[তাবলিগ জামাতের বর্তমান সংকট ও দিল্লির মাওলানা সাদ সাহেবের ভ্রান্তি বিষয়ে একটি তত্ত্বপূর্ণ ও বিশ্লেষণী আলোচনা। বিশেষ ওয়াজাহাতি বয়ান। প্রখ্যাত হাদীস শাস্ত্রবিদ, মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকার আমীনুত তালীম হজরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব গত ৫ নভেম্বর বাদ-এশা মিরপুর ১২ মোল্লা মসজিদে এই বয়ানটি পেশ করেন। তাবলিগ জামাতের সাথী ও ওলামায়ে কেরামের অনুরোধে পেশকৃত সেই বয়ানের প্রথম পর্ব এটি। ইনশাআল্লাহ শিগগিরই এ বয়ানের দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশ হবে।]
হামদ ও সালাতের পর।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দ্বীনি ফিকির নিয়ে বসার তাওফিক নসিব করেছেন।
আমি ভূমিকা ছাড়াই কথা শুরু করছি। আমাদের প্রথম যে কথাটি বোঝা ও মনে রাখা দরকার সেটা হলো, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দ্বীন-ইসলাম দান করেছেন। আল্লাহ তাআলার সবচেয়ে বড় নেয়ামত ইসলাম। এই দ্বীনের হেফাজত ও প্রচার-প্রসারের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন দ্বীনের অনেকগুলো মেহনতের রাস্তা আমাদের জন্য খুলে দিয়েছেন। এ মেহনতগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এবং অনেক উপকারী মেহনত হলো দাওয়াত ও তাবলিগের মেহনত। দ্বীনের প্রতিটি মেহনত উম্মতের হাতে আমানত। এই আমানত যেন যথাযথ সংরক্ষিত থাকে এবং এতে কোনো ধরনের খেয়ানত না হয় এ দিকে খেয়াল রাখা সবার ওপর ফরজ।
এখন এই মেহনতের ওপর বিশাল এক পরীক্ষা এসে পড়েছে। মুমিনের দায়িত্ব হলো পরীক্ষায় পাস করা। শরিয়তের বিধান জানার চেষ্টা করা, এই পরীক্ষাতে আমি কীভাবে পাস করব। যদি তা করতে পারি তাহলে দ্বীনের আমানতের হক আমরা আদায় করলাম। যদি তা না করি তাহলে আমানতের খেয়ানত হলো।
দাওয়াত ও তাবলিগের যেই পরীক্ষা চলছে সেই পরীক্ষায় আমরা অনেকেই কিন্তু পাস করছি না। কেন? যে মুসবিত আমাদের ওপর এসে পড়েছে, দরকার ছিল এই ক্ষেত্রে হক কোনটা সেটা বুঝার চেষ্টা করা। হক বুঝে হকটাকে মেনে নেওয়া। বিভক্ত না হওয়া। কিন্তু আমরা বিভক্ত হয়ে গেছি। এই মেহনতের মধ্যে কখনো বিভক্তির কথা চিন্তাও করেনি কেউ। যেখানে এক দস্তরখানে না শুধু, এক পাত্রে বসে সবাই খাচ্ছে। ছোটরা বড়দের কী খেদমত করবে, বড়রাই ছোটদের খেদমত করছে। এই মহব্বত কোথায় গিয়েছে এখন?
এই যে বিভক্তি সৃষ্টি হলো, এটা আমরা অন্যায় করেছি। এ জন্য আমরা অপরাধী। এই অপরাধের পর আমাদের অপরাধের মাত্রা আরও বাড়াচ্ছি। দরকার ছিল বিভক্তি হওয়ার পর বুঝাপড়া করা। এরপর আগের অবস্থানে ফিরে আসা। এটা করছি না। এটা আমাদের আরেক অপরাধ।
এখন আমার অনুরোধ- আমরা বিভক্তি ছেড়ে হকটা বুঝার চেষ্টা করি। হকের ভিত্তিতে এক হই। ঈমানের প্রাথমিক অবস্থা (আলিফ বা তা সা) হলো হক মানার যোগ্যতা অর্জন করা। যদি এই সৎ সাহস না থাকে, তাহলে এত বছর কী ঈমান শিখলাম! আমার বিরুদ্ধে যাক, আমার বাপের বিরুদ্ধে যাক, আমার উসতাদের বিরুদ্ধে যাক, হক মানার যোগ্যতা আমার মধ্যে আসতে হবে। হক মানার যোগ্যতার নামই হলো ঈমান।
হক মানার এই সৎ সাহস আমাদের অনেকের নেই। আমরা বিভক্তি আরও বাড়াচ্ছি। হজরত মাওলানা সাদ সাহেবের এতায়াত করতে গিয়ে বিভক্তি এলো। ওলামায়ে কেরাম তার এতায়াত করতে নিষেধ করেন। এ জন্য কিছু লোক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আমরা তার এতায়াত করবই। আমরা অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে যাই।
বিভক্তির পর উভয় পক্ষ থেকে অনেক বড় বড় গুনাহ হচ্ছে। কবিরা গুনাহ। কারও কম, কারও বেশি- সেটা ভিন্ন কথা। সবার থেকে হচ্ছে তা বলছি না। অনেকের থেকে হচ্ছে। এই কবিরা গুনাহগুলো থেকে বেঁচে যাওয়া যাবে, যদি আমরা হজরত মাওলানা সাদ সাহেব দা. বা.-এর এ কথাটা খেয়াল করি। তিনি বলেছেন- আলেমদের মুহসিন মনে করো। তারা ভুল ধরিয়ে দিলে সংশোধন করে নাও।
এ কথা তিনি নিজামুদ্দিনের হায়াতুস সাহাবার মজলিসে বারবার বলেছেন। এখন এই কথার ওপর কি আমরা আছি? যদি তার এতায়াত নিয়েই বিভক্ত হই তাহলে তার এ কথাটা মানছি না কেন?
রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পরষ্পর সম্পর্ক নষ্ট হওয়া এটা ‘মাথা মুণ্ডনকারী’।
এ কথার উদ্দেশ হলো, এটা দীনকে শেষ করে দেয়। এই একটা বিষয়ই অনেক গুনাহ টেনে আনে। বদগুমানির গুনাহ, একজন আরেক জনের বিরুদ্ধে বলার গুনাহ, গিবতের গুনাহ, গালমন্দের গুনাহ ইত্যাদি। এগুলো হচ্ছে। এখন তো এটা চলে গেছে মারপিট এবং হাতাহাতির মধ্যে। আমাদের দেশে এবং বাইরের দেশেও। পরষ্পর সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার কারণে শত গুনাহ টেনে আনছে। বিভক্তি যদি শেষ না-ও করতে পারি, কমপক্ষে ভদ্রতা ও শালীনতা অবলম্বন করি।
রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত হিসাবে কিছু সাধারণ হক আছে একে অপরের মাঝে। সাধারণ সেই হকগুলো আদায় করি। তাবলিগি ভাই কীভাবে গালি দেয়? তার মুখে কীভাবে গালি আসে? বড় আফসোসের বিষয়!
যতক্ষণ হক কবুল করার সৎ-সাহস হবে না, কমপক্ষে তৃতীয় এই অপরাধ থেকে বেঁচে থাকি- যবান ও কলম নিয়ন্ত্রণ রাখি। হাতকে নিয়ন্ত্রণ করি। মুমিন তো সংযমী হয়। মুমিনের যবান, কান, হাত ও কলম নিয়ন্ত্রণহারা হতে পারে না। রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, মুক্তি পাব কীভাবে? নবীজি প্রথম নসীহত করেছেন, জবানটাকে নিয়ন্ত্রণ করো।
একটা বিষয় আমাদের অনেক ভাই বুঝতে চান। হজরত মাওলানা সাদ সাহেব দা. বা.-এর এমন বড় কি অপরাধ হয়ে গেল, যার কারণে এতকিছু বলা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে! ভুল হয় মানুষের, কত জনেরই তো ভুল হয়। ভুল কার না হয়? তারও কিছু ভুল হয়েছে। তো এত উৎপাতের কী আছে? ভুল হয়েছে। ভুল থেকে তো তিনি আবার রুজু করেছেন। তারপরও কেন এত কথা?
যারা আসলেই এ বিষয়টা বুঝতে চান তাদের বলছি। তার আগে ভূমিকাস্বরূপ কয়েকটা কথা জানা দরকার। সেটা হলো, ভুল কাকে বলে? আরবি ভাষায় একটা শব্দ আছে, নিসইয়ান- ভুল হওয়া। যেমন কেউ রোজা রেখেছে, ভুলে গেছে। সামনে পানির গ্লাস আছে পানি খেয়ে ফেলেছে। রোজার কথা মনে নেই। এটাকেও ভুল বা নিসইয়ান বলে। এই ভুলের জন্য রোজার কাযা আদায় করতে হয় না। এটা মাফ।
আরেকটা হলো, কেউ ওযু করছে। মনে আছে সে রোজাদার। কুলি করার সময় একটু পানি বেখেয়ালে গলার ভেতর চলে গেছে। এটাও এক ধরনের ভুল। রোজার কথা মনে থাকার পরও অনিচ্ছায় একটু পানি ভিতের চলে গেছে। এটাও ভুল। এটাকে আরবিতে বলে- খতা। এর কারণে গুনাহ হবে না, কিন্তু এই রোজার কাযা আদায় করতে হবে।
আরেকটা হলো, ছেলে ১৭/১৮ বছরের বালেগ-প্রাপ্তবয়স্ক। শরিয়তের বিধিবিধান তার ওপর আবশ্যক। রোজার নিয়ত করে সেহেরি খেয়েছে। মা বললেন, রোযা ভাঙ। পরীক্ষা ভালো হবে না। মায়ের কথা শুনে ছেলে রোজা ভাঙল। ছেলে এটা ভুল করেছে। এই ভুলটা কেমন? গুনাহ হবে। রোজার কাযা আদায় করতে হবে, কাফফারাও আদায় করতে হবে।
এই তিন প্রকার ভুল দেখলেন। বাংলায় বলার সময় এই তিনটাকে একটা নামেই বলা হয়- ভুল। কিন্তু আরবিতে এগুলোর আলাদা আলাদা নাম রয়েছে- নিসইয়ান, খতা, তায়াম্মুদ। ভুলের এই বিষয়গুলো ওলামায়ে কেরাম জানেন ও বোঝেন। ইসলামি ফিকহ-ফতোয়ার কিতাবে এগুলো স্পষ্ট করা আছে- কোন ভুল কোন পর্যায়ের।
এমনিভাবে আমলের ভুল আর আকিদার ভুল- দুটা এক নয়। দুটার মাঝে আসমান যমিনের ফারাক। এক ব্যক্তি নামাজ ফরজ এটা জানে। তার ঈমান আছে কিন্তু অলসতা করে নামাজ পড়ে না। আবার কিছু লোক আছে, নামাজ যে ফরয এটাই বিশ্বাস করে না। এ দুজন কি এক? দুজনের মধ্যে বিশাল পার্থক্য। একটা হলো আমলের ভুল আরেকটা হলো আকিদার ভুল।
এমনিভাবে শরিয়তের বিধানের মধ্যেও পার্থক্য আছে। একটা হলো বিধান লঙ্ঘন করা আরেকটা হলো বিধান পরিবর্তন করা। দুটার মধ্যে আসমান-জমিনের বিশাল ফারাক।
এই তিন প্রকার ভুল দেখলেন। বাংলায় বলার সময় এই তিনটাকে একটা নামেই বলা হয়- ভুল। কিন্তু আরবিতে এগুলোর আলাদা আলাদা নাম রয়েছে- নিসইয়ান, খতা, তায়াম্মুদ। ভুলের এই বিষয়গুলো ওলামায়ে কেরাম জানেন ও বোঝেন। ইসলামি ফিকহ-ফতোয়ার কিতাবে এগুলো স্পষ্ট করা আছে- কোন ভুল কোন পর্যায়ের।
এমনিভাবে আমলের ভুল আর আকিদার ভুল- দুটা এক নয়। দুটার মাঝে আসমান যমিনের ফারাক। এক ব্যক্তি নামাজ ফরজ এটা জানে। তার ঈমান আছে কিন্তু অলসতা করে নামাজ পড়ে না। আবার কিছু লোক আছে, নামাজ যে ফরয এটাই বিশ্বাস করে না। এ দুজন কি এক? দুজনের মধ্যে বিশাল পার্থক্য। একটা হলো আমলের ভুল আরেকটা হলো আকিদার ভুল।
এমনিভাবে শরিয়তের বিধানের মধ্যেও পার্থক্য আছে। একটা হলো বিধান লঙ্ঘন করা আরেকটা হলো বিধান পরিবর্তন করা। দুটার মধ্যে আসমান-জমিনের বিশাল ফারাক।
ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, বিধান পরিবর্তন করা মহা পাপ। আরেকটা হলো বিধান না মানা। বিধান না মানলে আমি অপরাধী। অন্যায় হয়েছে। কিন্তু বিধান লংঘন আর বিকৃতি আসমান জমিনের ফারাক।
সাধারন গুনাহ আর বিদাতের গুনাহ এক না। বিদাতের গুনাহ হলো শরীয়তে হাত দেয়া। এজন্য বিদাত কঠিন পাপ। এই জিনিসগুলোর পার্থক্য আমাদের অনেক সময় স্পষ্ট থাকে না।
দেখুন, একটা হলো ব্যক্তি পর্যায়ে গুনাহ আরেকটা হলো দশের সামনে লিপ্ত হওয়া, সমাজে লিপ্ত হয়ে গুনাহ করা। নিজেও করছে, সমাজের আরও ১০ জনকে লিপ্ত করছে।
একটা হলো নিজের ব্যক্তিগত আমলের ত্রুটি। একজন সাধারন মানুষ। চিল্লায় বের হলে প্রথম দুই-তিন দিনের বয়ানে তার ভুল হয়। কত ভুল হয়। সবাই চুপ করে শোনে। কেউ প্রতিবাদ করে না। বেচারা নতুন মানুষ। কেবল শিখছে। ওর কথা কে আবার দলিল হিসেবে পেশ করবে। আরেকটা হলো, ধরুন আমাদের খতিব সাহেব। জুমার দিন মিম্বারে বসে বয়ান করছেন। মসজিদের দোতলা-তিনতলা সব মানুষে ভর্তি। কথার কথা, তিনি জাল হাদিস বলছেন, ভুল মাসয়ালা বয়ান করছেন। এই উভয়টা কি এক রকম ভুল?
লাখ লাখ মানুষের সামনে ভুল বলছি। হাজার হাজার মানুষ এটা নকল করতে থাকবে। উদ্ধৃতি দিতে থাকবে। এখন আমি যদি লাখ লাখ মানুষের সামনে ভুল বলার পরও চুপ থাকি তাহলে গুনাহ হবে না? অবশ্যই গুনাহ হবে। আজকাল কেন জানি আমরা এ বিষয়গুলোর পার্থক্য করতে পারি না। ভুলে ভুলে পার্থক্য আছে। এবং কে ভুল করছেন, কোন জায়গায় করছেন কী ভুল করেছেন এটার মধ্যে পার্থক্য আছে। এ জন্য কোথাও কোথাও চুপ থাকা যায় আবার কোথাও আবার চুপ থাকা যায় না। যেখানে চুপ থাকা যায় না, সেখানে কে কথা বলবে, কীভাবে বলবে এ বিষয়েও শরিয়তে আদাব ও নিয়মনীতি বলে দেওয়া আছে। এগুলো আমাদের জানার অভাব এবং মানার অভাব।
আরেকটা উদাহরণ খেয়াল করুন, একজনের ওপর অনেকের হক থাকে। মাতা-পিতার হক, স্ত্রীর হক, সন্তানের হক, তার ছাত্রদের হক, তাদের অধীনে কাজ করা লোকদের হক ইত্যাদি।
সব হক একসাথে চালানো যায়, একসাথে পালন করা যায়।
কিন্তু কখনও এমন পরিস্থিতি হয়, যখন একটা হলে আরেকটা হয় না, সমন্বয়ও করা যায় না। তখন কী করণীয়? যে কোনো একটাকে প্রাধান্য দিতে হবে। শরীয়তে করণীয় ও বর্জনীয় উভয় ক্ষেত্রে এ ধরনের বহু বিষয় আছে যাকে ফিকহুল আওলাউইয়্যাত বলে। যখন কোনটা আগে করব কোনটা পরে করব সমন্বয় করা যায় না, শরিয়তে এসব বিষয়ের বিধান দেওয়া আছে।
এখন আমি এক ভাইকে মহব্বত করি। আমার বন্ধু। আমার উপর তার হক আছে। সে হকের বিপরীত কোনো কিছু বলে বসল বা করে বসল। তাহলে আমি তাকে সংশোধন করব। সংশোধন না হলে কী করণীয়- এসব বিষয়ে শরিয়তে মাসয়ালা আছে।
ধরুন, আমার উসতাদ, আমার উপর তার এহসান ও অনুগ্রহ রয়েছে। আমার উসতাদ ভুল বলছেন, ভুল করছেন। এই ভুলে কি আমি তাকে সহযোগিতা করব? আমার একদম আলিফ বা তা থেকে বোখারি পড়া উসতাদ। কিন্তু তিনি ভুল করে বসেছেন। আমার করণীয় কী?
এগুলো ভাবতে হবে। এ বিষয়গুলো আমাদের জানা দরকার। আমরা দ্বীনের ভাসা ভাসা কিছু বিধান শিখি। অনেক বিষয় আমাদের যিন্দেগিতে প্রয়োজন হয়, কিন্তু ভাবি না এর বিধান শরিয়তে আছে, এটা শেখা ও জানার চেষ্টাও করি না। আমাদের শিখতে হবে, জানতে হবে। আজকাল যে সংকটটা আপনারা দেখছেন, এটা হলো বিধানগুলোর পার্থক্য না বোঝা। এটা হলো সংকট।
আমি সাদ সাহেবকেও মহব্বত করি । হককেও মহব্বত করি। দুটা একসঙ্গে চলছে। মহব্বত করতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু আমি যখন দেখব সাদ সাহেব ও হক আলাদা হয়ে যাচ্ছে, আকিদার বিষয়ে, শরিয়তের বিভিন্ন বিধানের বিষয়ে। সমন্বয় করা যাচ্ছে না। এখন আমি কী করব? এতদিন দুটাকে একসঙ্গে পেতাম, এখন দুটাকে একসঙ্গে পাচ্ছি না।
আমি দুআ করছি। যাদের চেষ্টা করার যোগ্যতা আছে তারা করছেন। কিন্তু দুটার মধ্যে সমন্বয় হচ্ছে না। দুটো বিষয় একসঙ্গে হচ্ছে না। এখন আমার ওপর শরিয়তের করণীয় কী?
শরিয়ত আমাকে বলে, হককে প্রাধান্য দিতে হবে। হককে মানতে হবে। আর অপর ব্যক্তির সঙ্গে দুশমনি করবো না, তার জন্য দুআ করব। এটা শরিয়তের এত বড় মৌলিক কথা এবং এত বড় ফরজ বিধান এটা, যেটার দ্বারা ঈমানের পরীক্ষা হয়।
এটা হলো আজকের বিষয়ের ভূমিকা। এখন কথা হলো, কেউ কেউ বলেন, হুজুরদের শত দোষ। কেয়ামত যত কাছে আসবে, মানুষের দুর্বলতা বাড়বে। হুজুররাও তো মানুষ। যেমন রোগী তেমন ডাক্তার। হুজুরদের এক-দুই দুর্বলতা না, শত দুর্বলতা আছে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তার দীন হেফাজত করার ওয়াদা করেছেন। হুজুরদের শত ত্রুটি-দুর্বলতা, আমলের কমতি এবং ভুল পদক্ষেপ থাকারও পর একটা জায়গায় আল্লাহ তাআলা হুজুরদেরকে একদম টাইট ও মজবুত করে রাখেন। একদম পাহাড়ের মতো অটল রাখেন। সেটা হলো আকিদার বিষয়ে। শরিয়তের বিধানের বিষয়ে। শরিয়তের বিধান লঙ্ঘিত হচ্ছে, কখনও শয়তানের ধোকায় বা যে কোনো কারণে হোক, ভুলে নিজে লঙ্ঘন করে ফেলেছে হতে পারে, কিন্তু শরিয়তের বিধান কেউ উলটপালট করবে, আর হুজুররা খামোস, চুপচাপ থাকবে এটা হতে পারে না। একজন-দুইজন চুপ থাকতে পারে, কিন্তু ১০ জন এটাকে সংশোধন করার চেষ্টা করে। সংশোধনী না মানলে ওটার কঠিন প্রতিবাদ করেন হুজুররা।
যেহেতু দীনকে আল্লাহ তাআলা হেফাজত করার এবং কেয়ামত পর্যন্ত টিকেয়ে রাখার ওয়াদা করেছেন, তো নবীর ওয়ারিস আলেমদের দিয়েই তিনি দ্বীনকে হেফাজত করবেন। এ জন্য হুজুরদের সব দোষ সত্ত্বেও এ বিষয়ে হুজুরদেরকে আল্লাহ তাআলা পুরা মজবুত রাখেন। কেউ বলতে পারে, আরে উনি কি ওত বড় বুযুর্গ নাকি? আমরা জানি না তার কত ত্রুটি! আমরা তারে ভালেভাবেই চিনি। কিন্তু এখন দেখি হুজুর এত মজবুত!
আসল কারণ হলো, আলেমরা আকিদা ও শরিয়তের বিধানের বিষয়ে মজবুত। শরিয়তের বিধান কেউ পরিবর্তন করে ফেলবে এটা হতে পারবে না। আল্লাহ তাআলা এই যোগ্যতা আলেমদেরকে দান করেছেন।
হযরত মাওলানা সাদ সাহেবের যে ভুলগুলো আছে সেগুলো ব্যক্তি পর্যায়ের না। কত জনেরই তো ব্যক্তি পর্যায়ের কত ভুল আছে, সেগুলো কেউ আলোচনায় আনে না। সাদ সাহেবের ব্যক্তিগত বিষয় ওলামায়ে কেরাম আলোচনায় আনছেন না। এমনিভাবে যেটা তিনি ভুলে বলে ফেলেছেন সেটাকে স্বীকার করা- আমি তো খেয়াল করি নি, ভুলে বলে ফেলেছি। তার এ ধরনের ভুল নিয়ে কেউ আলোচনা করছেন না।
হজরত মাওলানা সাদ সাহেবের আকিদা ও শরিয়তের বিধানগত ভুল হঠাৎ করে হয়েছে, তা কিন্তু না। যখন থেকে আপনারা জানেন, তখন থেকেও না। আরও অনেক বছর আগ থেকে শুরু হয়েছে। কমপক্ষে ৯/১০ বছর আগ থেকে তার এই ভুলগুলো শুরু হয়েছে। তখন থেকেই এগুলোর সংশোধন করার চেষ্টা করা হয়েছে। ভিতরে ভিতরে চেষ্টা করা হয়েছে। এবং অনেকে মিলে চেষ্টা করেছেন। বিভিন্নভাবে চেষ্টা করা হয়েছে। সাক্ষাতে তাকে বলা হয়েছে। লিখিতভাবে তাকে বলা হয়েছে। তার মুরুব্বিরা বলেছেন। খান্দানের মুরুব্বিরা তাকে বুঝিয়েছেন।
সবচেষ্টার পরও তিনি মারাত্মক ভুলগুলোর ক্ষেত্রে অনড় অটল। তখন বাধ্য হয়ে দারুল উলুম দেওবন্দ একটা ফতোয়া দিয়েছে এবং সেটার প্রকাশ করেছে। এই ফতোয়ার আগে কত জনে কতভাবে বুঝিয়েছেন। কখনোই তিনি রুজুর নাম নেননি। যখন দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া একদম প্রস্তুত এখনো প্রকাশ হয়নি, তিনি লোক পাঠিয়েছেন। এটা তার প্রথম রুজু।
হজরত মাওলানা সাদ সাহেবের খান্দানকে আপনাদের চেয়ে আমরা বেশি চিনি। তাকে আপনাদের চেয়ে আমরা বেশি মহব্বত করি। কিন্তু এখন সেই মহব্বতের প্রকাশ তো ঘটাতে পারছি না।
(বয়ানের পরের অংশ ‘নবীগণের সিরাত আলোচনা করব হেদায়েত গ্রহণের জন্য, দোষ খোঁজার জন্য নয়’ আসছে ইনশাআল্লাহ)
বয়ানের ২য় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন : ‘নবীগণের সিরাত আলোচনা করব হেদায়েত গ্রহণের জন্য, দোষ খোঁজার জন্য নয়’
অনুলিখন : সাদ আবদুল্লাহ মামুন
