ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতের রায় থেকে বিশ্ববাসী যথার্থ বার্তাটা নিতে পারে : অধ্যাপক ড. হাফেজ এবিএম হিজবুল্লাহ

সম্প্রতি ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালত রায় দিয়েছেন যে, ‘বাকস্বাধীনতার নামে মুহাম্মদ সা.-এর সমালোচনা গ্রহণযোগ্য নয়’। আদালত মুহাম্মদ সা.-এর সমালোচনাকে ফৌজদারি অপরাধ গণ্য করে এক অস্ট্রিয়ান নারীকে ৪৮০ ডলার অর্থদণ্ড দিয়েছে।

ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতের এ ঐতিহাসিক রায়ের যৌক্তিকতা, মুসলিমদেশগুলোর তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ এবং সাধারণ মুসলমানের জন্য করণীয় ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলেছেন কুষ্টিয়া ইসলামিক ইউনিবার্সিটির আল কুরআন ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক হাফেজ মাওলানা এবিএম হিজবুল্লাহ। ইসলাম টাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষে তার সঙ্গে কথা বলেছেন আতাউর রহমান খসরু

ইসলাম টাইমস : ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালত রায় দিয়েছে, বাকস্বাধীনতার নামে মুহাম্মদ সা.-এর সমালোচনা গ্রহণযোগ্য নয়। কেউ কেউ বুঝতে চায় না তিনি সমালোচনার উর্ধ্বে কেন?

ড. এবিএম হিজবুল্লাহ : আমরা যারা মুহাম্মদ সা.-কে আল্লাহর নবী হিসেবে বিশ্বাস করি। তাদের নিকট তিনি অবশ্যই সমালোচনার উর্ধ্বে। এ রায় আমাদের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু যারা তাকে রাসুল হিসেবে বিশ্বাস করেন না তাদের জন্য তা কতোটা কার্যকর হবে তা আমি জানি না। কারণ, সবযুগেই কাফির ও মুশরিকরা নবী-রাসুল আ.-এর সমালোচনা করেছিলো। কুরআনেও তা এসেছে।

আমরা তাদের বোঝানোর চেষ্টা করবো, রাসুল সা. শুধু মুসলমানের নবী নন। তিনি কেয়ামত পর্যন্ত আগত সব মানুষের নবী। সুতরাং তিনি অবশ্যই সমালোচনার উর্ধ্বে।

আমরা আরও বলতে পারি, মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করার পূর্বে তোমরা তাকে জানার ও বোঝার চেষ্টা কর, তার জীবন-ইতিহাস ভালোভাবে অধ্যয়ন করে নাও। এরপর কিছু বলার থাকলে বলবে। আর তাও হতে হবে একটা সীমার মধ্যে থেকে। কারণ, একজন ওহিপ্রাপ্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে কতোটুকু বলা যায় তা অবশ্যই ভাবার বিষয়।

ইসলাম টাইমস : মুহাম্মদ সা.-এর সমালোচনা অগ্রহণযোগ্য হওয়ার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় আদালতের যুক্তি হলো এর সঙ্গে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি জড়িয়ে আছে। তার সমালোচনা হলে সমাজের ধর্মীয় শৃংখলা নষ্ট হবে। ইসলাম মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা ও না করার ব্যাপারে কী বলে?

ড. এবিএম হিজবুল্লাহ : ইসলাম মানুষকে আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে সম্মান করে। কিন্তু তারা যদি ইসলামের মৌলিক বিষয় তাওহিদের উপর প্রতিষ্ঠিত না থাকে তবে তারা সমালোচনার যোগ্য। এখন পৃথিবীব্যাপী একটি কথা বলা হচ্ছে ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না হানা’। এখানে ধর্ম বললে সেসব ধর্মও চলে আসে যাকে ইসলাম স্বীকার করে না। অর্থাৎ পৌত্তলিক ধর্মগুলো। সে ক্ষেত্রে একটা জটিলতা তৈরি হয়।

বিষয়টি এমনভাবে বলা দরকার যে, ধর্মীয় অনুভূতি বা বিশ্বাস তাওহিদের পরিপন্থী না হওয়া পর্যন্ত তার উপর আঘাত হানা যাবে না। তাওহিদের উপর প্রতিষ্ঠিত না হলে সেটা ধর্ম হিসেবেই বিবেচ্য নয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা কঠোর ভাষায় পৌত্তলিকদের সমালোচনা করেছেন। এখন যদি তাওহিদের পরিপন্থী বিষয়ের সমালোচনা করলে বলা হয় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা হয়েছে তাহলে তো সত্যই প্রকাশ করা যাবে না। সাধারণভাবে যদি বলা হয় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা যাবে না তাহলে মুশরিকরাও এর অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু ইসলাম তো সেটা স্বীকার করে না।

ধর্মীয় অনুভূতির সীমা হবে আল্লাহ কর্তৃক অবতীর্ণ ও স্বীকৃত ধর্মীয় বিশ্বাস। যেমন ঈসা আ., মুসা আ.-সহ অন্য নবীদের আমরা কিছু বলি না। কারণ, তারা আল্লাহ কর্তৃক স্বীকৃত।

আরও পড়ুন : বাক স্বাধীনতার নামে মুহাম্মদ সা.-এর সমালোচনা গ্রহণযোগ্য নয়

ইসলাম টাইমস : এই রায় দেয়া হয়েছিলো, একজন নারীর বিরুদ্ধে যিনি রাসুল সা. ও হজরত আয়েশা রা.-এর বিয়ের সমালোচনা করেছিলো। তার মতে এই বিয়ে ছিলো ‘সেক্সচুয়াল ভায়োলেন্স’ ও যৌন নিপীড়ন (নাউযুবিল্লাহ)। আদালত তার এ সমালোচনাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছেন এবং তাকে অর্থদণ্ড তথা জরিমানা করেছেন। ইসলামের দৃষ্টিতে রাসুল সা.-এর সমালোচনা কি ফৌজদারি অপরাধ না নৈতিক অপরাধ?

ড. এবিএম হিজবুল্লাহ : আমি আইনী ধারার লোক না। সুতরাং এটা ফৌজদারি অপরাধের মধ্যে পড়ে কি না সে বিষয়ে মন্তব্য করবো না। তবে এটা যে নৈতিক অপরাধ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। একজন পবিত্র মানুষ যার জীবনে কোনো কলঙ্ক নেই, কোনো দাগ নেই, অন্যায় আচরণ নেই এবং অমানবিকতা নেই তার ব্যাপারে এমন নগ্ন সমালোচনা সম্পূর্ণ অনৈতিক। শুধু আমাদের নবী সা. নয়, যে কোনো মানুষের ক্ষেত্রেই তা অন্যায়।

একজন মানুষ যিনি বিধিসম্মতভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন তার বিবাহকে যৌন নিপীড়ন বলা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।

ইসলাম টাইমস : ইসলামি দণ্ডবিধিতে এমন সমালোচনা কি ক্রিমিনাল ল’ (ফৌজদারি আইন)-এর আওতায় পড়ে?

ড. এবিএম হিজবুল্লাহ : ক্রিমিনাল ল’ বলেন আর ফৌজদারি আইন বলেন, একজন মানুষের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন করে তাকে মানুষের সামনে হেয় প্রতিপন্ন করা, অপমান করা কোনো ধর্মই তা সমর্থন করবে না এবং কোনো মানুষ তা মানবে না। এটা অবশ্যই অপরাধ।

শরিয়তে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আর মানুষ হিসেবে দেখলেও বলতে হবে, তার সমালোচনা সম্পূর্ণ অনৈতিক।

ইসলাম টাইমস : ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালত তার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছে, ‘ধর্মবিশ্বাস সমালোচনার যোগ্য’। আপনিও বললেন ইসলাম পৌত্তলিক ধর্মবিশ্বাসের সমালোচনা করার অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু ইসলাম নিজের সমালোচনার ব্যাপারে কী বলে?

ড. এবিএম হিজবুল্লাহ : যারা মুসলিম এবং যারা তাওহিদ-রিসালাতে বিশ্বাস করে, আখেরাতে বিশ্বাস করে তারা কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস দ্বারা প্রমাণিত কোনো বিধানের সমালোচনা করার অধিকার রাখে না। তাদেরকে সে সুযোগ দেয়াই হয়নি। ঈমানের দাবিই হলো আল্লাহর নিকট নিজেকে সমর্পণ করা, আল্লাহর রাসুল সা.-কে সর্বান্তকরণে মেনে নেয়া, আখেরাতকে মেনে নেয়া, শরিয়াতের আইন-কানুন মেনে নেয়া। মেনে নেয়ার পর আবার সমালোচনা কী?

আর যারা ইসলামে বিশ্বাস করে না তারা ইসলামের অনুমতির অপেক্ষা করবে না। তবে নৈতিক জায়গা থেকে তাদের সে সুযোগ অবশ্যই নেই। কারণ ইসলাম আল্লাহ কর্তৃক চূড়ান্ত ও মনোনীত ধর্ম।

ইসলাম টাইমস : অন্যের সমালোচনার ক্ষেত্রে ইসলাম কোনো সীমা নির্ধারণ করেছে কি?

ড. এবিএম হিজবুল্লাহ : হ্যা করেছে। সীমাটা হলো, আপনি অন্যের ধর্মের সমালোচনার ক্ষেত্রে যদি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তাহলে তারাও আপনার ধর্মের সমালোচনা করবে। এমন সমালোচনা থেকে বিরত থাকা উচিৎ। অন্যের সমালোচনা করতে গিয়ে আপনি ইসলামকে সমালোচনার পাত্র বানাবেন না। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, (অর্থ) ‘তারা আল্লাহ ব্যতীত অন্য যাদের ইবাদত করে তাদের তোমরা গালি দিও না। তাহলে তারাও অজ্ঞতা ও শত্রুতাবশত আল্লাহকে গালি দিবে।’

আমি বলছি, অন্য ধর্ম সমালোচনার যোগ্য তবে রাগের বশবর্তী হয়ে যা ইচ্ছে তাই বললে, অযৌক্তিক সমালোচনা করলে তারাও ক্রোধান্বিত হবে এবং ইসলামের উপর নগ্ন হামলা করবে। সীমার মধ্যে থেকেই তাদের অসারতা প্রমাণ করতে হবে। এরপর তারা না মানলে সেটা আল্লাহর দায়িত্বে।

ইসলাম টাইমস : ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আইনি প্রতিষ্ঠান। এ আদালত যখন সিদ্ধান্ত দিলেন, মুহাম্মদ সা.-এর সমালোচনা বাকস্বাধীনতার অন্তর্ভূ্ক্ত নয়, তখন মুসলিম দেশগুলো এ রায় থেকে কি সিদ্ধান্ত নিতে পারে? তারা এ রায় অনুসরণ করতে পারবে কি না?

ড. এবিএম হিজবুল্লাহ : এ রায় অবশ্যই অনুসরণ করার সুযোগ আছে। আমি বরং বলবো, এ রায় প্রদানের ফলে অবশেষে তারা মেনে নিয়েছে মুহাম্মদ সা. সমালোচনার উর্ধ্বে। মুসলমানের জন্য তো মুহাম্মদ সা.-এর সমালোচনার সুযোগই নেই। অন্যদের জন্য এ রায়ের বার্তা হলো, তোমরা এই মহামানব সম্পর্কে একটু ভাবো, তার সম্পর্কে কোনো কথা বলার আগে ভেবে দেখবে।

ইসলাম টাইমস : আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের পর আমাদের দেশের ইসলামি রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠনগুলো এমন একটি আইন প্রণয়নের দাবি জানাতে পারে কি?

ড. এবিএম হিজবুল্লাহ : অবশ্যই পারে। তারা বলতেই পারে। যদিও আমরা এ রায়ের মুখাপেক্ষী নই।এবং এ রায়ে শাস্তির মাত্রাটা খুবই সামান্য। তবে এ রায় আমাদের দাবির সপক্ষে একটি শক্তিশালী যুক্তি ও প্রমাণ।

ইসলাম টাইমস : এ বিষয়ে আপনি আর কিছু যোগ করতে চান কিনা?

ড. এবিএম হিজবুল্লাহ : হ্যা, আমি বলবো এখন শিশু বিয়ের বিরুদ্ধে নানান কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু বিয়ে না করেও তাদের সঙ্গে আরও নিকৃষ্ট আচরণ করা হচ্ছে। তাদের বেলায় কী হবে? একটি বৈধ বিষয়কে নিষিদ্ধ করে এবং একটি নিকৃষ্ট বিষয় ও নিপীড়নকে নীরবে সহ্য করা হচ্ছে, সহ্য করতে বলা হচ্ছে। শিশু বিয়ের আলোচনা এলে পৃথিবীর বহু মনীষীর নাম চলে আসবে। যাদের ব্যাপারে তারা চুপ করে থাকে। সুতরাং আহবমান কাল থেকে চলে আসা একটি রীতিকে হাতিয়ার বানিয়ে মুহাম্মদ সা.-এর চরিত্রের উপর কালিমা লেপনের চেষ্টা নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়।

আরও পড়ুন : ভোটের রাজনীতিতে কওমি স্বীকৃতির প্রভাব কতটা পড়বে

পূর্ববর্তি সংবাদআওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এলে দেশ পিছিয়ে পড়বে : প্রধানমন্ত্রী
পরবর্তি সংবাদজবরদখলের ৭১ বছর : জম্মু-কাশ্মির ‘কালো দিবস’ পালিত