আবরার আবদুল্লাহ ।।
কয়েক বছর আগে পাকিস্তানের দক্ষিণে পাহাড়ি এলাকার রাস্তাগুলো যখন তুষারপাতের কারণে বন্ধ হয়ে যেতো, তখন এ এলাকার নবজাতক শিশু ও তাদের মায়ের জীবন মারাত্মক হুমকির মুখে পড়তো। কিন্তু এখন পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
শিশু ও মায়ের মৃত্যুর কারণ ছিলো প্রশিক্ষিত ধাত্রীর অভাব। এখন ওই এলাকায় বিপুল সংখ্যক প্রশিক্ষিত ধাত্রী বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাচ্চা প্রসবের সময় সহযোগিতা করছে। পাকিস্তানের পার্বত্য অঞ্চল হিমালিয়া, কারাকরম ও হিন্দুকুশ উপত্যাকায় এদের বলা হচ্ছে ‘সুপার ওমেন’ (বিশেষ শক্তিমান নারী) ।
আর এসব সুপার ওমেনদেরও সুপার যিনি তার নাম শহর বানু। তিনিই এলাকায় নিরাপদ প্রসবের জন্য নারীদের ধাত্রী প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। মানুষকেও নবজাতক শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
শহর বানু কেন এ কাজের উদ্যোগ নিলেন? জানা যায়, তিনি নিজ জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে এ কাজের উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমার যখন সন্তান হয় তখন এলাকায় এবং আশপাশের কোথাও কোনো ধাত্রী ছিল না। সন্তান প্রসবের জন্য আমি তিন দিন কষ্ট পাই। কিন্তু কেউ আমার সাহায্য করতে পারেনি। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিই আমি নিজে ধাত্রী প্রশিক্ষণ নেবো। যাতে আমার পরে আমার গ্রামের কেউ সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে কষ্ট না পায়।’
শহর বানু গিলগিট বেলুচিস্তানের একটি হাসপাতালে দেড় বছর প্রশিক্ষণ নেন। এরপর থেকে প্রায় ১০ বছর যাবত তিনি পাকিস্তান পর্বতসঙ্কুল এলাকায় বিনা পয়সায় নারীদের সন্তান প্রসবে সহযোগিতা করছেন।
পাকিস্তানের শতকরা ৬১ ভাগ শিশু ঘরে জন্ম নেয়। এর মধ্যে মাত্র ৩৯ ভাগ মা সন্তান প্রসবের সময় ধাত্রীর সহযোগিতা পান। তবে পাহাড়ি অঞ্চলে এ হার আরও অনেক কম।
শহর বানু জানান এক রাতে প্রচণ্ড তুষারপাত হচ্ছিলো। পাশের গ্রাম থেকে খবর এলো সেখানে যেতে হবে। আমি কোনো কিছুর পরোয়া না করেই বের হলাম। কিন্তু আমি রাস্তায় পড়ে অসুস্থ হয়ে পড়লাম। এক বছর পর্যন্ত সে অসুস্থতা আমাকে ভুগিয়েছে। তাই বলে আমি ফিরে আসিনি। সেই নারীর ডেলিভারি করিয়েছি। কারণ সেটা আমার দায়িত্ব ছিলো।
কাজের স্বীকৃতি হিসেবে শহর বানুকে গিলগিট বেলুচিস্তানের সরকার চাকরি দিয়েছে। এখন তার কাছে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও ওষুধের ব্যবস্থাও রয়েছে।
শহর বানু বলেন, আমার এলাকার মানুষ অনেক দরিদ্র। তারা টাকা পয়সা দিতে পারে না। আমি চাইও না। কেউ একশো রুপি দেয়, আবার কেউ শুধু এককাপ চা খাওয়ায়। ভালো হতো আমি যদি তাদের ওষুধপত্রও সরবারহ করতে পারতাম। কিন্তু আমার কাছে ওষুধ থাকে না। আমি তাদের নাম লিখে দেই তার কিনে খায়।
অবশ্য এখন পাকিস্তান সরকার সেখানে নারীদের ধাত্রী প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের চাকরিও দেয়া হচ্ছে।
শহর বানুর এখন একটি ডিসপেনসারি রয়েছে। তবুও তিনি এখনও ঘরে ঘরে যান। গর্ভবতী নারীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। তাদের পরিমিত ও সুষম খাবার গ্রহণের পরামর্শ দেন। প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বনের কথা বলেন। যেন বাচ্চার গঠন ঠিক থাকে।
স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর স্বাভাবিক মনে হয় তবে শহর বানু নিজে ডেলিভারি করান। আর স্বাভাবিক না হলে সাথে সাথে হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন।
শহর বানু বলেন, আমি গ্রামের রাস্তায় যখন হাঁটি তখন অনেক শিশুকে আনন্দ উল্লাস করতে দেখি, স্কুলে যেতে দেখি। তাদের দেখে আমার মন আনন্দে ভরে যায়। মনে তারা সবাই আমারই সন্তান।
সূত্র : বিবিসি উর্দু অবলম্বনে
