মাদরাসাই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান, মাদরাসাই ছিল তার নেশা

মাওলানা মুহাম্মাদ ।।

মাওলানা মন্জুরুল হক রহ. প্রথম জীবনে স্কুল-কলেজের ছাত্র ছিলেন। ঢাকা কলেজে পড়ার সময় তিনি থাকতেন বড় কাটারা মাদরাসায়। সেখানে হজরত শামসুল হক ফরিদপুরী রহ.-এর সঙ্গে তার গভীর মহব্বত জন্মে যায়। এরই এক পর্যায়ে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার আগেই তিনি কলেজ ছেড়ে দিয়ে বড় কাটারা মাদরাসায় ভর্তি হয়ে যান। প্রথমে বড় কাটারা ও পরে ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহারানপুরে তিনি দ্বীনি শিক্ষা অর্জন করেন। দাওয়ায়ে হাদিসের পড়ালেখা করেন সাহারানপুরেই। হজরত শামসুল হক ফরিদপুরী রহ., হজরত শায়খুল হাদিস যাকারিয়া রহ., হজরত হাফেজ্জী হুজুর রহ., মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ রহ. ছিলেন তার উল্লেখযোগ্য উস্তাদ।

কর্মজীবনে দ্বীনি প্রতিষ্ঠান বা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনাই তার জীবনের অন্যতম ধ্যানজ্ঞানে পরিণত হয়। আমরা ছোটকালে দেখেছি, মাদরাসাই ছিলো তার সংসারের মতো। বাসাবাড়িতে অন্যান্য কাজ যেন ছিল তার বাড়তি কাজ। প্রায় সব ভাবনা-চিন্তা, উদ্যোগ, ছোটাছুটি থাকতো তার মাদরাসা নিয়ে। এ যেন ছিলো তার এক পবিত্র নেশা। ময়মনসিংহে তার হাতে পাঁচ-ছয়টি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে আমরা শুনেছি। এর মধ্যে ময়মনসিংহ শহরের প্রধান তিনটি মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। চরপাড়া জামিয়া ইসলামিয়া, খাগডহরের জামিয়া আশরাফিয়া, তালতলার জামিয়া আরাবিয়া মাখজানুল উলুম। তার শেষ জীবনের প্রতিষ্ঠান ছিল এই মাখজানুল উলুম।

মাদরাসার শিক্ষকদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিলো অত্যন্ত মহব্বতপূর্ণ। আর্থিক টানাটানি থাকতো। কিন্তু শিক্ষকরা বাড়িতে যাওয়ার সময় দেখা করে, খোঁজ নিয়ে তাদের হাতে বেতনের টাকা তুলে দিতেন। ছাত্রদের লেখাপড়া ও তরবিয়তের বিষয়ে খুব মনোযোগ রাখতেন। নামাজের জামাত ছুটে গেলে অথবা টাখনুর নিচে কোনো ছাত্রের লুঙ্গি-পায়জামা পরা দেখলে ভীষণ রাগান্বিত হতেন। মাঝে মাঝে ছাত্রদের নাহু-সরফ (আরবি ব্যাকরণ) তিনি পড়াতেন। এই বিষয়ে তার বিশেষ দক্ষতা ছিল। তিনি বিষয়টি আনন্দ নিয়ে পড়াতেন। নানা রকম সিগা (শব্দরূপান্তর) জিজ্ঞাসা করতেন। কখনো কোনো দরসে কোনো উস্তাদ অনুপস্থিত থাকলে সেখানে গিয়ে বসে যেতেন।

৯ নভেম্বর শুক্রবার মাওলানা মন্জুরুল হক রহ. প্রতিষ্ঠিত জামিয়া আরাবিয়া মাখজানুল উলুমের বার্ষিক মাহফিল।

তিনি নিজে অত্যন্ত সাদাসিধা জীবনযাপন করতেন। কোনো আড়ম্বর ছিল না জীবনচলায়। মাদরাসা পরিচালনার ক্ষেত্রেও তার মনোযোগ থাকতো ছোট ছোট জরুরি বিষয়গুলোর ‍দিকে। উস্তাতদের বেতনের টাকার ব্যবস্থা, বোর্ডিংয়ের খাবারের অর্থের ব্যবস্থা, কিতাব কেনার আয়োজন- এসবেই তার দৃষ্টি থাকতো। ভবন বাড়ানো কিংবা আয়তনগত উন্নয়নে তিনি খুব একটা নজর দিতেন না। পারিবারিকভাবে তার কিছু সহায়-সম্পদ ছিল। শুনেছি, আমরা দেখিনি, ছোট ছিলাম। প্রেস, সিলভারের দোকান, লাইব্রেরি এসব ছিলো। কখনো এসবের আয়, কখনো এসব বিক্রির টাকা তিনি মাদরাসার জমি কেনা ও অন্যান্য কাজে খরচ করতেন। তার জীবনের সাধ ও স্বপ্ন জুড়ে ছিল মাদরাসা আর দ্বীনি তালিম। যৌবনকাল থেকে ওফাত পর্যন্তই তিনি এভাবে চলেছেন।

তিনি হজরত হাজেজ্জী হুজুর রহ. এর শেষ যুগের খলিফা ছিলেন। নিয়মিত বয়ান করতেন না তিনি, কিন্তু ইসলাহি আন্দাজে মাদরাসার মসজিদে, মহল্লার মসজিদে বয়ান করতেন। মানুষের ঈমান-আমল, মুয়ামালা-মুয়াশারা সুন্দর করতে নরম-গরম ভাষায় কথা বলতেন। এভাবেই তিনি সাদাসিধা একটি জীবনেই দ্বীনের কাজ ও মেহনতের সমৃদ্ধ এক পাহাড় গড়ে গেছেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন। আমিন।

লেখক : মাওলানা মন্জুরুল হক রহ.-এর নাতি
          ও নায়েবে মুহতামিম, জামিয়া আরাবিয়া মাখজানুল উলুম, ময়মনসিংহ

পূর্ববর্তি সংবাদতফসিল না পেছালে ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে যাবে না : আসম আব্দুর রব
পরবর্তি সংবাদনির্বাচন ১ সপ্তাহ পেছানোর দাবি বি চৌধুরীর