মুকীম আহমাদ ।। মালয়েশিয়া থেকে
দিন দিন যেন বেড়েই চলছে নির্যাতনের মাত্রা । পরিবর্তন হচ্ছে নিপীড়নের পদ্ধতি আর জুলুমের নিত্য-নতুন কৌশল । কেবল স্হানীয় ইউনিয়ন-প্রতিনিধি নির্বাচন হয়ে গেল । এটাই যেন কাল হয়ে দাঁড়ালো বাইশ বছরের যুবক মংডুর বাসিন্দা হাফেজ শফিকের । অধিকারহারা জীবন । আর্থিক স্বচ্ছল হলেও ভাড়ায় চলে জীবন । ভাড়ায় স্বাধীনতা । বাবাকে হারায় সেই ছোটবেলায় । মেধা-প্রতিভার খবর পাড়া-প্রতিবেশীর মুখে মুখে । তাই জীবন চলছে মিলিটারির চোখে চোখে । দুই দিন পরপর গ্রেফতারের হুমকি । টাকা দিলে ছেড়ে দেয় । বড় ভাইকে তুলে নিয়ে গেল । টাকার বিনিময়ে ছাড়িয়ে আনলো । স্বচ্ছল পরিবারগুলোর সঙ্গে এমনই ছিল তাদের আচরণ । বাধ্য হয়েই রোহিঙ্গা মুসলিম পাড়ি জমাতো প্রতিবেশী দেশে ।

২০১২ সালের দিকে । অন্য অনেকের সাথে হাফেজ শফিকও বের হয়ে পড়েন নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে । বিদায়বেলায় মাকে বলেন, ‘মা ! বেঁচে থাকলে ফোন দেবো কয়েক মাসের মধ্যে । আর কোন ফোন না পেলে আমার আত্মার শান্তির জন্য দোয়া করো’ । বুকে কুরআন ছেলের কোন অনিষ্ট হবে না, এইটুকুই যা শান্ত্বনা । কিন্তু পরাধীন মনে মায়ের স্বাধীনতার প্রদীপটি আর জ্বলে নেই একটুও। যুগ যুগ ধরে সাক্ষী হয়েছেন কতশত চেনাজনের ছেড়ে যাওয়া বিজন পথে , ফিরে আর আসেনি যাদের একজনও । তাই পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে যেন বেরিয়ে এলো প্রিয় মানিক হারাতে যাওয়ার কষ্টগুলো । তবুও নাড়তে হলো বিদায়ের হাত ।
হাফেজ শফিক বেরিয়ে পড়লেন দুঃস্বপ্নের পথে । ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্নবুকে, রক্তাক্ত ছেলেবেলা ফেলে । ঘাটে বাধা নৌকায় চড়ে ছাড়লেন মংডু । শাখা নদী পেরিয়ে নৌকা ঢুকে পড়লো সাগরে । তীরেই ভেড়ানো বোট । মিলিটারি বোট । রক্তচোষা খাকি-পোষাকের লোকগুলো উৎফুল্ল । আরাকান শূন্য হতে থাকবে এভাবেই । নারী-পুরুষ এভাবেই এই তীর ছেড়ে যায় জীবনের তরে । জীবনের জন্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ।
সাগরের বুক চিড়ে ছুটে চলে মিলিটারি বোট । দূরে নোঙর করা কার্গো জাহাজ । রাতের আঁধারেও বোঝা যায় জাহাজভর্তি মানুষ। নারী-পুরুষের চেঁচামেচি, শিশুদের কান্নার আওয়াজ । দালালের লেনদেন চুকিয়ে শফিক ওঠে যায় ভাসমান কফিনে । এটা কফিনই । এখানে মৃতরাই ওঠে । মরে মরে কিছুলোক বেঁচে থাকে । কার্গোটি দুলে উঠলো । সাইরেন বাজিয়ে চলতে শুরু করলো । হাফেজ শফিক শেষবারের মতো তাকলো প্রিয় জন্মভূমির দিকে । আহা প্রিয় আরাকান ! গোটা শরীরেই কষ্ট । পুরোটা জুড়েই জখম ।
শফিক ডেকের নিচ তলায় । কোনরকম বসা যায় । একটু পরপর দালালদের কর্কশ স্বর ভেসে আসছে । টাকা-পয়সার হিসেব চলছে । উপরের তলায় মারধর চলে কথায় কথায় । একটু পরপর কানে আসছে গায়ে লাঠি পড়ার শব্দ । ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠার ক্ষীণ আর্তনাদ । সবকিছু মিলিয়ে যায় ঢেউয়ের গর্জনে, দূর অনন্তে । ক্লান্ত হাফেজ শফিকের দেহটা নেতিয়ে পড়ে । হারিয়ে যায় গভীর ঘুমে ।
ভোর হলো ক্ষুধার্ত শিশুদের কান্নাকাটিতে । খাবার শুধু মধ্যাহ্ণে । ‘মাম্মী’ দেয়া হয় প্রত্যেককে একটি করে, শুকনো খাবার , আর সামান্য সংরক্ষিত পানি । সকালে আর রাতে খাবারের কোন আয়োজন নেই । এভাবেই চলে সাগররে বুকে প্রথম দিন । সুপেয় পানির সঙ্কট শুরু । বৃষ্টি আর সাগরের লোনা পানিতে শুরু হলো বেশিরভাগ যাত্রীর পাকস্হলীর সমস্যা । হাফেজ শফিকেরও তাই। হঠাৎ শফিক টের পেলেন ডেকের উপর থেকে পানি পড়ছে । উৎকট গন্ধে দম বন্ধ হবার উপক্রম । উপর থেকে কেউ প্রস্রাব করছে । জায়গা পরিবর্তনের কোন উপায় নেই । ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা । পরনের একমাত্র জামাটি ভিজে লেপ্টে আছে পিঠ । পুরো ডেকজুড়ে শুরু হলো মলমূত্র ত্যাগ । যে যার জায়গায় থেকেই । ৪৭৮জন যাত্রী । কোথাও তিল ধারণের জায়গা নেই ।
হঠাৎ সাগর উত্তাল হয়ে গেলো । বিশাল বিশাল ঢেউয়ে কার্গো বেসামাল এদিক-ওদিক কাত হয়ে পড়ছে । ভয়ানক গর্জনে আছড়ে পড়ছে ঢেউগুলো । পানির তোড়ে ছিঁটকে গেল কতজন । সাগরেই সমাহিত হলো ওরা । ডেকের বাইরে থেমে গেলো তুফান । কিন্তু ভিতরে যাত্রীদের জীবনে নেমে এলো নতুন এক তুফান । ডায়রিয়া, আর পানিশূন্যতা । একের পর এক মারা যেতে থাকলো লোকগুলো । হাফেজ শফিক বেঁচে আছেন রবের দয়ায় । কার্গোটা এখন একটা কাঠের কফিন । শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্ষীণ শব্দগুলোই শুধু শোনা যায় । এভাবেই সপ্তম দিনে ৩৫০জন জীবিত দেহ নিয়ে থাইল্যান্ডে পৌঁছায় কার্গোটি ।

দালালদের হাত বদলে থাইল্যান্ডের বাদামবুছা খাড়া পাহাড়ের চূড়ায় শুরু হয় জীবন্ত কঙ্কালদের দুঃসহ জীবন । হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয় । চূড়া থেকে দূরে দেখা যায় যেন গোটা মালয়শিয়া । আলো ঝলমল নগরী । কঙ্কাল-দেহে যেন প্রাণের স্পন্দন । কিন্তু থাই সেনাদের অত্যাচারে জীবনের আলো যেন আবার নিভু নিভু । জঙ্গলে ফেলে টাকার জন্য মারধর । মৃতপ্রায় করে ফেলে । প্রতিদিনই চোখের সামনে মারা পড়ে ভাগ্য-খোঁজে ফেরা হতভাগা কেউ না কেউ । নিরুপায় শফিক কুরআন তেলাওয়াত করতে থাকেন । বুকে বেঁচে থাকার ভীষণ আকুতি । আঘাতে জর্জরিত নিস্তেজ শরীরটা । দিন যায় । মুক্তির কোন আয়োজন দেখা যায় না । মনের কোণে তবু জ্বলছে আশার নিভু নিভু পিদিমটা । কষ্টেরা দলা পাকাতে থাকে । চোখের দূরত্বে গন্তব্য । এভাবে পনেরো দিন পার হলো । উদিত হলো মুক্তির নতুন প্রভাত । থাই সেনারা দ্রুত তাড়া দিল । তুলে দিল নতুন দালালের হাতে । লোকটি স্বজাতি, মুসলিম । ব্যবহারে বেশ কোমল । এবার যাত্রা গন্তব্যে, দৃষ্টি সীমায় হলেও দালাল লোকটি জানিয়ে দিল, দুদিনের পথ । উঁচু উঁচু পর্বতসারি । সমতলে ভয়ানক খাদ, মরণ ফাঁদ। এই সবই পেরিয়ে পৌঁছুতে হবে গন্তব্যে । দলছুট হলেই হারিয়ে যাবে গহীন অরণ্যে ।
ছুটে চললো জীর্ণ-শীর্ণ রুগ্ন দেহগুলো । এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড় । কুদরতের ইশারায় বেঁচে থাকা । যেতে যেতে পথেই দেহত্যাগ করলো কতজন । দুই দিন দুই রাত পর বেঁচে থাকা মানুষগুলো দেখতে পেলো কয়েক ক্রোশ দূরেই মালয়শিয়ার সীমান্ত । কেডাহ প্রদেশ । উঁচু পাহাড়। পাহড়টিই দুটি দেশকে আলাদা করেছে । সীমান্তরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়েই হাফেজ শফিক প্রবেশ করলো স্বপ্নের ফটকে । সীমান্তরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দেয়া যায় না । রাষ্ট্রের হৃদয় গলে ঢুকে পড়েছে প্রতিদিন শতশত রোহিঙ্গা ।
অচেনা দেশ , অচেনা পথঘাট , অচেনা তার মানুষ । একজন মালয় নারীর দেয়া খাবারে যেন খুঁজে পেল অমৃত স্বাদ । দীর্ঘ পঁচিশ দিন পর পেট পুরে খেতে পেলো হাফেজ শফিক । তারপর অচেনা এই দেশে কুদরতের ইশারায় যেন ঢুকে পড়লো বালাই পুলিশে (পুলিশ ফাঁড়ি) । জিজ্ঞাসাবাদে (দোভাষীর মাধ্যমে) যখন জানতে পারলো শফিক একজন কুরআনের হাফেজ । দয়া হলো পুলিশের মনে । পৌঁছে দিল রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত এলাকায় । পুলিশের সহযোগিতায় শুরু হয় বেঁচে থাকার নতুন সংগ্রাম । আশ্রয় নেন মসজিদে । মসজিদের কোণে পড়ে থাকায় শফিককে দেখে স্হানীয় তাবলিগি সাথীরা পৌঁছে দেয় এক মাহাদে । আজও আছেন সেই মাহাদে । পেয়েছেন UNHCR (United Nations High Commission for Refugees) এর রিফিউজী কার্ড । পরিচিত কত আলেম পাড়ি জমিয়েছেন ইউরোপ আমেরিকায় জাতিসঙ্ঘের খরচে, পেয়েছেন নাগরিকত্ব -এভাবেই আপন করে নেয় অমুসলিম দেশগুলো আমাদের ভাইবোনদের , তারপর করে নেয় তাদের সর্বাঙ্গে- । কিন্তু হাফেজ শফিক সুযোগ পেয়েও যে দ্বীনের জন্য দেশহারা সে দ্বীনকেই আপন করেছেন । রয়ে গেছেন কুরআনের খেদমতে, মালয়শিয়াতে ।
