আবরার আবদুল্লাহ ।।
১ অক্টোবর ২০১৭। বিকেল ৫টায় জীবনে প্রথমবারের মতো নৌকায় পা রাখে মুহাম্মদ। তুর্কি সমুদ্র সৈকত থেকে গ্রিসের উদ্দেশে ৫ ঘণ্টার জলযাত্রা শুরু করে সে।
পাচারকারীরা তাদের পকেট হাতিয়ে সব অর্থ কেড়ে নেয় এবং তাদের প্রচণ্ড অন্ধকারের মধ্যে চাপাচাপি করে থাকতে বাধ্য করে। এই নারকীয় অবস্থায় অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘ সময়। যতক্ষণ না তুর্কি কোস্ট গার্ডের জাহাজগুলো দূরে সরে যায়।
‘এই দিনটি ছিলো আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন দিন। সেদিন খুব কেঁদেছিলাম।’ -বলেন ২২ বছর বয়সী মুহাম্মদ।
মুহাম্মদের সৌভাগ্য যে তারা নিরাপদে তীরে পৌঁছাতে পেরেছিল। কারণ, অসংখ্য নৌকা সমুদ্রেই তলিয়ে যায় অথবা গুলি করে তলিয়ে দেয়া হয়। যেন অভিবাসীরা তীরে ভিড়তে না পারে।
তীরে পৌঁছে ৯ ঘণ্টা তাকে অপেক্ষা করার পর তাদেরকে গ্রিসের লেসবসে অবস্থিত প্রধান আশ্রয়কেন্দ্র মরিয়াতে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে সে অভিজ্ঞতাও খুব সুখের ছিলো না।
মুহাম্মদ বলেন, আমরা শীতের মধ্যে ৯ ঘণ্টা অপেক্ষা করি। আমি কয়েকদিন যাবত ঘুমাতে পারছিলাম না। আমার কাপড়গুলো ছিল ভিজে। আমি কাঁপছিলাম। শরীর অবসন্ন হয়ে আসছিল। তারা আমাদের প্রয়োজনীয় কিছুই দেয়নি। খাদ্য হিসেবে পেয়েছিলাম ছোট এক বোতল পানি এবং কয়েকটি জলপাই। তখন আমি নিজেকে ছুঁয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কেন এই ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে পড়লাম?
মুহাম্মদের জন্ম ইরাকে। এখানেই সে বেড়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরাকে অভিযান শুরু করে তখন তার বয়স ছিলো আট বছর। ২০১৪ সালে যখন আইএসআই ও আইএসআইএল তার শহর মসুল দখল করে তখন সে ছিলো কিশোর।
ইরাকি সরকারি বাহিনী যখন তা পুনর্দখল করে তখন তার বয়স ২০ বছর। এ সময় সে তার একমাত্র আশ্রয় বাড়িটি হারায় এবং ইউরোপে পাড়ি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।
ইরাকে যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখার পর এবং গ্রিসে এসে বিভিন্ন তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করার পর এখন কিছুটা স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে মুহাম্মদ। জীবনের একটি মহৎ উদ্দেশ্যও ঠিক করেছে সে। সে লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে মুহাম্মদ।
তার লক্ষ্য মানুষকে সাহায্য করা। মুহাম্মদ বলে, আমি একজন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে জীবন কাটাতে চাই। পৃথিবীর যেখানেই যুদ্ধ হোক আমি সেখানে যাবো এবং মানুষকে সাহায্য করবো।
মুহাম্মদ ইউরোপে আরবি অনুবাদক হিসেবে কাজ করছে। সকালে সে একটি শরণার্থী ক্লিনিকে কাজ করে এবং বিকেলে সে অন্য জায়গায় শরণার্থীদের অনুবাদক হিসেবে সহযোগিতা করে।
অনুবাদকের সহযোগিতা অভিবাসীদের জন্য অনেক বেশি প্রয়োজন। কারণ, ভাষাগত সমস্যার কারণে অনেকে সহজ সেবাগুলো পান না।
শরণার্থীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত এক রুমের একটি ক্লিনিকের বাইরে বসে আছে মুহাম্মদ। কাঠের বেঞ্চে বসে সে অপেক্ষা করছে কোনো আরবিভাষী রোগীর জন্য। তবে এখন আর কোনো আরবি ভাষীকে দেখা যাচ্ছে না। অপেক্ষমান রোগীদের অধিকাংশ আফ্রিকান। তারা কঙ্গো ও ক্যামেরুনের নাগরিক।
মুহাম্মদকে জিজ্ঞেস করলাম তার জীবনের গল্প। তার জীবনের চাকা যে দিনটাতে এসে থমকে যায় সে দিনের গল্প। সেদিনটি ছিলো ২৬ ডিসেম্বর ২০১৬। তার জীবনের এ বীভৎস দিনের বিবরণ দিতে গিয়ে গলা কাঁপছিল তার। চোখও ভিজে উঠছিলো বার বার।
সে বলে, এ দিনে আমি আমার সবকিছু হারিয়েছি। যেন আমার পুরো জীবনটাই হারিয়েছি।
২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে ইরাকি বাহিনী বড় ধরনের সামরিক অভিযান শুরু করে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনীর বিমান হামলার সহযোগিতায় শহর উদ্ধারের অভিযান শুরু করে তারা। এ অভিযানের নেতৃত্ব দেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল স্টিফেন টজেন্ট। যৌথ বাহিনীর শীর্ষ একজন কমান্ডার। যার আরো বড় যুদ্ধে অংশগ্রহণেরও অভিজ্ঞতা রয়েছে।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী ওই অভিযানে ৯ থেকে ১১ হাজার মানুষ মারা যায়। যার এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায় অসতর্ক বিমান হামলার কারণে। যাদের বাঁচানো খুব কঠিন ছিল না।
মুহাম্মদও এই পরিসংখ্যানকে সমর্থন করলো। সে বললো, ‘মার্কিন বাহিনী অসংখ্য ভুল করেছে এ অভিযানে। পরিণামে অসংখ্য সাধারণ নাগরিক মারা গেছে। তারা একজন আইএস যোদ্ধাকে হত্যা করার জন্য আশপাশের কয়েক ডজন বাড়ি ধ্বংস করে দিয়েছে। দেখা গেছে, সে যোদ্ধা বেঁচে গেছে, কিন্তু চারপাশের ২০ থেকে ৩০ জন মানুষ মারা গেছে।
২৬ ডিসেম্বর যুদ্ধ চলছিল। আমি আমার নানা বাড়িতে ছিলাম। আমার নানি তখন অসুস্থ। আমার নানা বাড়ি ছিলো আমাদের বাড়ি থেকে কয়েক মিটার দূরে।
সকালে মা আমাকে জানালেন, আমাদের বাড়ির ছাদে আইএসআইএল-এর যোদ্ধারা অস্ত্র স্থাপন করেছে। তবে তারা আমাদের বাড়ি ছাড়তে দিচ্ছে না। যোদ্ধাদের ধারণা আমরা যদি বাড়ি ছেড়ে যাই তবে এখানে মার্কিন বাহিনী নির্দ্বিধায় আক্রমণ করবে।
মায়ের সাথে কথা হওয়ার ৩০ মিনিটের মধ্যে আমি বিকট শব্দ শুনতে পাই। শব্দটা খুব কাছ থেকেই এসেছিলো। আমি আমার পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি কিন্তু ৩ দিন পর্যন্ত নানা বাড়ি থেকে বের হতে পারিনি।
আইএসআইএল তখনও আমাদের প্রতিবেশীদের উপর গুলি ছুড়ছিলো। তারা চাচ্ছিলো কেউ যেন বাড়ি ছেড়ে না যায়। সবাই প্রচণ্ড আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছিলো। আমিও অসহায়ের মতো নানা বাড়িতে অবস্থান করতে লাগলাম।
৩দিন পর ইরাকি বাহিনী যখন ঘোষণা করলো তারা শহর দখল করেছে এবং আইএসআইএলকে শহর থেকে সরিয়ে দিয়েছে তখন আমি বের হয়ে আসলাম। আমি দৌঁড়ে বাড়ি ফিরলাম।
যখন আমাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম, দেখলাম সবকিছু ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। আমাদের বাড়িটি মাটির সাথে মিশে গেছে। এ দৃশ্য দেখার পর আমার জীবন থমকে যায়। আমি আমার পুরো পরিবার এবং আমার সবকিছু হারিয়েছি।
আমার সঙ্গে কথা বলার পরপরই মার্কিন বাহিনী বিমান হামলা করে আমাদের বাড়িটি ধ্বংস করে দেয়। শুধু একজন বিদ্রোহীকে হত্যা করার জন্য আমার পুরো বাড়িটা ধ্বংস করে দেয় তারা। এভাবে অসংখ্য পরিবারকে তারা হত্যা করেছে, অসংখ্য বাড়িঘর মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে।
মুহাম্মদ জানালো, সেদিনের বোমা বর্ষণে তার বাবা, মা, তিন ভাই ও তিন বোন মারা যায়। এছাড়াও তার দুই দূর সম্পর্কীয় বোন, একটি এক বছরের শিশু এবং ছয় মাসের শিশু মারা যায়।
এরপর মুহাম্মদ আর কথা বলেনি। চোখের কোণে জমে ওঠা দু’ফোটা অশ্রু মুছে হেঁটে চলে গেলো। মুহাম্মদের মতো অসংখ্য যুবক পরিবারের ধ্বংস চিত্র নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর নানান দেশে। কেউ জানে না ভাগ্যাহত এসব যুবকদের গন্তব্য কোথায়?
-আল জাজিরা অবলম্বনে
