ডা. মুহাম্মদ আবদুল বারী ।। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে
১৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় দক্ষিণ আফ্রিকায় এক সপ্তাহের সফরের উদ্দেশ্যে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কাতার এয়ারওয়েজের একটি বিমানে চড়ে বসি। প্রথমে ৬ ঘণ্টা সফরে কাতারের দোহায়। এরপর সাড়ে দশ ঘণ্টার সফরে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ।
তখন সেখানে দুপুর। WCIM (World Congress of Internal Medicine)-এর ডাক্তারদের জন্য ইন্টারনাল মেডিসিন বিষয়ক একটি সম্মেলনে যোগ দেওয়াই ছিল মূল কর্মসূচি। এর সঙ্গে আমার আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল, দূরের ওই দেশটি ঘুরে আসা। দেখে আসা সেখানকার প্রাকৃতিক নিদর্শন, আল্লাহ তাআলার কুদরতি সৌন্দর্যের বিন্যাস এবং মুসলমানদের জীবনযাপন। এককথায় বলতে পারি, একটি সুন্দর, উপভোগ্য ও শিক্ষণীয় সফর ছিল এটি।

১৭ অক্টোবর দুপুরে কেপটাউনে আমরা প্রথমেই দুপুরের খাবার খাই একটি মুসলিম হোটেলে। আমাদের দিক বিবেচনা করে ব্যবস্থাটা আগেই করা ছিল। নাম বিসমিল্লাহ হোটেল। মালিকের সঙ্গে পরিচিত হলাম। ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা। গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী। দ্বীনদার মানুষ। ডাক নাম বাবুভাই। আমারও ডাকনাম বাবু। দুজনের মাঝে ভালো সখ্য হলো। জানলাম, কেপটাউন-জোহানেসবার্গসহ বিভিন্ন শহরেই এই হোটেলের শাখা রয়েছে। চেইন হোটেল বলা যায়। চারদিন কেপটাউনে ছিলাম। এক বেলার খাবার ছাড়া প্রতিদিন দুপুর ও রাতের খাবার সেখানেই খেয়েছি। এতে হালাল খাবারের বিষয়টি আমাদের জন্য সহজ হয়ে গিয়েছিল।
কেপটাউনে আমার থাকার ব্যবস্থা ছিল হোটেল লেগুনে। এই হোটেলের একপাশে পাহাড় আরেক পাশে সমুদ্র। অদ্ভুত সৌন্দর্যে ঘেরা। এই হোটেলে রাতে এসে থাকতাম। সকালের নাস্তাটাও এখানেই করা হতো। সতর্কতামূলকভাবে নাস্তা করতাম ফলফলাদি, ডিম ইত্যাদি দিয়ে।

প্রতিদিন সম্মেলনের শেষে আমরা বেড়াতে বের হয়ে যেতাম। বিকেল-সন্ধ্যা কাটিয়ে হোটেলে ফিরতাম। চারদিন এই রুটিনেই আমরা চলেছি কেপটাউনে।
কেপটাউনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ। দর্শনীয় জায়গাগুলোর সৌন্দর্য মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেয়। দর্শনীয় প্রধান একটি স্থান হলো, উত্তমাশা অন্তরীপ Cape of good hope. আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগরের মিলনস্থল। দুই সাগরের মাঝে সরু ভূমিরূপ। ভূগোলের বইপত্রে এই জায়গাটির কথা অনেকবার চোখে পড়েছে। সেখানেই হাজির হলাম একদিন। অদ্ভুত শিহরণ হলো হৃদয়ে। দেখার মতো জায়গা।

আরেকদিন বিকেলে অপর একটি পাহাড়ে গিয়েছি। টেবিল মাউন্টেন। ভূপৃষ্ঠ থেকে এক কিলোমিটার উঁচু। ওখানে দাঁড়ালে পুরো কেপটাউন শহরটা দেখা যায়। আরেকদিকে দিগন্ত, সূর্য, আটলান্টিক মহাসাগর। পাথুরে একটি পাহাড়। চূড়াটা টেবিলের মতো সমতল। এ পাহাড়ের আশ্চর্য সৌন্দর্য হলো, এর মধ্যেই প্রচুর গাছগাছালি। নানা রকম গাছে ভরে আছে পাহাড়টি। মাটি নেই, অথচ একেকটি পাথরের ফাঁক-ফোকড়ের ভেতর থেকে গাছগুলি উপরের দিকে উঠেছে।
শিল আইল্যান্ড গিয়েছি একদিন। চারদিকে নীলপানি। অদ্ভুত সুন্দর! পেঙ্গুইনের একটি দ্বীপ আছে। সেখানেও যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। সিগন্যাল হিল আরেকটি পাহাড়। সেখানেও গিয়েছি। একেকটির সৌন্দর্য একেক রকম। একদিন গিয়েছিলাম ডায়মন্ড ফ্যাক্টরিতে, যেখানে কোটি কোটি টাকার ছোট-বড় ডায়মন্ডগুলোকে নজরকাড়া আকৃতি দেওয়া হয়।

কেপটাউনের প্রকৃতির একটি আকর্ষনীয় বৈশিষ্ট্য হলো, প্রতিদিন সেখানে ৩/৪ রকম মৌসুম বিরাজ করে। কখনো বৃষ্টি, কখনো শীত, কখনো গরম, কখনো বাতাস। এত সুন্দর বাতাস! এত তীব্র আর এত সুখকর! এখন সেখানে হেমন্তের মতো পরিবশ। দিনে স্বাভাবিক, রাতে ঠাণ্ডা। ওখানে পুরো শীতকাল হয় জুন-জুলাই-আগস্টে।
কেপটাউন বিমানবন্দরে নামার পর থেকে যখন যেখানে গিয়েছি, আমার সুন্নতি পোশাকের কারণে কোথাও বিব্রত হওয়া তো দূরের কথা, বরং প্রচুর সম্মান পেয়েছি। অনেকেই সালাম দিয়েছে। প্রথমে ভেবেছি, যারা সালাম দিয়েছে সবাই হয়তো মুসলিম। আসলে অনেক খ্রিস্টানও ছিল তাদের মধ্যে। সবাই মুসলিম ছিল না। এটা পরে জানতে পেরেছি।
এর মূল কারণ হলো, পুরো দক্ষিণ আফ্রিকাতেই দ্বীনদার মুসলিমদের সম্মানটা অনেক বেশি। সেখানে আলেমদের ব্যক্তিগত ও সংঘবদ্ধ প্রভাবও অনেক বেশি। ওখানে জানতে পেরেছি, পুরো দক্ষিণ আফ্রিকায় মুসলিম জনসংখ্যা মাত্র তিন শতাংশ। কিন্তু অর্থনীতিতে ও সমাজে তারা শক্তিশালী, প্রভাবশালী এবং সম্মানীয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বী এক শতাংশ। আশি শতাংশ প্রায় খ্রিষ্টান। আর ১৭/১৮ শতাংশ মানুষ কোনো ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত নয়। ওখানে মুসলিমদের বড় অংশই গিয়েছেন ভারতের গুজরাট-সুরাট অঞ্চল থেকে। যারা কয়েক প্রজন্ম ধরে সেখানে আছেন। এখন অবশ্য বাংলাদেশি-পাকিস্তানি-আরবসহ অনেক দেশের মুসলিমরাই আছেন।

আলহামদুলিল্লাহ! এই সফরে নামাজের কোনো সমস্যা হয়নি। আমরা যেখানেই সুযোগ পেয়েছি জামাতের সঙ্গে নামাজ পড়েছি। বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গায় গিয়েও জামাতে নামাজ পড়ার সুযোগ হয়েছে। এ কারণে আমাদের সিনিয়র কোনো কোনো সফরসঙ্গী ডাক্তার আমাকে বলে রেখেছিলেন, যেদিকেই যাও আমাকে তোমার সঙ্গে রেখো, নামাজটা একসঙ্গে পড়বো। একবার ছিলাম এক ক্যাসিনোতে, নামাজের পরিবেশ সেখানে ছিল না। মাগরিবের সময় একপাশে আমরা কাপড় বিছিয়ে জামাতে দাঁড়িয়ে যাই। ওই দেশের অনেকেই তাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম বাদ দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল।
২১ অক্টোবর বিকেলে আমরা জোহানেসবার্গে যাই। দেড় ঘণ্টার বিমান সফর। দক্ষিণ আফ্রিকার আরেকটি বড় শহর এটি। বলা হয় সিটি অব গোল্ড। ওখানেও সুন্দর সময় কেটেছে। আমার বন্ধু ড. মুফতি জহিরের বাসা আছে সেখানে। তার ছেলে আমাদেরকে হোটেল থেকে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে একেবারে দেশি আমেজে দেশের মতো আপ্যায়ণ করলেন মুফতি জহিরের পুরো পরিবার।

সন্ধ্যার পর আমরা গেলাম দারুল উলুম যাকারিয়ায়। অত্যন্ত সুন্দর ও মনোরম একটি মাদরাসা। ৫৪টি দেশের ছাত্র এখানে পড়াশোনা করে। দেখেই বোঝা যায়- আমল, আখলাক ও তরবিয়তের একটি নুরানি পরিবেশ বিরাজমান। শুনেছি, জোহানেসবার্গে প্রায় ২০/২৫টি মাদরাসা আছে। দারুল উলুম যাকারিয়া সম্ভবত প্রধান মাদরাসাগুলোর একটি। দারুল উলুম দেওবন্দের সিলেবাস অনুসরণ করে এবং দেওবন্দসহ ভারত-পাকিস্তানের এ ধারার মাদরাসা ও আলেমদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে।
দারুল উলুম যাকারিয়ার একজন বাংলাদেশি উস্তাদের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি আমাদের মেহমানদারি করলেন। তার বাসায় নিয়ে গেলেন। ফরিদপুরে তার গ্রামের বাড়ি।

ঢাকার হালীম ফাউন্ডেশনের আব্দুল হালীম সাহেবের ছেলে সেলিম ভাই নামে একজনের সঙ্গে পরিচয় হলো। দ্বীনদার ও আন্তরিক মানুষ। তার ছেলেরাও আলেম। তিনিও আমাদের নিয়ে ঘুরলেন। ওই দেশে রাতে একা একা হেঁটে চলা নিরাপদ নয়। ছিনতাই-ডাকাতি হয়। এ জন্য সন্ধ্যার পর সবাই গাড়িতে চলে। সেলিম ভাই আমাদের হোটেলে পৌঁছে দিলেন।
একদিন গেলাম জোহানেসবার্গ তাবলিগ জামাতের মারকাজে। অত্যন্ত সুন্দর ও পরিপাটি মসজিদ। অজুর ব্যবস্থাপনা খুব সুন্দর। ঠাণ্ডা-গরম পানি। ডিসপজেবল গামছা। বিদেশিদের জন্য স্বতন্ত্র মেহমানদারি। মুরুব্বিদের সঙ্গে দেখা হলো, কথা হলো। বর্তমান সময়ে তারা সবাই আলমি শুরা ও আলেমদের নির্দেশনার সঙ্গে আছেন। ওখানে নিজামুদ্দিনের নিয়ন্ত্রণ নেই। বাংলাদেশি এক মুরুব্বি জানালেন, কাকরাইলের জনাব ওয়াসিফুল ইসলাম কিছুদিন আগে তাদের ওখানে গিয়েছিলেন। তাদেরকে অবস্থান পরিবর্তনের আহবান জানিয়েছেন। কিন্তু তারা আলেমদের সঙ্গেই আছেন।

দক্ষিণ আফ্রিকায় মাত্র কয়েক দিনের সফরে আমার সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন হচ্ছে, দ্বীনদার মুসলিমদের প্রভাব, আলেমদের প্রতি সম্মান, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বেশিরভাগ মুসলমানের দ্বীনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা খুব ভালো লেগেছে। আর সন্ধ্যার পরের অনিরাপত্তা (যেটা প্রধানত কালোদের কারণে হয়), অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্রটা পীড়া দিয়েছে। উন্নত দেশ, পথঘাট, ভবন ও জীবনযাত্রা আমেরিকার মতো। আবার সেখানে চরম দরিদ্র মানুষও আছে। বিভিন্ন জায়গায় যাদের চোখে পড়ে। এই বৈষম্যের দৃশ্যটা চোখে বিঁধে আছে।
শ্রুতিলিখন: আবু তাশরীফ
