মানুষকে জিম্মি করে দাবি আদায়ের আন্দোলন : দায় কার?

আতাউর রহমান খসরু ।। 

চলতি বছরের শুরু থেকে পর পর কয়েকটি আলোচিত সড়ক দুর্ঘটনা সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। দেশের মিডিয়াতেও ব্যাপক আলোচিত হয় ঘটনাগুলো। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রতিদিন ও প্রতিমাসের সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান প্রকাশ করতেও দেখা যায় তখন।

এর মধ্যেই গত ২৯ জুলাই ঢাকার শহীদ রমিজ উদ্দীন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালে দেশের সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। নিরাপদ সড়কের দাবিতে সারা দেশের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। তাদের প্রকাশ্য ও নৈতিক সমর্থন দেয় সমাজের বৃহৎ একটি অংশ। দেশব্যাপী এ আন্দোলন ২৯ জুলাই শুরু হয়ে ৭ আগস্ট পর্যন্ত চলমান থাকে।

ব্যাপক আন্দোলনের মুখে সরকার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড রেখে জাতীয় সংসদে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ পাশ করে। কিন্তু তাতে আপত্তি জানায় পরিবহন শ্রমিকরা। তারা আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধনের দাবি করে। তবে নির্বাচনের আগে কোনো ধরনের আইনি সংশোধন আনা সম্ভব নয় বলে জানানো হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।

গতকাল থেকে সংসদে সদ্য পাশ হওয়া সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ সংশোধনসহ ৮ দফা দাবি আদায়ে আন্দোলন করছে পরিবহন শ্রমিকরা। শ্রমিক ফেডারেশনের আহবানে সারা দেশে ৪৮ ঘণ্টার কর্মবিরতি পালন করছে তারা। আজ সোমবার যাচ্ছে এ আন্দোলনের দ্বিতীয় দিন। শ্রমিকদের এ ধর্মঘটের পরিণতি কী হবে-তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

আইনের ধারাগুলোর মধ্যে শ্রমিকদের আপত্তির বিষয়গুলো হলো, মোবাইল কোর্ট, সড়ক দুর্ঘটনার মামলা জামিন অযোগ্য হওয়া, ৫ লাখ টাকা জরিমানা ইত্যাদি।

দৃশ্যমান এ আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে হলেও অনেকেই মনে করছেন শ্রমিক ধর্মঘটে সরকারের ভেতরের কারো কারো আশীর্বাদ রয়েছে। কারণ, কর্মবিরতি ঘোষণাকারী শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি সরকারের প্রভাবশালী ও দায়িত্বশীল একজন মন্ত্রী। সাথে সাথে এ সমস্যার সমাধানে সরকারের কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপও নেই, অভিযোগ অনেকের।

অন্যদিকে ৪৮ ঘণ্টার শ্রমিক ধর্মঘটে নাকাল হচ্ছে নাগরিক জীবন। মানুষ কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে পারছে না, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। একান্ত মানবিক কারণগুলোও উপেক্ষা করছে আন্দোলনরত শ্রমিকরা। জরুরি ওষুধ, খাদ্য, পানীয় সরবরাহের সুযোগও দিচ্ছে না তারা। ফলে সীমাহীন দুর্ভোগ ও ভোগান্তি নেমে এসেছে নাগরিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। গণমাধ্যমে এসেছে, গতকাল অ্যাম্বুলেন্স আটকে দেয়ায় সাতদিন বয়সী এক কন্যাশিশুর মৃত্যু হয়েছে মৌলভিবাজারের বড়লেখা এলাকায়।

উপরন্তু শ্রমিকরা প্রাইভেট গাড়ি ও অটোরিক্সার চালক, স্কুলগামী শিশুদের মুখে-গায়ে পোড়া মবিল মাখিয়ে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করছে। কোথাও কোথাও শারীরিকভাবে লাঞ্ছনার সংবাদও পাওয়া যাচ্ছে। তবুও প্রশাসন নির্বিকার।

সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে এভাবে দাবি আদায় কতোটা যৌক্তিক? চিন্তাশীল আলেম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মুফতি মুহাম্মদ গোলাম রব্বানি মনে করেন, একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশে এভাবে কর্মবিরতির অবকাশ আছে। তবে যদি যুক্তিগুলো অযৌক্তিক হয় তবে সে সুযোগ আর থাকে না।

তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি তাদের দাবিগুলো অযৌক্তিক। তাদের দাবির মূলকথা হলো, সড়কে আমরা যেভাবে খুশি চলবো কিন্তু আমাদের নিয়ন্ত্রণের কোনো চেষ্টা করা যাবে না। বাংলাদেশে প্রতিদিন যে পরিমাণ দুর্ঘটনা ঘটছে তার প্রধান কারণ গাড়িচালকের বেপরোয়া গতি ও অসুস্থ প্রতিযোগিতা। জনস্বার্থেই এটা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।’

মারকাযুদ্দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকার শিক্ষক মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আবদুল্লাহও মনে করেন, মানুষকে কষ্ট দিয়ে কোনো দাবি আদায়ের সুযোগ নেই। মানুষকে কষ্ট দেয়া নৈতিকতা ও চারিত্রিক দিক থেকে অনেক নিন্দনীয় বিষয়।

মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আবদুল্লাহ ও মুফতি মুহাম্মদ গোলাম রব্বানি উভয়ে ধর্মঘটরত শ্রমিকদের পক্ষ থেকে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি এবং তাদের সঙ্গে একমত নয় এমন পরিবহন শ্রমিকদের কর্মবিরতি পালনে বাধ্য করার নিন্দা করেন।

মুফতি গোলাম রব্বানি বলেন, ‘নৈতিকতার জায়গা থেকে জনগণকে জিম্মি করার সুযোগ নেই। বিশেষত তারা অনেকের ওপর এ আন্দোলন চাপিয়ে দিচ্ছে বলে জানতে পেরেছি। যেমন, প্রাইভেট কারের চালকদের মুখে পোড়া মবিল লাগিয়ে দেয়া। আজ আমি ভার্সিটির ক্লাসে গিয়ে দেখি অনেকেই আসেনি। তারা ভয়ে আসেনি। এমন ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা অবশ্যই অন্যায়।’

যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে শরিয়তের নির্দেশনা তুলে ধরে মাওলানা যাকারিয়া বলেন, ‘গ্রহণযোগ্য দাবি আদায়ের পন্থাও গ্রহণযোগ্য হতে হবে। অগ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে তা আদায় করা যাবে না।’

সাধারণ মানুষ যেভাবে নিগৃহীত হচ্ছে তা থেকে বাঁচার উপায় কী? মাওলানা যাকারিয়া এ সমস্যার সমাধানে প্রশাসন ও সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা আশা করেন। তার ভাষায়, যেহেতু বিষয়টি সামাজিক রূপ নিয়েছে, বড় আকারে হচ্ছে সামাজিকভাবেই এর প্রতিরোধ করা, নিরসন করা এবং সমাজে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন।

‘দায়িত্বশীলদের কর্তব্য হলো, সমাজে যেন বিশৃংখলা ছড়িয়ে না পড়ে এবং মানুষের জান-মাল হুমকির মুখে না পড়ে সেদিকে লক্ষ্য রাখা। মানুষের স্বস্তি, শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সুতরাং এ ক্ষেত্রে কোনো অবহেলা হলে তার দায় তাদের উপর পড়বে।’ যোগ করেন মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আবদুল্লাহ।

কিন্তু মুফতি গোলাম রব্বানি এখানে রাষ্ট্রের দায়িত্বটাই বড় করে দেখতে চান। তার মতামত হলো, ‘রাষ্ট্র চাইলে এসব আতঙ্ক সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে সক্রিয় হতে পারে এবং বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে প্রচুর গাড়ি নামিয়ে জনগণের ভোগান্তি কমাতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্র কেন চাচ্ছে না সেটা বোঝা যাচ্ছে না।’

আজকের এই সমস্যাটার সমাধানই কি শেষ কথা, নাকি আরও কিছু বিষয় আছে এখানে যা নিয়ে ভাববার অবকাশ আছে? মাওলানা যাকারিয়া মনে করেন, মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে দাবি আদায়ের মানসিকতার ব্যাপারটি নিয়ে অবশ্যই ভেবে দেখা প্রয়োজন।

তিনি বলেন, ‘আমাদের সমাজচিন্তকদের ভালোভাবে চিন্তা করা দরকার – মানুষের মধ্যে এই প্রবণতা তৈরি হচ্ছে কেন যে, তারা অন্যায়ভাবে মানুষকে কষ্ট দিবে, মানুষকে জিম্মি করে রাখবে, মানুষের ক্ষতিসাধন করবে। এটা কোনোভাবিই সমর্থনযোগ্য না। এ মানসিকতার অবসান প্রয়োজন।’

পূর্ববর্তি সংবাদভারতে বাবরি মসজিদ মামলার শুনানি শুরু, দেশ তাকিয়ে শীর্ষ আদালতের দিকে
পরবর্তি সংবাদপাবনায় ট্রেন থেকে পড়ে যুবকের মৃত্যু