গুম, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও নির্বাচন নিয়ে বার্নিকাট যে পর্যবেক্ষণ দিলেন

সংগৃহিত ছবি

ইসরাম টাইমস ডেস্ক: বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন শেষে ফিরে যাচ্ছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেন ব্লুম বার্নিকাট। আর্ল রবার্ট মিলারকে তার উত্তরসূরী নিয়োগ দিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

গতকাল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাৎ-ও সম্পন্ন করেছেন মার্শা বার্নিকাট। সম্প্রতি তিনি ঢাকার সংবাদপত্র প্রথম আলোর ঢাকাস্থ কার্যালয়ে যান এবং একটি সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্ক, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি, বাংলাদেশের চলমান উন্নয়ন প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক সংকট নিয়ে কথা বলেন।

সাক্ষাৎকারে বার্নিকাট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়ের যেমন প্রসংশা করেছেন, ঠিক তেমনি দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা, মতপ্রকাশের সুযোগ সংকুচিত হওয়া এবং নির্বাচন রাজনীতির সংকট নিয়ে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। মূলত তার বক্তব্যে বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন সরকারের মনোভব ও দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে।

বাংলাদেশের বর্তমান আর্থিক উন্নয়ন বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা কিন্তু ব্যাপকভাবে স্বীকৃত যে বাংলাদেশের অনেক সামর্থ্য রয়েছে এবং এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশ অনেকখানি এগিয়ে গেছে।’

তবে তিনি বাংলাদেশকে কৃষিখাতের প্রতি মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন। বার্নিকাট বলেন, ‘আজ আপনারা যেখানে আছেন, তা কিন্তু আপনাদের পুরোপুরি মধ্যম আয়ের দেশে নিয়ে যেতে পারবে না। তাই কৃষি অর্থনীতি, তথ্যপ্রযুক্তি, হালকা ইলেকট্রনিক শিল্প, জাহাজনির্মাণ শিল্প, ওষুধশিল্প- এ সবকিছু মিলিয়েই বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ। … কখনো কখনো বাংলাদেশের অগ্রগতির জন্য কৃষিকে সেভাবে কৃতিত্ব দেওয়া হয় না।’

বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম ও মতপ্রকাশের সুযোগ সংকুচিত হওয়া সম্পর্কিত এক প্রশ্নের উত্তরে বার্নিকাট কিছুটা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘মতপ্রকাশের এবং আন্দোলনের অধিকারের জন্য আমাদের লড়াই করতে হয়েছে। আমাদের সম্পর্কের মৌলিক ভিত্তিই হচ্ছে আইনের শাসন আর গণতান্ত্রিক মূলবোধের প্রতি শ্রদ্ধা।’

একই প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরও বলেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, নিবর্তনমূলক গ্রেফতার, নির্যাতন, হত্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে দূতাবাস ও আমি ব্যক্তিগতভাবে বিবৃতি দিয়ে আমাদের উদ্বেগ জানিয়েছি। এ বিষয়গুলোর কারণে সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা কমে যায় এবং তা সরকারের মূলনীতি ও সংবিধানের প্রতি সহায়ক নয়। এরপরও এসব ঘটছে। অনেক ক্ষেত্রেই সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি।’

বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর উদ্বেগ রয়েছে বলে জানান বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত।

তিনি বলেন, ‘জনসংখ্যার আকার, ভূকৌশলগত অবস্থান- এসব মিলিয়েই বাংলাদেশের স্থিতিশীল থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। সমৃদ্ধির সঙ্গে স্থিতিশীলতা যুক্ত। তাই মানবাধিকার লঙ্ঘন স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির অর্জনকে খাটো করে। তাই আমাদের অধিকাংশ বন্ধু মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগগুলো তুলে ধরেন।’

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বিষয়ে সম্পাদকদের আপত্তির জায়গাগুলো বিবেচ্য বলেও মন্তব্য করেন বিদায়ী রাষ্ট্রদূত। এ সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আপনাদের মতো দুই বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রও সরকারের বিভিন্ন প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনায় এই আইন নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। সম্পাদকেরা যেসব বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, আমাদের এ বিষয়গুলোতে উদ্বেগ রয়েছে। গণতন্ত্রে আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জগুলো জটিল। একদিকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হয়। আবার অন্যদিকে জনসমক্ষে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে জনগণের সুরক্ষার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হয়।’

একই প্রশ্নের উত্তরে তিনি ফেসবুকের মাধ্যমে মিয়ানমারে জাতিগত নির্মূল উসকে দেওয়ার নিন্দা করেন।

বার্নিকাট মনে করেন বাংলাদেশে মানুষের মতপ্রকাশে সুযোগ আরও বিস্তৃত হওয়ার প্রয়োজন। তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে প্রধান উদ্বেগটা হচ্ছে এর প্রয়োগ কী মাত্রায় হবে। আমরা কী লোকজনকে প্রকাশ্যে হুমকি দেওয়া থেকে নিবৃত্ত করতে চাই? উত্তরে সবাই বলবেন, হ্যাঁ। আমরা কী চাই যে কেউ বলতে পারবে যে, সে এই সরকারকে চায় না অথবা এই সরকার নিরপেক্ষ নয়? হ্যাঁ, আমরা চাই লোকজন যাতে সেটা বলার অধিকার পায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের করা আইন অন্যায়ভাবে এবং মাত্রাতিরিক্তভাবে প্রয়োগ হতে পারে- এমন উদ্বেগ ও আশঙ্কা রয়েছে। এমন যাতে না হয়, সে জন্য বাংলাদেশের নাগরিকদের মতোই আমরা সরকারের কাছে আকুতি জানাই।’

বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের সম্ভাবনা নিয়ে করা অপর এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘প্রচলিত ধারণার কারণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনার ব্যাপারে অনেকের মধ্যে অস্বস্তি রয়েছে। এই বাস্তবতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।’

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে স্বাধীন রাজনীতি চর্চার সুযোগ দেয়ার আহবান জানিয়েছেন মার্শা বার্নিকাট।

তিনি বলেন, বিরোধী ও সরকারি দলসহ সবাইকে শান্তিপূর্ণভাবে ছোট-বড় সমাবেশ করার সুযোগ দিতে হবে। তাদের কোনোভাবেই হেনস্তা করা যাবে না। প্রত্যেক নাগরিকের ভোট দেওয়ার অধিকার রয়েছে। নির্বাচনের পরিস্থিতি নিয়ে যদি জনগণের মধ্যে ভয় কাজ করে, তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে নিরাপত্তা দাবি করার অধিকার তাদের রয়েছে। সহিংসতা এড়ানো ও সহিংসতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার দায়িত্ব সব দলেরই।’

সবশেষে তিনি বলেন, যদি প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশে কি ডিসেম্বরে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে? উত্তর হচ্ছে, অবশ্যই। এ ধরনের নির্বাচনের জন্য পরিবেশ সৃষ্টির জন্য প্রত্যেককে দায়িত্ব নিতে হবে।

পূর্ববর্তি সংবাদ‘মক্কা মান সময়’-এর দিন!
পরবর্তি সংবাদটাঙ্গাইলের ধনবাড়ি নওয়াব বাড়ি : ইতিহাসের ছবি