প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাজনৈতিক দলের সংলাপ কতোটা ফলপ্রসূ হবে?

আতাউর রহমান খসরু ।। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকেই বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে একটি ফলপ্রসূ সংলাপের দাবি জানিয়ে আসছিলো। কিন্তু সরকার তার অবস্থানে অনঢ়।

বিএনপির নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবির বিপরীতে সরকার বরাবরই বলে আসছে, সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। সরকার ও বিএনপির পারস্পরিক এ বিরোধের মধ্যেই কেটে যাচ্ছে মহাজোট সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের পাঁচ বছর।

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের পূর্বেই দাবি আদায়ে বিএনপি জোট করে ড. কামালদের সঙ্গে। ড. কামালের নেতৃত্বে গঠিত হয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এ জোটে একদিকে বিএনপি ড. কামালকে নেতৃত্ব ছেড়ে দেয়, অন্যদিকে ড. কামাল খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বিএনপির প্রধান প্রধান দাবিগুলো জোটের দাবি হিসেবে ঘোষণা করে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে নীতিগত সমর্থন দেয়।

ভোটের রাজনীতিতে ড. কামালদের গুরুত্ব খুব বেশি না হলেও বিএনপির সঙ্গে তাদের জোট আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয় এবং সরকারের ভেতর অস্বস্তি তৈরি করে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা নবগঠিত জোটের তীব্র সমালোচনা করেন।

এর মধ্যেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সিলেট ও চট্টগ্রামে মহাসমাবেশ করে এবং সরকারের সকল প্রকার অসহিষ্ণু আচরণের পরও তাতে বিপুল জনসমাগম হয়। মহাসমাবেশে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আওয়ামী লীগকে সংলাপে বসার আহবান জানায়। সংলাপে বসার আহবান জানিয়ে সরকারকে চিঠিও দেয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের চিঠির উত্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ১ নভেম্বর জোট নেতাদের বৈঠকের আমন্ত্রণ জানান। প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগকে স্বাগত জানান দেশের রাজনীতিক ও রাজনীতি বিশ্লেষকরা। তারা দীর্ঘ অচলাবস্থার পর এ সংলাপে আশার আলো দেখতে পান। তবে প্রধানমন্ত্রীর চিঠিতে লেখা ‘সংবিধানসম্মত সকল বিষয়ে’ বাক্য নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে রাজনীতিকদের মধ্যে। সরকার দলীয় ও বিরোধী দলীয় উভয়পক্ষের নেতারা বাক্যটি নিয়ে সংশয়মিশ্রিত ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।

একদিকে সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন, সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোনো আলোচনা হবে না। অর্থাৎ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অথচ বিরোধীদের প্রধান দাবি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। অপরদিকে অন্যতম বৃহৎ দল বিএনপি বলছে খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে সংলাপ ফলপ্রসূ হবে না। তাই বলা যায়, উভয়পক্ষ সংলাপে আগ্রহী হলেও সংলাপ নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন সংশয়।

কতোটা সফল হবে আগামীকালের সংলাপ? এ সংশয়ের উত্তর খুঁজেছিলাম ইসলামি ধারার দুই রাজনীতিকের কাছে। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক প্রধানমন্ত্রীর এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘প্রতিহিংসার রাজনীতির বিপরীতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার পথ সংলাপ। সুতরাং আমি এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। আমার দল বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে।’

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক মিত্র। জাতীয় পার্টি ইতোমধ্যে সংলাপের আগ্রহ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়েছে। জাতীয় পার্টি কি এ বিষয়ে তার শরিকদের সাথে আলোচনা করেছে? নাকি এটা জাতীয় পার্টির নিজস্ব অবস্থান? মাওলানা মাহফুজুল হক বলেন, ‘ব্যক্তিগত প্রয়োজনে আমি কয়েকদিন ঢাকার বাইরে ছিলাম এবং দলীয় কার্যক্রম থেকে দূরে ছিলাম। তাই বলতে পারছি না এ বিষয়ে আমাদের সঙ্গে জাতীয় পার্টি যোগাযোগ করেছে কি না। তবে বিস্তারিত আলোচনা যে হয়নি সেটা নিশ্চিত। কারণ তাহলে আমি অবশ্যই জানতাম।’

আপনার দলটি পৃথকভাবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপে বসবে? ‘এটি দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয়। এককভাবে মত দেয়ার সুযোগ নেই।’

একই প্রশ্নের উত্তর মাওলানা মাহফুজুল হকের মতোই উত্তর দেন খেলাফত মজলিসের মহাসচিব অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের। তিনি বলেন, ‘আজ আমাদের একটি দলীয় বৈঠক আছে। সেখানে আলোচনায় ঠিক হবে পৃথকভাবে যাবো কি না।তবে আমরা সংলাপকে স্বাগত জানাই।’

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আওয়ামী লীগের মিত্ররা যদি পৃথকভাবে সংলাপে অংশগ্রহণ করে তবে বিএনপির মিত্ররাও দাবির পাল্লা ভারি করতে পৃথকভাবে সংলাপে বসবে। সংলাপ শুধু আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হলেও বসবে তারা। এমনটাই ইঙ্গিত করেন বিএনপির ২০ দলীয় জোটের নেতা ড. আহমদ আবদুল কাদের। তিনি বলেন, ‘সরকারের ঘনিষ্ঠ মিত্র জাতীয় পার্টিকে সংলাপে ডেকে সরকার সংলাপকে পোশাকি করার চেষ্টা করছে। তবুও আমরা সংলাপে বসা ভালো মনে করি। তারা দাবি মানুক আর না মানুক।’

অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদেরের কথা বারবার হতাশায় ফুটে উঠছিলো। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকার সংবিধানের কথা বলছে। বিরোধী দলের সংবিধানের মধ্যে থেকেই অধিকাংশ দাবি মেনে নেয়া সম্ভব। যেমন, সংসদ ভেঙ্গে দেয়া, ইভিএম বন্ধ করা, মামলা স্থগিত করা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষেত্রে একটু সমস্যা সমস্যা আছে। শর্ত হলো সরকারের আন্তরিকতা থাকবে হবে। আর আমরা সেটাই দেখছি না।’

সংলাপের উদ্যোগ কি আন্তরিকতার প্রকাশ নয়? খেলাফত মজলিসের মহাসচিব বলেন, ‘সংলাপের ব্যাপারে সরকারের আন্তরিকতা যতোটুকু আছে তা দাবি মানার ক্ষেত্রে নেই। সরকারি দলের সিনিয়র নেতাদের মনোভাব থেকে তাই বোঝা যাচ্ছে।’

মাওলানা মাহফুজুল হক সংলাপের ফলাফল নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলেও এখনি হতাশ হতে রাজি নন। তিনি বলেন, ‘একটা সংশয় তো আছেই। তবুও বলবো, সংলাপ না হওয়ার চেয়ে হওয়াটাই ভালো।’

তিনি আরও বলেন, ‘আগাম মন্তব্য করা ঠিক হবে না। পূর্বে আওয়ামী লীগ রাজিই হয়নি। এখন রাজি হয়েছে। হতে পারে সংলাপে বসার পর ভিন্ন বা আশাব্যঞ্জক কোনো ফলাফল আসবে। সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।’

মাওলানা মাহফুজুল হকের সামনে সরকার দলীয় নেতারা ‘সংবিধানের সীমাবদ্ধতা’ নিয়ে যে বক্তব্য দিচ্ছে তা তুলে ধরলে তিনি বলেন, ‘সবাই নিজের স্বার্থ সংরক্ষণের চেষ্টা করবে। সে হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতাদের সংবিধানের সীমাবদ্ধতার কথা বলাটাই স্বাভাবিক।’

হঠাৎ করে সরকার কেন সংলাপে রাজি হলো? এমন প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের দাবি করেন বিরোধী দলের প্রতি জনসমর্থনের চাপেই সরকার সংলাপে রাজি হয়েছে। তার ভাষায় ‘আগের দিন বলেছে, কিছুই মানবে না, পরের দিন সংলাপের আহবান জানিয়েছে। জনসমর্থনের চাপেই করেছে।’

আর মাওলানা মাহফুজুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই সংলাপ দাবি করেছিলো। মহাজোটের অংশিদার দলগুলো পর্যন্ত সংলাপ চেয়েছিলো। সরকার সবার দাবির মুখেই হয়তো রাজি হয়েছে।’ সংলাপ সরকার যে কারণেই করুক, তা পোশাকি না হয়ে ফলপ্রসূ হোক এবং সাধারণ মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাক সেটাই প্রত্যাশা সবার।

পূর্ববর্তি সংবাদশুক্রবার থেকে কলকাতায় বাংলাদেশ বই মেলা শুরু
পরবর্তি সংবাদআজ সরকার ও ঐক্যফ্রন্টের সংলাপ, যারা যারা থাকবেন