই রাকাত নামায পড়ে হলে যাব। একটু মুনাজাত করে হলে ঢুকব।
যখন আমার মধ্যে এই অনুভূতি আসবে, আমি যে লাইনে আছি এই লাইন গলত লাইন নাকি সহীহ লাইন,তখন আমার হিম্মত বাড়বে কি বাড়বে না? হিম্মত বাড়বে। যখন আমি আমার লাইনে থেকে আল্লাহ্র সাথে সম্পর্ক মজবুত করব, আমার হিম্মত বাড়বে। একজন মাদরাসার ছাত্র আল্লাহর ন্তুষ্টি চাচ্ছে, আমিও আল্লাহ্র সন্তুষ্টি চাচ্ছি। তাহলে আমার হিম্মত বাড়বে কি বাড়বে না? বাড়বে। আমি কখনো হীনম্মন্যতার শিকার হব না। এজন্য এই নিয়ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সাথে সাথে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক রাখা। সম্পর্কের মাধ্যম বললাম- ইবাদত-বন্দেগী, যিকির, দুআ এবং গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা।
কোন জিনিস থেকে বাঁচা? গুনাহ থেকে বাঁচা। গুনাহ সবকিছু বরবাদ করে দেয়। মাদরাসার তালিবে ইলম হোক আর স্কুলের ছাত্র, যে গুনাহতে লিপ্ত হবে সে আর বরকত পাবে না। জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা বলেন, মাদরাসার পড়াশুনার কথা বলেন, গুনাহ সব ধরনের পড়াশুনার বরকত নষ্ট করে দেয়। নূর নষ্ট করে দেয়। দেখেন না লেখা থাকে- আলোকিত মানুষ চাই। আলোকিত মানুষ চাইতে হলে, আলোর সৃষ্টিকর্তাকে চিনতে হবে। আলো সৃষ্টি করেছেন কে? আল্লাহ। الظُّلُمٰتِ وَ النُّوْرَ جَعَلَ (তিনি সৃষ্টি করেছেন অন্ধকার ও আলো)। আলোকিত মানুষ হয়ে যাবে- আলোর স্রষ্টাকে না চিনে! আলোদানকারীর উপর ঈমান না এনে! তাঁর আনুগত্য স্বীকার না করে? অসম্ভব!
যাই হোক, আমি বলতে চাচ্ছি যে, আমাদের আল্লাহ্র সাথে সম্পর্ক করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। বস্তুত যে চায় যে, নিজের খালিক ও মালিক, নিজের রব ও মা‘বুদ, যিনি তাকে হাজারো নিআমত দিয়ে ভরিয়ে রেখেছেন, দয়া ও করুণায় ঘিরে রেখেছেন, যে চায় তাঁর শোকর গুজার বান্দা হবে, তাঁর অবাধ্য বান্দা হবে না, তাঁর বিদ্রোহী হবে না, তার জন্য আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি করা এবং সেই সম্পর্কের উপর অটল-অবিচল থাকা ছাড়া কোনো উপায়ই নেই। সে মাদরাসার তালিবে ইলম হোক বা স্কুলের ছাত্র; সর্বাবস্থায় আল্লাহর সাথে সম্পর্ক জরুরি।
আল্লাহর সাথে সম্পর্ক, তাআল্লুক মাআল্লাহ যেটা, সেটার জন্য সবচেয়ে জরুরি হল ঈমান শেখা। আজ ঈমান শেখার বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি নেই। ঈমান শেখার অর্থ কী? ঈমান শেখার অর্থ হল-
১. আমাদেরকে ইসলামী আকায়েদ শিখতে হবে এবং মনেপ্রাণে সেগুলোর বিশ্বাস ধারণ করতে হবে।
২. কী কী চিন্তা ও মতবাদ এবং কী কী কথা ও কর্ম ইসলামী আকায়েদের সাথে সাংঘর্ষিক, সেগুলো জানতে হবে। অর্থাৎ যেসব কারণে ঈমান বিলুপ্ত হয়ে যায় সেগুলোর ইলম হাসিল করতে হবে এবং সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে সেগুলো থেকে বেঁচে থাকতে হবে।
৩. শুআবুল ঈমান, ঈমানের শাখা-প্রশাখা কী কী সেগুলো জানতে হবে।
৪. ইসলাম যেসকল মৌলিক বিধিবিধান শিক্ষা দিয়েছে এবং যে সকল ফরয ও হুকুক (আল্লাহ ও সৃষ্টির হকসমূহ) শিক্ষা দিয়েছে সেগুলো জানতে হবে এবং সেগুলো পালনের চেষ্টা করতে হবে।
৫. হালাল-হারামের জ্ঞান অর্জন করতে হবে। হারাম থেকে বেঁচে থাকতে হবে।
৬. যেসব কারণে ঈমান দুর্বল হয়ে যায় সেগুলো জানতে হবে এবং সেগুলো থেকে বেঁচে থাকতে হবে। এজন্য জানতে হবে, কোন্ কোন্ কাজ গুনাহ ও অন্যায়; আল্লাহ তাআলার নাফরমানী এবং আখেরাতে আযাবের কারণ।
৭. কুরআনে উল্লেখিত মুমিনদের চরিত্র ও গুণাবলি জানতে হবে এবং সেই গুণে গুণান্বিত হওয়ার ও সেই চরিত্রে চরিত্রবান হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
৮. কাফির, ফাসিক ও মুনাফিকদের মন্দ কাজ ও মন্দ অভ্যাস, যেগুলোর বিষয়ে কুরআন মাজীদে সতর্ক করা হয়েছে সেগুলো জানতে হবে এবং সেগুলো থেকে বেঁচে থাকতে হবে।
৯. যেসব আমলের কারণে ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং ঈমান তাজা হয় ও মজবুত হয় সেগুলোর বিষয়ে গুরুত্ববান থাকতে হবে।
১০. ঈমান রক্ষা ও ঈমান নবায়নের দ্বীনী পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে জেনে সেগুলো নিজের জীবনে গ্রহণ করার চেষ্টা করতে হবে।
এমনিতে তো ঈমান শেখা, ঈমান রক্ষা করার বিষয়ে সচেতন থাকা সবার উপরই ফরয। কিন্তু যারা এমন পরিবেশে থাকে, যেখানে ঈমানের কদর নেই, যেখানে পাঠ্যক্রম থেকে শুরু করে পাঠ্যব্যবস্থা সবকিছুতেই ঈমানের প্রতিকূল পরিবেশের যেন আধিপত্য, সেরকম পরিবেশে যারা থাকে তাদের তো নিজের ঈমানের বিষয়ে যত্নবান থাকা আরো বেশি জরুরি।
জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ভালো জিনিস এবং প্রয়োজনীয়ও বটে, কিন্তু সেগুলোর পাঠ্যক্রম রচনা, পাঠ্যব্যবস্থা নির্ধারণ এবং সেসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় বিশ্বব্যাপী এমন লোকদের আধিপত্য, যারা জগতের জ্ঞান ও বিদ্যাকে জগতের স্রষ্টা থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য তৎপর। তাদের সর্বনিম্ন অপরাধ হল-
یَعْلَمُوْنَ ظَاهِرًا مِّنَ الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَ هُمْ عَنِ الْاٰخِرَةِ هُمْ غٰفِلُوْنَ
তারা পার্থিব জীবনের প্রকাশ্য দিকটাই জানে, আর আখেরাত সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ গাফেল। -সূরা রূম (৩০) : ৭
یَعْرِفُوْنَ نِعْمَتَ اللهِ ثُمَّ یُنْكِرُوْنَهَا وَ اَكْثَرُهُمُ الْكٰفِرُوْنَ۠
তারা আল্লাহর নেআমতসমূহ চেনে তবুও তা অস্বীকার করে এবং তাদের অধিকাংশই অকৃতজ্ঞ। -সূরা নাহল (১৬) : ৮৩
আমাদের পাঠ্যপুস্তকগুলোতে বিষয়বস্তু যেটাই হোক উপস্থাপনার এমন পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে যে, অবচেতনেই ছাত্রের মন-মস্তিষ্ক থেকে ইসলাম ও শাআয়েরে ইসলামের গুরুত্ব ও মর্যাদা কমে যায়। এছাড়া সুস্পষ্ট বাতিল এবং বেঈমানী কথাবার্তাও জায়গায় জায়গায় লিখে দিয়েছে। এজন্য কোনো ছাত্র যদি দ্বীন ও শরীয়ত এবং ঈমান ও আমল শেখার বিষয়ে যত্নবান না হয় এবং সময়ে সময়ে নেককারদের ছোহবত অবলম্বন করে ঈমানী মানস গঠন না করে তাহলে এমন পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যব্যবস্থায় পড়াশোনা করে, এমন পরিবেশে অবস্থান করে নিজের ঈমান কীভাবে রক্ষা করবে?
তো আপনারা একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে রাখুন। দ্বীনী দৃষ্টিকোণ থেকে বাতিল ও আপত্তিকর বিষয়বস্তু যেসব বইয়ে আছে এবং যেসব বই ঈমান বিরোধী চিন্তা-চেতনা থেকে রচিত, সেগুলো হাতে নেওয়ার আগে আপনারা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। বলবেন, আয় আল্লাহ! আমরা তোমার মুমিন বান্দা। সব ধরনের কুফুর, নিফাক এবং সব রকম বাতিল ও আপত্তিকর বিষয় থেকে আমরা তোমার দরবারে নিজেদের নিঃসম্পর্ক ঘোষণা করছি। আপনাদের অভিভাবক এবং আপনাদের শিক্ষক সবারই এই কাজ করা উচিত। বরং স্কুল-কলেজের ছাত্র, তাদের অভিভাবক এবং তাদের প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলগণের কর্তব্য হল, হিম্মত করে সরকারের কাছ থেকে এই দাবি আদায় করে নেওয়া যে, তারা যেন পাঠ্যপুস্তকগুলো মুহাক্কিক ও আহলে হক উলামায়ে কেরামের মাধ্যমে দ্বীনী দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পাদনা করিয়ে নেন এবং ফরযে আইন ইলমকে পাঠ্যক্রমের বাধ্যতামূলক অংশ সাব্যস্ত করেন।
আমাদের জানা উচিত যে, ঈমান সবার আগে, সবকিছুর আগে। সেটাই তো মুমিনের জীবন, সেটাই নূর এবং হেদায়েত। এইজন্য আমাদের জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞান শেখা এমনভাবে যেন না হয় যে, আমাদের ঈমানের দৌলত আমাদের হাতছাড়া হয়ে যায়, আমাদের স্রষ্টা থেকে আমাদের সম্পর্ক ও বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। যদি আমরা এমন করি তাহলে এর চেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ততা আর কিছু হতে পারে না।
আমি এখন একটি হাদীস বলি, এরপর কথা শেষ করে দেব।
أَرْبَعٌ إِذَا كُن فِيكَ فَلَا عَلَيْكَ مَا فَاتَكَ مِنَ الدنْيَا: حِفْظُ أَمَانَةٍ، وَصِدْقُ حَدِيثٍ، وَحُسْنُ خَلِيقَةٍ، وَعِفةٌ فِي طُعْمَةٍ.
আপনি বাংলায় লিখে ফেলতে পারেন এই হাদীস। আরবীর উচ্চারণ বাংলায় হয় না; এজন্য কেউ কুরআনকে কখনো বাংলা উচ্চারণে লিখবেন না। বাংলা উচ্চারণ বা ইংরেজী উচ্চারণে লিখবেন না এবং বাংলা উচ্চারণ বা ইংরেজী উচ্চারণে পড়বেনও না কখনো। শিখবেন। ا ب ت ث থেকে শেখেন। কারণ, অনেক অক্ষর আছে, বাংলায় তার কোনো প্রতিউচ্চারণ নেই। আছে? ع বাংলায় নাই। ق বাংলায় নাই। ض বাংলায় নাই। অনেক অক্ষর বাংলায় বিলকুল নাই। কিছু অক্ষর আছে এমন বাংলায় যার কাছাকাছি অক্ষর আছে। আর কিছু আছে হুবহু। যাইহোক, বলছিলাম, কুরআন অন্য ভাষায় লিখবেনও না। পড়বেনও না। কিন্তু অন্যান্য বিষয় ছোটখাটো জিনিস বাংলা উচ্চারণে লিখে রাখলে আশা করি গুনাহ হবে না।
আরবাউন ইযা কুন্না ফী-কা…
أَرْبَعٌ إِذَا كُنّ فِيكَ فَلَا عَلَيْكَ مَا فَاتَكَ مِنَ الدُّنْيَا: حِفْظُ أَمَانَةٍ، وَصِدْقُ حَدِيثٍ، وَحُسْنُ خَلِيقَةٍ، وَعِفّةٌ فِي طُعْمَةٍ.
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, চারটা সিফাত, চারটা গুণ যদি তোমার মধ্যে থাকে, তাহলে কী আছে, কী নেই এটা নিয়ে আর পেরেশান হওয়ার দরকার নেই।
দুনিয়ার কী পেলে আর কী পেলে না- পেরেশান হওয়ার দরকার নেই। চার গুণ পেয়ে গেছ; দুনিয়ার আর কিছু না পেলেও সবই আছে তোমার। চারটা জিনিস-
১. ছিদ্কু হাদীসিন- সত্য বলা; সত্য কথা বলব, মিথ্যা বলব না।
২. হিফযু আমানাতিন- আমানত রক্ষা করা। খিয়ানত না করা। কোনো ধরনের ভেজাল, কোনো ধরনের দুর্নীতিতে না জড়ানো। অন্যের হক নষ্ট না করা। নিজের দায়িত্বে, নিজের ডিউটিতে কোনো ফাঁকি না দেওয়া। বিষয়টা কিন্তু অনেক ব্যাপক। আজকে এতটুকুই বললাম। হিফযু আমানাতিন-আমানত রক্ষা করা। কোনো প্রকার খিয়ানত না করা।
৩. হুসনু খালীকাতিন- আখলাক-চরিত্র সুন্দর এবং ব্যবহার সুন্দর হওয়া। চরিত্র পবিত্র হওয়া, ভালো হওয়া। মানুষের সাথে ব্যবহার সুন্দর হওয়া। এটাকে বলে হুসনু খালীকাতিন। এটা তৃতীয় বিষয়।
৪. ইফ্ফাতুন ফী তু‘মাতিন- খাবার হালাল হওয়া। রিযিকটা হালাল হতে হবে।
চারটা বিষয় হল : সত্য বলা, আমানত রক্ষা করা, স্বভাব-চরিত্র, আচার-ব্যবহার ভালো হওয়া, আর রিযিক হালাল হওয়া।
এই চার গুণ থাকলেই চলবে। এটা কি শুধু মাদরাসার ছাত্রদের জন্য? না। সবার জন্য এই চার গুণ। একজন মুমিন বান্দার মধ্যে এই চার গুণ থাকতেই হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই সিফাতগুলো হাসিল করার তাওফীক নসিব করেন- আমীন।
অনুলিখন : আল আমীন মুহাম্মাদ খায়রুল বাশার
