রাজনীতিক আলেমদের নেতৃত্বে কোথায় যাচ্ছে হেফাজত ও হাইআতুল উলইয়া?

আবরার আবদুল্লাহ ।।

একাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দেশের গণমাধ্যমে অন্যতম আলোচিত ইস্যু ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’। হেফাজতে ইসলাম দ্বারা গণমাধ্যমে কওমি ধারাকেই বোঝানো হয়। কওমি ধারার যে কোনো সংগঠন ও তার আয়োজনকেই তারা হেফাজত হিসেবেই চিহ্নিত করার চেষ্টা করে।

গণমাধ্যমে হেফাজত, হাইয়াতুল উলয়া ও ইসলামি রাজনীতি সবকিছুকেই গুলিয়ে ফেলা হয় বা অভিন্ন প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়।

ফলে এক প্রতিষ্ঠানের দায় না চাইতেই চলে আসে অন্য প্রতিষ্ঠানের উপর। কোনো ইসলামি রাজনীতিক যখন তার রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে কোনো বক্তব্য দেন তখন বলা হয় অমুক হেফাজত নেতা এমন বলছেন। অথচ তার বক্তব্যের সঙ্গে হেফাজতে ইসলাম কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট নয়।

গণমাধ্যমের এ পরিবেশন কতোটা ঐচ্ছিক আর কতোটা অজ্ঞতার কারণে তা ঠিক বোঝা না গেলেও এটা ঠিক যে, এ সুযোগ তৈরি হয়েছে হেফাজত, হাইআতুল উলয়া ও ইসলামি দলগুলোর রাজনৈতিক নেতৃত্ব অভিন্ন হওয়ায়। এ নিয়ে আলেমসমাজের নিজস্ব পরিধিতেও চলছে বাদানুবাদ ও নানামুখি তর্ক।

কারণ, এই তিন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নেতৃত্বে রয়েছেন পরিচিত কয়েকটি মুখ। যারা এক সময় হেফাজতের হয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন, এক সময় হাইআতুল উলয়ার প্রতিনিধিত্ব করছেন আবার কখনো কখনো বিভিন্ন ধারার রাজনৈতিক মঞ্চেও দেখা যাচ্ছে তাদের। তাদের রাজনীতিমুখি বক্তব্যের কারণেও বিতর্ক তৈরি হয়। ফলে গণমাধ্যম খুব সহজেই এক প্রতিষ্ঠানের দায় চাপিয়ে দিচ্ছে অন্য প্রতিষ্ঠানের উপর। এতে সামগ্রিকভাবে ইমেজ সংকটে পড়তে হচ্ছে হেফাজতকে এবং কখনো কখনো পুরো কওমি ধারাটিকেই।

বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের সহ-সভাপতি ও হাইআতুল উলয়ার সদস্য আল্লামা আজহার আলী আনোয়ার শাহ মনে করেন প্রত্যেকটি সংগঠনের নেতৃত্ব আলাদা হওয়া উচিৎ। হেফাজত, বেফাক-হাইয়াতুল উলয়া, ইসলামি রাজনৈতিক সংগঠন সবকিছুর নেতৃত্ব আলাদা হলে এ সমস্যা থাকবে না।

তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম কেন আপনি মনে করেন নেতৃত্ব ভিন্ন হওয়া উচিৎ? ‘ভিন্ন হলে আমাদের স্বাতন্ত্র, আমাদের শক্তি হতো, আলাদা শক্তি -চাটুকারি শক্তি না- দেশের আইন ও সংবিধানের মধ্যে থেকেই আমরা পুরো জাতির নেতৃত্ব দিতে পারতাম। কিন্তু আমাদের কি হলো? জনগণ এখন নানা বক্তব্যের দায় চাপিয়ে আমাদের থুথু দেয়।’ উত্তর দেন আল্লামা আনোয়ার শাহ।

তবে বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখেন বেফাক মহাসচিব মাওলানা আবদুল কুদ্দুস। তার মতে, একই ব্যক্তি একই সঙ্গে হেফাজত, হাইআতুল উলয়া ও কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃত্বে থাকতে পারেন। প্রত্যেক জায়গায় তার পরিচয় ও ভূমিকা ভিন্ন ভিন্ন। সুতরাং এক হলে সমস্যা দেখেন না তিনি।

তাহলে যে আজ অরাজনৈতিক সংগঠন ও শিক্ষাবোর্ড হাইআতুল উলয়ার দিকে আঙ্গুল তোলা হচ্ছে? বেফাক মহাসচিবের উত্তর হলো, ‘এর কারণ, নিয়ম মান্য না করা। হাইআতুল উলয়া ও হেফাজতের সংবিধানেই বলা হয়েছে, সেখানে রাজনীতি করা যাবে না। কিন্তু অনেকেই তা মানেননি। শুকরিয়া মাহফিলে আমরা আগেই বলেছিলাম, এখানে রাজনীতি, দল ও নির্বাচন নিয়ে কথা বলা যাবে না।’

যারা মানছেন না তাদের ব্যাপারে কোনো করণীয় আছে কি না সে বিষয়ে অবশ্য স্পষ্ট কিছু বলেননি মাওলানা আবদুল কুদ্দুস। প্রশ্নের উত্তরে শুধু বলেন, ‘না, না আমরা এ সুযোগ দেই না, দেবো না।’

একই প্রশ্নের উত্তরে আল্লামা আনোয়ার শাহ বলেন, ‘শুধু বিতর্ক তৈরি হচ্ছে না, আমরা ডুবে যাচ্ছি। অনেক দিন ধরে আশঙ্কা করছিলাম অভিন্ন নেতৃত্ব আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। আর শেষ পর্যন্ত তাই হচ্ছে। হেফাজত আমাদের জন্য অনেক বড় একটি শক্তি হয়ে দেখা দিয়েছিল। কিন্তু তার পুরোটা প্রায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তির কারণে। লোভ-প্রলোভনের কারণে। গদির চিন্তায়, ক্ষমতার চিন্তায় ইচ্ছে করে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে।’

হেফাজতে ইসলামের মতো সম্ভাবনাকে কেন কাজে লাগানো গেলো না, কেন তা ‘ধ্বংস’ হয়ে যাচ্ছে সেদিকেও ইঙ্গিত দিলেন তিনি। বললেন, ‘অনেক বাস্তবতা আছে সব বলা যায় না। বলা যায় না কারণ, আমরা এমন একজনকে মেনেছি, য়ার বয়স হয়েছে, যার কর্মশক্তি ঠিক মতো কাজ করে না। তার আশপাশের লোকগুলোর কাছে তিনি অনেকটাই অসহায় । পরিস্থিতি এ পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে, ভবিষ্যতে কি দাঁড়াবে আল্লাহ জানেন।’

আল্লামা আনোয়ার শাহর মতে শিক্ষা, রাজনীতি ও দ্বীনি সংগঠনের নেতৃত্ব পুরোপুরি ঢেলে সাজানো না পর্যন্ত এ সংকট থেকে বাঁচা সম্ভব নয়।

অবশ্য তিনি পৃথক নেতৃত্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও সংকটের কথা বলেন। তাহলো, প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের জন্য পৃথক নেতৃত্ব গড়ে তোলার মতো যেমন পর্যাপ্ত যোগ্য লোক নেই, তেমন নেই তা মেনে নেয়ার মানসিকতাও।

তার ভাষায়, ঢেলে সাজানোর জন্য তো লোক খুঁজেই পাচ্ছি না। উপাদান নেই। প্রতিটি স্তরে লোক এমনভাবে সেট করা আছে যে একদিক থেকে কথা একটা বললেই ‘ঠিক ঠিক’ আওয়াজ দেয়ার মতো লোকের অভাব নেই। আবার ভিন্নমত প্রকাশ করলেই তাকে বিভিন্ন দলভুক্ত করে দেওয়া হয় বা অন্যকিছু বানিয়ে দেয়া হয়।

তাহলে সমাধান? একটি সমাধানও দেন বর্ষীয়ান এ আলেম। তাহলো, মোটা দাগে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠনগুলো দুভাগে ভাগ করতে পারি আমরা। যারা রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃত্ব দেবেন তারা অরাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃত্ব দেবেন না। আর যারা অরাজনৈতিক সংগঠন পরিচালনা করবেন তারা রাজনৈতিক সংগঠনের পদগ্রহণ করবেন না।

হেফাজতে ইসলাম, হাইয়াতুল উলয়া-বেফাক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বে আছেন মুফতী মোহাম্মদ ওয়াক্কাস। তিনি অবশ্য মনে করেন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দও অরাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃত্বে থাকতে পারেন। শর্ত হলো, রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য অরাজনৈতিক প্লাটফর্মকে ব্যবহার করবেন না।

সাবেক এমপি ও প্রবীণ এ আলেমের কাছে শুকরানা মাহফিলের রাজনৈতিক বক্তব্য এবং হাইআতুল উলয়াকে হেফাজত প্রমাণে গণমাধ্যমের চেষ্টার দিকগুলো তুলে ধরলে তিনি বলেন, ‘কেউ সরকারের পক্ষে বা বিপক্ষে বলেন তাহলে তা রাজনৈতিক বক্তব্য না; বরং এটা তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। সেটা একজন আলেমেরও থাকতে পারে। রাজনীতি করা হবে যদি হেফাজত বা হাইআতুল উলয়ার ব্যানার ব্যবহার করে রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচি করা হয়।’

তাহলে কি আপনি শুকরানা মাহফিলে একটি বিশেষ দলের পক্ষে দেয়া বক্তব্যকে অনুমোদন দিচ্ছেন? ‘না, আমি অনুমোদন দিচ্ছি না। সেখানে কয়েকজন মানুষ এমন বক্তব্য দিয়েছেন যা দেয়ার কথা ছিলো না। যা একান্ত ব্যক্তিগত। সিদ্ধান্ত ছিলো রাজনীতি, দল ও নির্বাচনী আলোচনা হবে না সেখানে। সে সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করেছেন কেউ কেউ। সে দায় হাইআতুল উলয়ার উপর চাপানো ঠিক হবে না।’

হাইআতুল উলয়ার সদস্য মুফতী মোহাম্মদ ওয়াক্কাস জানান যারা সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করেছেন তাদের ব্যাপারে আগামী বৈঠকে আলোচনা হবে। তখন কোনো সিদ্ধান্তও আসতে পারে।

পূর্ববর্তি সংবাদআমেরিকার মধ্যবর্তী নির্বাচনে ধরাশায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প
পরবর্তি সংবাদভয়াবহ দাবানলে পুড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার শত শত বাড়িঘর