শরীফ মুহাম্মদ ।।
রাজনীতিতে ক্ষমতার পালাবদল কিংবা ক্ষমতা রক্ষার ইস্যু যখন আবেগের জায়গায় চলে আসে, তখন আদর্শ কিংবা নীতির জায়গাটা ছোট হয়ে আসতে থাকে। মোটা লক্ষ্যের দিকে ধাবমানতা তৈরি হয় এবং নীতির সূক্ষ্মরেখা আরও ধূসর হয়ে যায়। বাংলাদেশের রাজনীতির প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য মাঠে এখন এ রকম একটা পরিস্থিতিই উপস্থিত।
ক্ষমতারক্ষা ও ক্ষমতায় যাওয়া- দু দিকেই লক্ষ্যমুখিতা এখন প্রবল। অবশ্যই এর অনেক কারণ রয়েছে। এ জন্যই আদর্শ ও নীতির দূরত্বের সূক্ষ্ম রেখাগুলো মুছে দিয়ে জোটবাঁধার দৌড়টা বেড়ে গেছে। ডানের সঙ্গে বাম, বামের সঙ্গে ডান, বস্তুবাদের সঙ্গে ধর্মপন্থা, ধর্মপন্থার সঙ্গে বস্তুবাদের নানা রকম মিশ্রণ তৈরি হচ্ছে। মেরুকরণ-সমীকরণের গতিশীল একটি ঘূর্ণিই চলছে। এই মেরুকরণ-সমীকরণের প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োজনীয়তাও হয়তো এখন গৌণ নয়। এ জন্যই বিএনপির সঙ্গে আগের থাকা ডান, আধাডান ২০ দলের সঙ্গে এখন বাম-আধাবাম জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের একমুখী পথচলা। অপরদিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আগের থাকা বাম-আধাবাম ১৪ দলের সঙ্গে এখন ডান ও ধর্মপন্থী ব্যক্তি-দলের একপথ যাত্রা।
জাতীয় নির্বাচন সামনে। নির্বাচন কেমন হবে, কী হবে- এসব প্রশ্নের নানা ধরনের জল্পনা মাথায় থাকলেও শক্তি ও ভোটের যুদ্ধে এ জাতীয় ভাঙ্গাগড়া হয়তো সাম্প্রতিককালে আরও বাড়বে। ধারণা করা যায়, নভেম্বরের শুরু থেকে এ জাতীয় মেরুকরণের গতিটা আরও তীব্র হবে । বিচিত্র ভাঙ্গাগড়ার দৃশ্য বেলায় বেলায় সামনে চলে আসবে। কিন্তু এরই মধ্যেই ভেতরে ভেতরে নীতি বা মতের একটি প্রাবল্য তৈরি হতে থাকবে। একদম নীতি বা ঝোঁকবিহীন কোনো পথচলায় আসলে কেউ থাকে না। বুদ্ধি বা কৌশল, পরিস্থিতি বা অসহায়ত্ব কোনো একটি মত-পথকে নিয়ন্ত্রকের জায়গায় নিয়ে বসাতে পারে। চারপাশ দেখে এমনটাই মনে হচ্ছে। আর এখানেই ইসলামি আদর্শ ও ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চার অবস্থানটি নিয়ে ভাবার দরকারটা সামনে চলে আসছে।
লক্ষ করলে দেখা যায়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে যেসব বাম-আধাবাম দলগুলো রয়েছে, মত-পথের মিলের কারণে তারা একটা সন্তুষ্টির মধ্যেই আছে। এর সঙ্গে উপরি তো আছেই ক্ষমতার ভাগ। কিন্তু সেখানে ইসলামপন্থী যেসব ব্যক্তি বা মানুষ নানা কারণে নতুন করে যোগ দিতে চাচ্ছে, তারা তাদের মত ও নীতির জায়গাটাকে সামনে নিয়ে আসতে পারছেন না। বড় দল ও জোটের আগের অবস্থানের সঙ্গেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে অনেকেই। কেউ কেউ ধর্মনিরপেক্ষতার পর্যন্ত সাফাই তুলে ধরতে চেষ্টা করছেন। এটাই হচ্ছে নীতি-আদর্শের সূক্ষ্মরেখা ধূসর হয়ে যাওয়ার সময়ও একটি নীতি বা পথের প্রাবল্য। এভাবেই রাজনীতিতে ধর্মীয় মূল্যবোধের জায়গাটা এই নির্বাচনী উত্তেজনার সময় হারিয়ে যাচ্ছে অথবা কোনঠাসা হয়ে যাচ্ছে।
বিপরীত দিকে যদি বিএনপি জোটের দিকে চোখ রাখা যায়- সেখানেও এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। আগের থাকা ২০ দলে যেসব ইসলামি আদর্শপন্থী দল আছে, নতুন ঐক্যফ্রন্টের বামঘেঁষা ঝোঁকের মধ্যে তারা নিজেদের নীতির অবস্থানটাকে বড় করে সামনে আনতে পারছেন না। উল্টো নতুন ঐক্যফ্রন্টের প্রগতিশীল বা আধাবাম কথাবার্তার সমান্তরালে কিছুটা চুপচাপ থেকে নির্বাচনটা পার করতে চাইছেন। এখানেও অন্য নীতির কাছে ইসলামি মূল্যবোধবাহী নীতির একটি নীরবতা তৈরি হয়েছে। নির্বাচন ও উত্তেজনার রাজনীতিপর্বে এই ঘটনাটা ঘটছে।ইসলামি আদর্শ ও মূল্যবোধের কথা চাপা পড়ছে। বিপরীত মতপথ নিয়ন্ত্রণে যাচ্ছে।
দুটি বড় দলেরই জোট, শাখা জোট কিংবা জোটবদ্ধতার আয়তন হয়তো সামনে আরো বাড়বে। কিন্তু এ সবের মধ্যেও স্লোগান ও বক্তব্যের লাইন একটি বড় ব্যাপার হয়ে থাকবে। দেখা যাচ্ছে, বিএনপির ঐক্যফ্রন্ট রাজনীতিতে স্লোগান, বক্তব্য আর ব্যক্তিত্ব-বন্দনায় অন্য লাইনের বক্তব্য-কথা সামনে চলে আসছে। এটা বিএনপির কেউ হয়তো লক্ষ করছে না। অথবা লক্ষ করলেও এমুহূর্তে ইস্যু বানাতে চাচ্ছে না। কিন্তু এভাবেই অন্য ধারার একটি কথা ও নীতির প্রাবল্য তৈরি হচ্ছে। রাজনীতির একটি তুঙ্গ সময় এখন। কীভাবে সহযোগীদের নিয়ে একসঙ্গে থাকা যায়- সেই চেষ্টাটা চলছে। দল বা পার্টির নীতি ও কথার লাইন নিয়ে কেউ ভাবতেই চাইছে না। এর মধ্য দিয়ে অন্য লাইনের বক্তব্য বিএনপির ময়দানে সহজেই সচল হয়ে উঠছে। চট্টগ্রামে ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশে অন্য অনেক নেতার নাম উল্লেখ করা হলেও জিয়াউর রহমানের নাম উচ্চারণ না করার কথা বলে বি চৌধুরী খোঁচা দিয়ে বলেছেন,‘বিএনপি কি আত্মসমর্পণ করেছে?’ বি চৌধুরীর এই খোঁচাটা কতটুকু প্রাসঙ্গিক, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু প্রসঙ্গটা রাজনীতির জন্য অবশ্যই ছোট নয়।
আওয়ামী লীগ বা বিএনপির সঙ্গে ডানপন্থী দল, ইসলামি আদর্শপন্থী ব্যক্তি ও দলগুলির একটি দায়িত্ব হলো, মত-পথ ও নীতির এই ধূসরতার সময়ও নিজেদের কথা ও নীতির লাইনটাকে সামনে রাখা। বাম- আধাবামেরা লাইন ঠিক রেখে কথা বলতে তো পিছিয়ে থাকছে না। ডানেরাও যেন পিছিয়ে না থাকেন। ক্ষমতায় যাওয়ার বস্তুবাদী যুদ্ধে যারা যুক্ত, তারা যদি তুমুল উত্তেজনার সময়েও নীতি ও কথার লাইন ধরে রাখার ব্যাপারটিতে শেয়ানা থাকতে পারেন, তাহলে এই একমুখী পথচলার মধ্যেই ইসলামি নীতি-মূল্যবোধের জায়গাটাকে একদম অনাবাদ ফেলে রাখা কিংবা ঢেকে ফেলার সুযোগ দেওয়া ইসলামপন্থীদের জন্যও উচিত হবে না। ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য এটা সুন্দর দৃষ্টান্তের কারণ হবে না। বরং ধাবমান রাজনীতির একমুখি উত্তেজনার সময় কেবল আদর্শের জায়গাটা ছেড়ে দেওয়ার গল্পের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। ইসলামের নীতি-আদর্শের রাজনীতির ময়দানে এ রকম গল্প তো আমরা চাইতে পারি না।
