কেমন চলছে হিন্দুস্তানের ‘লাভ জিহাদ’?

সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর ।। 

‘কোনো মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করলেই নগদ আড়াই লাখ রুপি!’

এমনটাই দাবি করা হচ্ছিল ওই ভিডিওতে। গত ১৬ আগস্ট ২০১৮ তারিখে ভারতের সংবাদমাধ্যম The Siasat Daily প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে প্রদর্শন করা হয় ভিডিওটি।

ভিডিওতে দেখা যায়, CN NEWS24 নামের একটি টিভি চ্যানেলকে দেয়া মন্তব্যে আখিল ভারত হিন্দু যুব মোর্চার একজন যুবনেতা বলছিলেন, ‘…সম্প্রতি গুজরাটের আখিল ভারত হিন্দু যুব মোর্চার সকল নেতা এবং মাননীয় অজিত সিং এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ভারতের কোনো হিন্দু যুবক যদি কোনো মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করে তবে হিন্দু যুব মোর্চার পক্ষ থেকে তাকে আড়াই লাখ রুপি পুরষ্কার দেয়া হবে। যুব মোর্চার যে কোনো অফিস থেকে সে আড়াই লাখ রুপির চেক তুলতে পারবে। একই সঙ্গে তার ছয় মাসের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও করা হবে মোর্চার পক্ষ থেকে।’

মুসলিম মেয়েদের বিয়ে করার এমন হুমকি এবং অফারকে বলা হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী বিজেপির ‘হিন্দুয়ানি লাভ জিহাদ’।

খবরের বিশ্লষণে যাওয়ার আগে আমাদের জানা দরকার ‘লাভ জিহাদ’ জিনিসটা আসলে কী! ‘লাভ জিহাদ’ শব্দযুগল তখনই ব্যবহার হয় যখন কোনো মুসলিম তরুণ ভালোবেসে অন্য ধর্মের কোনো মেয়েকে বিয়ে করে এবং ওই মেয়ে তার স্বধর্ম ত্যাগ করে ইসলামধর্ম গ্রহণ করে।

এই শব্দযুগল প্রথম ব্যবহার ২০০৯ সালে ভারতের কেরালা ও কর্নাটক রাজ্যে। কেরালা রাজ্যে মুসলিম জনসংখ্যা অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় বেশি হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম এবং হিন্দু ছেলে-মেয়ের মধ্যে বিবাহ নৈমিত্তিক ব্যাপার। কিন্তু ব্যাপারগুলো তখনই লাভ জিহাদে রূপ নেয় যখন হিন্দু ছেলে কিংবা মেয়ে ভালোবাসার টানে নিজ ধর্ম বিসর্জন দিয়ে নিজের নতুন পরিচয় ধারণ করে মুসলিম হিসেবে।

কেরালা রাজ্যে এমন বিবদমান ঘটনা নিয়ে কোর্ট-কাচারি, মামলা-মোকদ্দমা হয়েছে ঢের। কিন্তু কাজ হয়নি খুব একটা। আন্তঃধর্মীয় সম্পর্ক থেকে ধর্ম পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। এ কারণে চটেছে বিজেপি ও তার বলয়ে লালিত পালিত যুব মোর্চার মতো কয়েকটি কট্টরপন্থী সংগঠন। মুসলিমদের বিরুদ্ধে তারাও সদর্পে ঘোষণা করেছে নব্য হিন্দুয়ানি লাভ জিহাদ। মুসলিম মেয়েদের ভালোবেসে বিয়ে করলেই পাবে নগদ আড়াই লাখ রুপি!

ওদিকে ঘটছে আরেক কাণ্ড। গুজরাটের লোকজনের হোয়াটসআপে নাকি মেসেজ যাচ্ছে- ‘ব্রাহ্মণ মেয়ে বিয়ে করলে পাবে ৬ লাখ, শিখ মেয়ে বিয়ে করলে পাবে ৭ লাখ…!’

হিন্দু নানা জাত ও বর্ণের মেয়েদের বিবরণ দিয়ে এসব মেসেজ পাঠাচ্ছে ‘স্টুডেন্টস অব মুসলিম ইয়ুথ ফোরাম’ নামের একটি সংগঠন। শুধু যে ব্রাহ্মণ আর শিখ মেয়ে বিয়ে করলেই পুরষ্কার মিলবে তা-ই নয়, অন্য ধর্মের যে কোনো মেয়েকে বিয়ে করলেই পাওয়া যাবে বিভিন্ন অংকের পুরষ্কার।

‘স্টুডেন্টস অব মুসলিম ইয়ুথ ফোরাম’ পুরষ্কারের পুরো তালিকাটা এমন:

  • পাঞ্জাবি শিখ মেয়ে=৭ লাখ রুপি
  • গুজরাটি ব্রাহ্মণ মেয়ে=৬ লাখ রুপি
  • পাঞ্জাবি ব্রাহ্মণ মেয়ে=৬ লাখ রুপি
  • ক্ষত্রিয় হিন্দু মেয়ে=সাড়ে ৪ লাখ রুপি
  • ক্যাথলিক খ্রিষ্টান মেয়ে=৪ লাখ রুপি
  • প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টান মেয়ে=৩ লাখ রুপি
  • জৈন হিন্দু মেয়ে=৩ লাখ রুপি
  • গুজরাটি কুচ মেয়ে=৩ লাখ রুপি

মেসেজের নিচে ১১ টি ফোন নম্বর লেখা আছে। কোনো মুসলিম যুবক তার লাভ জিহাদে সফল হলে উক্ত নম্বরে যোগাযোগ করে পয়সা উসুল করার জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু গুজরাটবাসী নম্বরগুলোতে ফোন করলে সবগুলো নম্বরই ভুয়া বলে প্রতীয়মান হয়।

ধারণা করা হয়, এ ধরনের বিদ্বেষ ছড়ানো এবং উত্তেজনামূলক মেসেজ বা সংবাদ তৈরি করে থাকে হিন্দুত্ববাদী যুব মোর্চার মতোই কিছু চরমপন্থী হিন্দু যুব সংগঠন। এগুলো ছড়িয়ে মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ বাড়ানোই তাদের মহৎ উদ্দেশ্য!

আরএসএস, বজরঙ্গ দল, শিবসেনা, যুব মোর্চা – এরা সবাই এ ধরনের মিথ্যা সংবাদ তৈরিতে সিদ্ধহস্ত। আর ভারত এমন একটি দেশ যেখানে গুজবই হলো সর্বৈব সত্য। ধর্মের নামে একবার কোনো ক্রনিকল প্রচার হতে দেরি, সেটাকে সত্য বলে দাঙ্গা বাঁধাতে মোটেও কসুর নেই তাদের। আর এই প্রচারেই প্রসার ঘটে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির ধর্মান্ধ রাজনীতির। যত বেশি দাঙ্গা, যত বেশি মুসলিমবিদ্বেষ – তত বেশি বাড়ে বিজেপির ভোটব্যাংক।

এরই ধারাবাহিকতায় বিজেপির মদদপুষ্ট বিভিন্ন যুব সংগঠন শুরু করেছে লাভ জিহাদ প্রচারণা। একদিকে তারা নিজেরাই ছড়াচ্ছে লাভ জিহাদের নামে নানা রঙিন অফার, আবার সেই জিহাদকে কাউন্টার অ্যাটাক করতে নিজেরাই নামছে হিন্দুয়ানী লাভ জিহাদে। এ যেন শাঁখের করাত – যেদিকে যাবে সেদিকেই কাটবে। বিজেপির ওদিকে পোয়াবারো, আগারটাও খাচ্ছে-তলারটাও খাচ্ছে।

বিজেপির এমন ধরনের বিদ্বেষমূলক আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মুসলিমরা। সংখ্যালঘু বলে মানসিক পীড়ন যেমন আছে, কয়েক বছর ধরে নতুন যোগ হয়েছে লাভ জিহাদ নামের এই কাল্পনিক ভূত। লাভ জিহাদের ধোঁয়া তুলে মুসলিম যুবকদের যেমন হয়রানি করা হচ্ছে, তেমনি হয়রানি করা হচ্ছে মুসলিম মেয়েদেরও।

পূর্ববর্তি সংবাদশুকরানা মাহফিলে প্রধানমন্ত্রী যা বললেন
পরবর্তি সংবাদবিএনপি নেতা তরিকুল ইসলাম চলে গেলেন