এবার আলেমদের গায়ে হাত তুলছে সাদপন্থীরা!

আবরার আবদুল্লাহ ।। দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজের মুরব্বি মাওলানা সাদ কান্ধলভির বিতর্কিত বক্তব্য ঘিরে তাবলিগ জামাতে যে সংকট তৈরি হয়েছে তা ক্রমশই যেন সংঘাতে রূপ নিচ্ছে। নিজের ভ্রান্ত মতামতের পক্ষে মাওলানা সাদের অনঢ় অবস্থানের কারণে একদিকে উলামায়ে কেরাম যেমন উচ্চকণ্ঠ ও স্পষ্টভাষী হয়ে উঠছেন, অন্যদিকে সাদ-অনুসারীরা অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে দিনে দিনে। এরই মধ্যে তারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কয়েকজন আলেমের গায়ে পর্যন্ত হাত তুলেছে।

উলামায়ে কেরাম চাচ্ছেন, সাধারণ তাবলিগি সাথীরা মাওলানা সাদের বিভ্রান্তির হাত থেকে রক্ষা পাক। তাই তারা দেশব্যাপী ওয়াজাহাতি জোড় পরিচালনা এবং তাবলিগি মারকাজগুলোতে উলামাদের পরামর্শভূক্ত করার চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে মাওলানা সাদের অনুসারীরা চাচ্ছেন যে কোনো মূল্যে তার নেতৃত্ব ও আনুগত্য বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করতে।

উলামায়ে কেরামের প্রচেষ্টা, সাধারণ মানুষের উপর তাদের পরিচালিত দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের প্রভাব, বক্তৃতা, সভা ও মাহফিলে আলোচনার কারণে দিন দিন অবস্থান দুর্বল হচ্ছে মাওলানা সাদের অনুসারীদের। আর এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে তারা। তার বহিঃপ্রকাশ তারা ঘটাচ্ছে সাধারণ তাবলিগি সাথী ও উলামায়ে কেরামের গায়ে হাত তুলে, গালিগালাজ ও মিথ্যা প্রচারণার মধ্য দিয়ে।

সংকটের শুরুতে মাওলানা সাদ ও তার অনুসারীরা কিছুটা কৌশলি ভূমিকা নিলেও ক্রমেই পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। তখন তারা বলতো- আলেমদের কথাই চূড়ান্ত। আমরা আলেমদের যে কোনো সিদ্ধান্ত মানতে প্রস্তুত। একই সাথে তারা নিজেদের মনগড়া বক্তব্যগুলোও প্রচার করে যাচ্ছিলো। কিন্তু উলামায়ে কেরাম কঠোর অবস্থানে চলে যাওয়ায় তারা বেঁকে বসে।

সম্প্রতি মাওলানা সাদের অনুসারীদের দ্বারা মাদরাসার শিক্ষক, ছাত্র, মসজিদের ইমাম ও অন্যান্য দায়িত্বশীলদের গায়ে হাত তোলা এবং লাঞ্ছিত করার মতো বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক এবং কোনো কোনো জাতীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যমে এসব লাঞ্ছনার ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে।

গত ২৭ অক্টোবর আগারগাঁও বায়তুন নুর জামে মজসিদের ইমাম ও খতিব মাওলানা জসিম উদ্দিনের ওপর সাদপন্থীরা হামলা করেন বলে একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়। তার অপরাধ- তিনি তাদের কাছে কাকরাইল মসজিদের কাগজপত্র দেখতে চান।

এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী সাদপন্থীদের বিরুদ্ধে একটি লিফলেট বিতরণ করেন। সেখানে তারা লিখেন, ‘ঢাকার কেরানীগঞ্জে করা মাওলানা সাদের অনুসারীদের ইজতেমা থেকে একটি জামাত বায়তুন নুর মসজিদে আসে। মসজিদের সেক্রেটারি সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের কাছে কাকরাইলের লিখিত ‘রোখ’ আছে কিনা জানতে চান। এতে বাকবিতণ্ডার সৃষ্টি হয় তাদের সঙ্গে এবং এক পর্যায়ে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিনসহ দায়িত্বশীলদের উপর হামলা করে বসেন সাদপন্থীরা।

ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ে ইসলাম টাইমস মাওলানা জসিম উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ঢাকার কেরানীগঞ্জ সাদপন্থীদের তিন দিনের ইজতেমা করার কথা ছিল। কিন্তু করতে না পেরে তারা দলে দলে ভাগ হয়ে ঢাকার বিভিন্ন মসজিদে ছড়িয়ে পড়ে। সে হিসেবে মিরপুর এলাকার কিছু সাদপন্থী আমাদের মসজিদে আসেন। তারা জোহরের সময় আসেন। মসজিদের খাদেম তাদের কাছে ‘রোখ’ দেখতে চান এবং মসজিদের সেক্রেটারিকে খবর দেন।

‘রোখ’ হচ্ছে, একটি তাবলিগি জামাত কোন মসজিদে কতদিন থাকবে সে বিষয়ে কাকরাইল থেকে দেওয়া নির্দেশনা সংবলিত কাগজ।

তারা ৩০-৩৫ জন এসেছিলেন। মসজিদ ছোট হওয়ার পরও তাদের থাকার অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু তারা খুব মারমুখী ছিলেন। এক পর্যায়ে তারা ঝগড়া বাঁধিয়ে দেন এবং আমাদের উপর আক্রমণ করেন।

ইমাম জসিম উদ্দিন বলেন, আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি যে, তারা পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের উপর হামলা করেছেন। কারণ হলো, কিছুদিন আগে দিল্লির নিজামুদ্দিন থেকে একটি জামাত আসে আমাদের মসজিদে। কিন্তু কাকরাইলের অনুমতি না থাকায় তাদের আমরা মসজিদে রাখিনি। এতে তারা ক্ষিপ্ত হয় এবং তারা এ ঘটনার প্রতিশোধ নেয়ার পরিকল্পনা করে। সে অনুযায়ী তারা দলবেঁধে মসজিদে আসে এবং আক্রমণ করে।

ঘটনার প্রেক্ষিতে মিরপুরের উলামায়ে কেরাম আগারগাঁও জামিয়া হোসাইনিয়াতে বৈঠক করেন এবং স্থানীয় ওয়ার্ড কশিনারকে বিষয়টি অবহিত করেন। তিনি বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধানের আশ্বাস দেন।

২৮ অক্টোবর খাগড়াছড়ি ওয়াজাহাতি জোড়ে অংশগ্রহণ করায় জেলার মানিকছড়ি গচ্ছাবিল মদিনাতুল উলুম মহিলা মাদরাসায় তালা ঝুলিয়ে দেয় সাদপন্থীরা। মাদরাসার শিক্ষিকা ও ছাত্রীদের মাদরাসা ত্যাগে বাধ্য করে।

গত ৩১ অক্টোবর বিশিষ্ট আলেম ও লেখক মাওলানা আবু বকর সিরাজী তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে এমন দু্টি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। এক. সাদপন্থীদের দ্বারা তার ছাত্র ও সহকর্মী মাওলানা মুস্তাফিজুর রহমান প্রহৃত হয়েছেন। দুই. জামিয়ার মুহাদ্দিস মুফতি আব্দুর রহমান সাদপন্থীদের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েছেন।

একই রকম ঘটনা ঘটেছে নারায়নগঞ্জ ডিআইটি মসজিদের খতিব ও হাজিপাড়া মাদরাসার মুহতামিম প্রবীণ আলেম মাওলানা আবদুল আওয়ালের সঙ্গেও।সাদ-অনুসারীরা তার গায়েও হাত তুলেছে। সাদ অনুসারীদের এজাতীয় মারমুখি আচরনের ঘটনা ঘটছে প্রায় প্রতিদিনই, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

আলেমদের গায়ে হাত তোলার প্রবণতা কেন তৈরি হলো এমন প্রশ্নের উত্তরে ঢাকার মিরপুরের আরজাবাদ মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা বাহাউদ্দিন যাকারিয়া বলেন, বর্তমানে সাদ-অনুসারী কিছু লোক রুসমি তাবলিগ করছে। আলেমদের থেকে দূরে থাকার কারণে দ্বীন ও শরিয়ত তারা শিখছে না। ফলে যে ধরনের ভ্রান্তিগুলোর আশংকা এসব ক্ষেত্রে হয়ে থাকে, তাদের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। এরই একটা বহিঃপ্রকাশ হলো আহলে ইলমদের গায়ে হাত তোলার প্রবণতা।

তিনি আরও বলেন, তারা দ্বীনকে তাবলিগের কয়েকটি বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করে। ফলে তারা আলেমদের অবদান ও মর্যাদা বুঝতে পারে না। তাদেরকে সেই শিক্ষাও দেয়া হচ্ছে না; বরং তাদের স্বঘোষিত আমির আলেমদের বিরুদ্ধে উসকে দিচ্ছেন তার অনুসারীদের এবং আলেমদের সমালোচনা করছেন।

মাওলানা সাদ কান্ধলভি তার অনুসারীদের শেখাচ্ছেন যে, আলেমরা যেহেতু তাবলিগের কাজে সময় দেন না (তার ধারণা মতে) তাই আলেমদের কোনো দ্বীনি খেদমতই খেদমত বলে গণ্য নয়। তার বক্তব্যই অনুসারীদের আলেমদের প্রতি অশ্রদ্ধাশীল করে তুলছে।

মাওলানা বাহাউদ্দিন যাকারিয়া মনে করেন, উলামায়ে কেরাম নবী ওয়ারিস। তাদের গায়ে হাত তোলা দ্বীনের প্রতি অশ্রদ্ধার নামান্তর। এর পরিণাম অবশ্যই খারাপ হবে। তাদের দুনিয়া-আখেরাত দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সাথে সাথে তিনি উলামায়ে কেরামকে ধৈর্য্য ধারনের আহবান জানান। বলেন, দ্বীনের সঠিক ধারার উপর অটল থেকে দ্বীনি খেদমত করতে গিয়ে উলামায়ে কেরাম যুগে যুগে নানান বাঁধা ও ঈমানি পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন। সুতরাং বিচলিত না হয়ে ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে। আর যারা হাত তুলছে তারা যেহেতু সাধারণ মানুষ তাই তাদের সাথে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়া উচিৎ হবে না। সর্বোচ্চ ধৈর্য্য-এর পরীক্ষা দিতে হবে। প্রয়োজনে প্রশাসনের সহযোগিতা গ্রহণ করতে হবে।

পূর্ববর্তি সংবাদমান্নার প্রশ্ন : খাওয়ার ছবি বের হলো কী করে?
পরবর্তি সংবাদচীনে নদীতে বাস, নিহত ১৩