কোথায় যাচ্ছে সংলাপ?

শরীফ মুহাম্মদ ।।

অক্টোবরের শুরু থেকেই আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে নানা ধরনের মেরুকরণ স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। এ ধারা চলছিল আরও কয়েক মাস আগ থেকেই। এর মধ্যেই বিএনপির সঙ্গে ড. কামাল হোসেনের গণফোরামসহ আরও কয়েকটি দল মিলে গঠিত হয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্যন্ট । সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এ ফ্রন্ট । ফ্রন্ট গঠনের এ সময়টিতে বেশ কিছু ঘটনাও ঘটেছে। ড. কামাল, বি চৌধুরী, আসম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না একটি জোট করার জন্য একসঙ্গে যাত্রা শুরু করেছিলেন। শেষে বি চৌধুরী তার বিকল্পধারা নিয়ে আলাদা হয়ে যান । তাকে বাদ দিয়েই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট দেশের বড় দুটি বিভাগীয় শহর সিলেট ও চট্টগ্রামে সমাবেশ করে। সরকারের সঙ্গে তাদের সরাসরি কর্মসূচি বা সমন্বিত পদক্ষেপ শুরু হয় ১ নভেম্বর বৃহস্পতিবার সংলাপে বসার পর থেকে।

এর কয়েকদিন আগে তারা প্রধানমন্ত্রী বরাবর সংলাপের একটি চিঠি দিয়েছিলেন। সরকারের পক্ষ থেকে সেই চিঠির সাড়াটা দেওয়া হয় খুবই দ্রুত । এরপর তারা সংলাপে বসেন। এই সংলাপের বিষয়টি গণমাধ্যমসহ সারা বাংলাদেশে রাজনীতি-সচেতন মানুষের মাঝে এক ধরনের কৌতূহল ও আগ্রহ জাগিয়ে তুলে । কারণ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে সরকার পক্ষ থেকে শুধুই বলা হচ্ছিল, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। এ নিয়ে কোনো সংলাপে তারা বসবেন না। একটা শঙ্কা কাজ করছিল, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ বের হবে কি না? নাকি আবারও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনই হবে? মনোনয়নের ভিত্তিতে ১৫০-এর বেশি এমপি নির্বাচিত হওয়ার মতো কোনো নির্বাচনের দিকেই কি পরিস্থিতি এগিয়ে যাবে?

বলাবলি হচ্ছিল, একটা ভালো নির্বাচনের জন্য একটা সংলাপ দরকার সরকার এবং সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষের সঙ্গে। বাংলাদেশে বিএনপি এবং তার নেতৃত্বাধীন জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকেই ইদানীং প্রধান প্রতিপক্ষ মনে করা হয়। যদিও বর্তমানে বিএনপি সংসদে নেই এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সামনের নেতা ড. কামাল হোসেন, কিন্তু এটিই এখন বিএনপি নেতৃত্বাধীন প্রধান রাজনৈতিক জোট। ১ নভেম্বর সরকার তাদের সঙ্গেই প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার একটি দীর্ঘ সংলাপ করেছে। সংলাপ শেষ হওয়ার পর বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আশানুরূপ কোনো আলোচনা হয়নি। কিন্তু সংলাপে বসার ঘটনাটি দেশজুড়ে একটি স্বস্তি বা সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্র তৈরির একটা ইঙ্গিত সৃষ্টি করেছিল। অপরদিকে সংলাপকেন্দ্রিক রাজনীতির একটা ধারাও শুরু হয়ে যায় সেদিন থেকেই।

সংলাপ কেন্দ্রিক রাজনীতির এ ধারার সূচনার মধ্যেই অবশ্য অন্য একটি ব্যাপার সামনে চলে আসে। এর আগে কোনো দল বা জোট সরকারের সঙ্গে নির্বাচনকেন্দ্রিক সংলাপের কোনো চিঠি না দিলেও বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্ট যেদিন সংলাপে বসবে সেদিনই গণমাধ্যমে খবর এলো, বিকল্পধারার নেতৃত্বাধীন জোটের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে সংলাপের চিঠি দেওয়া হয়েছে। এরপর সরকারের সঙ্গে সঙ্গে থাকা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির নেতৃত্বাধীন জোটও চিঠি দিয়ে জানিয়েছে- আমরাও সংলাপে বসব। এভাবে বেশ কয়েকটি দল সরকারকে সংলাপের চিঠি দেয় এবং সংলাপে বসেও। এখানে একটি ব্যাপার বেশ লক্ষনীয়ভাবে সামনে আসে যে, প্রধান প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংলাপের পরপর সংলাপের একটা ধারাবাহিকতা শুরু হয়। যেখানে সমঝোতার বিরোধীদল এবং সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকা দলগুলোরও সংলাপের সিরিয়াল শুরু হয়। দেখাদেখি সংলাপের মতো হয়ে যায় এই ধারাবাহিকতাটা। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম হয়ে যায় যে যেহেতু জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে বসা হয়েছে এখন অন্যদের সঙ্গেও বসতে হবে। এতে প্রধান প্রতিপক্ষের সাথে মূল সংলাপেরও গুরুত্বও কমে যায় কিছুটা। এই জিনিসটাই একটা অন্যরকম কৌতূহল সৃষ্টি করে অথবা সংলাপ কেন্দ্রিক আগ্রহের ওপর পানি ছিটিয়ে দেয়।

এ পরিস্থিতির মধ্যেই জানা গেল, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সরকার আবার সংলাপে বসছে। সেটি হতে পারে ৭ নভেম্বর। খবর পাওয়া যাচ্ছে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারাও তাদের ৭ দফা দাবিকে সীমিত করে কীভাবে বিদ্যমান সংবিধানের মধ্যেই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে তার বিভিন্ন উপায় ও সম্ভাবনা সামনে নিয়ে আসতে চাচ্ছে। এই ঘটনাটা রাজনীতির ক্ষেত্রে এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনার ক্ষেত্রে আবার একটা সুবাতাস প্রবাহিত করেছে। কারণ রাজনীতির উত্তেজনা ও অস্থিশীলতার জায়গাটা মূলত সরকার ও সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষের মাঝেই বড়,। অন্যদের সাথে ততটা নয়।

আগামী নির্বাচনে কে বিজয়ী হবেন কিংবা কে পরাজয় বরণ করবেন, এর চেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া। যেন স্বাভাবিকভাবে যারা প্রতিনিধি হওয়ার কথা, জনগন যদের প্রতিনিধি বানায়, তারাই সরকার গঠন করতে পারে। এটার জন্য বর্তমান বিরাজমান সংবিধানের যে ধারা- যেখানে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের বিধান নেই-এর পরও এবং এর মধ্যে থেকেই কীভাবে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন হতে পারে, এর একটা পথ বের হয়ে আসুক এবং একটা সুন্দর নির্বাচনের সম্ভাবনা তৈরি হোক, রাজনীতি ও দেশের অনিশ্চয়তাটা কেটে যাক – এর জন্য সাধারন মানুষ অপেক্ষা করছে। যদি প্রধান প্রতিপক্ষগুলোর সংলাপ ব্যর্থ হয়, প্রধান দুটি প্রতিপক্ষ সমঝোতার জায়গায় যেতে না পারে তাহলে একটা শঙ্কার দরজা হয়তো খুলে যাবে নির্বাচনের আগেই। আমরা উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে আছি, প্রধান দুটি প্রতিপক্ষসহ সবগুলো দল ও জোট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। নির্বাচনটি অধিক পরিমাণে সুষ্ঠু হবে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও শৃঙ্খলা থাকবে। নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আলামতটাই বেশি থাকবে। জনমতের প্রতিফলন ঘটবে।

জানা গেছে, ৮ তারিখে নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করবে। তফসিলের সময়ই তো নির্বাচনের তারিখও ঘোষণা করতে হয়। গণমাধ্যমগুলোতে এসেছে ২০ ডিসেম্বরের আগেই নির্বাচন হয়ে যেতে পারে। এর মধ্যেই আমরা এই সংলাপ, প্রথমে যা খুব আশার সৃষ্টি করেছিল, মাঝে কিছুটা কৌতূহলহীনতার কারণে পরিণত হয়েছিল, শেষের দিকে এসে আবার একটা আশার সৃষ্টি করছে, সেটির সুন্দর পরিনতি দেখতে চাই।

সংলাপ ও সমঝোতার ভিত্তিতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন এবং দেশের পরিবেশ ভালো থাকা, হানাহানির পরিবেশ না থাকা, এটার জন্য মানুষ আসলেই অপেক্ষা করছে। নির্বাচনের বিভিন্ন উপলক্ষ, প্রসঙ্গ এখন প্রায় প্রতিদিন সমানে আসতে থাকবে। নানা রকম সমীকরণ ও মেরুকরণ এই নভেম্বর ও ডিসেম্বরের শুরুতে ঘটতে থাকবে। এগুলো ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। তফসিল ঘোষণার পর আরও বিভিন্ন চিত্র সামনে আসতে পারে। এ সবকিছুর মধ্যেও সরকার ও সরকারের প্রধান ও অন্যান্য প্রতিপক্ষের মাঝে সুষ্ঠু নির্বাচনকেন্দ্রিক সমঝোতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আইনকানুন মেনে বা সমঝোতার ভিত্তিতে পরিবর্তন করে কীভাবে নির্বাচনটিকে অধিক সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করা যায় এর জন্য সংলাপ ও নির্বাচনের অন্যান্য আয়োজনের সাফল্যের দিকে দেশবাসী উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে। আমরাও তাকিয়ে আছি।

দেশে কোনো অস্থিরতার পরিবেশ সৃষ্টি না হয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন হোক। যারা জনমতের ভিত্তিতে জনপ্রতিনিধি হওয়ার কথা, তারাই জনপ্রতিনিধি হোক। নির্বাচনের পর এর ভিত্তিতেই সরকার গঠিত হোক। দেশবাসী সামনের সুন্দর, স্থিতিপূর্ণ দিনের অপেক্ষায়।

অনুলিখন : সাদ আবদুল্লাহ মামুন

পূর্ববর্তি সংবাদঈশ্বরগঞ্জে ওয়াজাহাতি জোড় : সাদ-অনুসারীদের সহি ধারায় ফিরে আসার আহ্বান
পরবর্তি সংবাদপীরকে কি কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক মনে করা যায় ?