[তাবলিগ জামাতের বর্তমান সংকট ও দিল্লির মাওলানা সাদ সাহেবের ভ্রান্তি বিষয়ে একটি তত্ত্বপূর্ণ ও বিশ্লেষণী আলোচনা। বিশেষ ওয়াজাহাতি বয়ান। প্রখ্যাত হাদীস শাস্ত্রবিদ, মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকার আমীনুত তালীম হজরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব গত ৫ নভেম্বর বাদ-এশা মিরপুর ১২ মোল্লা মসজিদে এই বয়ানটি পেশ করেন। তাবলিগ জামাতের সাথী ও ওলামায়ে কেরামের অনুরোধে পেশকৃত সেই বয়ানের দ্বিতীয় পর্ব এটি।]
সবচেয়ে মারাত্মক যে অপরাধটা মাওলানা সাদ সাহেব থেকে হয়ে গেছে, যেটার সংশোধন করা ছাড়া কোনোভাবেই তাকে আমরা অনুসরণীয় বলতে পারছি না শরিয়তের বিধান অনুযায়ী। আল্লাহ তায়ালা হেদায়েতের জন্য পাঠিয়েছেন নবী-রাসূলগণকে। মাওলানা সাদ সাহেবের দ্বারা সবচেয়ে সিরিয়াস ভুল হলো, নবীদের ব্যাপারে ভুল বয়ান। নবীদের জীবনী হলো আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ। তাদের জীবনী আলোচনা করব হেদায়েত নেওয়ার জন্য, অনুসরণ করার জন্য। ভুল ধরার জন্য নয়। মাওলানা সাদ সাহেব বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে একাধিক নবীর সিরাত নিয়ে আলোচনা করেছেন। যেখান তাদের ব্যাপারে আপত্তি তুলেছেন এবং ভুল ধরেছেন। এ ব্যাপারে আমি তিনজন নবীর কথা উল্লেখ করছি। হযরত মুসা আ., হযরত ইউসুফ আ. এবং হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহি আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
মুসা আ.-এর ব্যাপারে অনেকগুলো আপত্তিকর কথা বলেছেন সাদ সাহেব। তিনি বলেছেন, দাওয়াত ইবাদত থেকে বড়। মুসা আ. মাত্র ৪০ দিন দাওয়াতের কাজ ছেড়ে দিয়ে তুর পাহাড়ে ইবাদতে লেগে থাকার কারণে ৫ লাখ ৮৮ হাজার বনি ইসরাইল গোমরাহ হয়ে গেছে। এটা মুসা আ.-এর দোষ। তিনি দাওয়াত ছেড়ে তুর পাহাড়ে গেছেন। এই কথাটা কত বড় যে অন্যায় কথা এবং কত মারাত্মক আকিদাগত ভুল এটা সাধারণ মানুষ আন্দাজ করতে পারবে না।
আল্লাহ তাআলা মুসা আ.কে বলেছেন, তুর পাহাড়ে আসো। আল্লাহ হুকুম করেছেন তার নবীকে। ৩০ দিনের পর আরও ১০ দিন। ৪০ দিনের জন্য আল্লাহ তায়ালা ডেকেছেন। বলেছেন, তোমার উম্মতের মধ্য থেকে কিছু লোক বাছাই করে নিয়ে আসো। আল্লাহর হুকুমে মুসা আ. গিয়েছেন। তার ভাই হারুন আ. নবী। তাকে প্রতিনিধি বানিয়ে উম্মতের কাছে রেখে গেছেন। তিনি তাদের মাঝে দাওয়াতের কাছ করেছেন। মুসা আ. আল্লাহর হুকুমে তুর পাহাড়ে গিয়েছেন। প্রতিনিধি রেখে গেছেন নিজের ভাই ও নবীকে। এখন যদি আমি বলি, মুসা আ. দাওয়াতের কাজ ছেড়ে চলে গেছেন, তাহলে এটার দ্বারা আপত্তি শুধু মুসা আ.-এর ওপর হলো, না কি আল্লাহর বিধানের ওপর হলো?
অথচ দেখুন, বনি ইসরাইলের লোকেরা গোমরাহ হওয়ার কারণও আল্লাহ বলে দিয়েছেন কোরআনে- সামেরি তাদের গোমরাহ করেছে। আল্লাহ দোষারোপ করে বলছেন, বনি ইসরাইল গোমরাহ হয়েছে সামেরির কারণে। আর সাদ সাহেব দোষ চাপাচ্ছেন মুসা আ.-এর ওপর। এ ধরনের কথা বলা এটা কি কোনো ছোটখাটো ভুল? এ কথাটা তিনি এক-দুবার বলেননি। ঘরে বসে বলেন নি। বারবার বলেছেন, লাখ-লাখ মানুষের সামনে তিনি বলেছেন।
দারুল উলুম দেওবন্দ যখন প্রথমবার ফতোয়া দিয়েছে, তখন প্রথম রুজুতে সাদ সাহেব এ বিষয়ে তেমন কোনো বিস্তারিত কথা বলেননি। দ্বিতীয় বারের চিঠিতে তিনি লিখেছেন, মুসা আ.-এর ব্যাপারে এ কথা বলা এটা তো তেমন কোনো বড় ধরনের ভুলের কিছু না, এটা মারাত্মক কোনো ভুল না।
বয়ানের প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন : বিভক্তি যদি শেষ না-ও করতে পারি, কমপক্ষে ভদ্রতা, শালীনতা অবলম্বন করি
দারুল উলুম দেওবন্দ তাকে বুঝিয়েছে- এটা আপনার বাতিল ও কঠিন গোমরাহি পর্যায়ের ভুল এবং কোরআন বিরোধী ভুল। বারবার বুঝিয়েছে। তখন তিনি বললেন, ঠিক আছে আমি এ কথাটা ফিরিয়ে নিলাম। এ কথাটাও তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেননি। হালকা-পাতলাভাবে বলার মতো করে বলেছেন।
দ্বিতীয় বার যখন তিনি বললেন, আমি সবকিছু থেকে রুজু করে নিয়েছি, এটা হলো ১০ রবিউল আউয়াল ১৪৩৮ হিজরির কথা। এর দুদিন পর ১৩ রবিউল আউয়াল নিজামুদ্দিনে ফজরের পরের বয়ানে আবার তিনি মুসা আ.-এর ব্যাপারে এ কথাই বললেন। এর সঙ্গে হজরত ইউসুফ আ.-এর কথাও বললেন।
দারুল উলুম দেওবন্দ তাহকিক করে দেখল, তিনি নিশ্চিতভাবে এ কথাগুলো আবার বলেছেন। মাত্র দু-দিন আগে তিনি বললেন, রুজু করেছি। এখন আবার তিনি এ কথা বললেন। দারুল উলুম দেওবন্দ তার সম্পর্কে একটা লিখিত দিয়েছিল- মাওলানা সাদ সাহেব যে ভুল কথাগুলো বলেছেন, এখন থেকে আর বলবেন না।
এ ঘটনার পর দারুল উলুম দেওবন্দ তাদের লিখিত বার্তাটি ফেরত নিয়ে নিয়েছেন।
ইউসুফ আ.-এর ব্যাপারে বলেছেন, শয়তান তাকে আল্লাহর যিকির ভুলিয়ে দিয়েছে। ইউসুফ আ. গায়রুল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার কারণে অতিরিক্ত ৭ বছর বেশি তাঁকে জেলখনায় থাকতে হয়েছে।
দুদিন আগে রুজু। এর পরে আবার সেই ভুল কথাগুলো বলা। তাও আবার নতুন আরেকজন নবীকে নিয়ে। এখন এমন রুজুর ওপর এতমিনান (নিশ্চিন্ততা) কীভাবে হয়?
এর এক মাস পর সাদ সাহেব আবার রুজুনামা পাঠালেন। এর কিছুদিন পর তিনি বাংলাদেশের ইজতেমায় এসেছেন। তখন কাকরাইলে হায়াতুস সাহাবার মজলিসে বললেন, কেউ যদি নবীদের ব্যাপারে কোনো ভুল কথা বলে তার রুজু করা উচিত। আমি যদি বলে থাকি, আমার রুজু করা উচিত। ভুলটা কী বলেছেন এবং এটার সহিহ রূপটা কী- সেটার ঘোষণা দেওয়া এবং এ বিষয়ে পরিস্কার করে বলা- এগুলো কিছুই বললেন না। এ ধরনের গোলমাল রুজুর কথা বলা আর কি! এভাবে নিজামুদ্দিনেও বলেছেন, কাকরাইলেও বলেছেন। তাও যাক বলেছেন।
বলার পর আওরঙ্গবাদের ইজতেমায় তিনি রাসুলে কারীম সা.-এর সিরাতের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে আপত্তিমূলক কথা বলে বসলেন। ছোট্ট একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি আপত্তিমূলক কথা লাগিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, ওলিমা শুধু খেজুর দিয়ে হয়। গোশত-রুটি দিয়ে করলে সেটা সুন্নতবিরোধী।
অথচ সহিহ হাদিস শরিফে স্পষ্ট আছে, এক সাহাবিকে রাসুল বলছেন, ‘একটা ছাগল দিয়ে হলেও কমপক্ষে ওলিমা করো।’ কিন্তু তার দাবি হলো, ওলিমা খেজুর দিয়ে সুন্নত। গোশত-রুটি দিয়ে করা সুন্নাহবিরোধী। তিনি বললেন, রাসুলে কারীম সা. সবসময় খেজুর দিয়ে ওলীমা করেছেন। শুধু এক বিয়েতে সুন্নতের পরিপন্থী গোশত-রুটি দিয়ে ওলিমা করেছেন। ওই বিয়েতে সুন্নতের খেলাফ করার কারণে আল্লাহর পক্ষ থেকে তার ওপর কষ্ট এসেছে।
এটা তার হাদিসবিরোধী কথা। তাছাড়া এটা কি রাসুলের সিরাত বয়ান করার তরিকা? রাসুলে কারীম সা.-এর ওপর যে একটা আপত্তি তোলা হলো, এটা কি রাসুলের প্রতি একরাম-সম্মান করা হলো? এটা হলো তার নিজামুদ্দিনে ও কাকরাইলে রুজুর পরের ঘটনা। এখন যদি তার রুজুর ব্যাপারে দারুল উলুম দেওবন্দ মুতমায়িন (প্রশান্ত) না হয় তাহলে এটা কি দোষ?
মুসা আ.-এর ব্যাপারে তিনি যে কঠিন কথাটা বললেন এটা তাকে বারবার বোঝাতে হবে কেন? এটা যে কঠিন গোমরাহিমূলক কথা এটা বুঝতে কোনো কষ্ট হয়?
অনেকবার বুঝানোর পরও তিনি যে বুঝে নিয়েছেন এবং মেনে নিয়েছেন, তাও তো না। এটার দলিল হলো, রুজুর পরও তিনি ওই বিষয়টা নিয়ে বলেছেন। একটার পর আরেকটা বিষয়ে বলছেন। এক নবীর পর আরেক নবীর ব্যাপারে বলছেন। এটা তো আকিদার এমন এক বিষয়, আল্লাহর কাছে নবী-রাসুলদের কী মর্যাদা, দীন-ঈমানের ক্ষেত্রে এটা যে ব্যক্তি ভালো উপলব্ধি করতে পারে, সে-ই বুঝতে পারে; এটা কত বড় অন্যায় কথা। কত বড় ভ্রান্তি ও গোমরাহি কথা।
আফসোস হলো, কেউ কেউ বলে থাকে, সাদ সাহেব যে এসব কথা বলেছেন সেটা কি আপনারা শুনেছেন? আজিব কথা! কেউ বলে, তিনি তো রুজু করে ফেলেছেন। আচ্ছা ভাই, মানুষ রুজু করে কোন জিনিস থেকে? কোনো কথা বলার পরই তো রুজু করে। তার মানে তিনি এসব কথা বলেছেন। তারপরও আলেমদের কাছে দলিল চাও কেন? রুজু করা মানেই তো বলা এবং বলার পর রুজু করা।
আর কিছু কট্টর ভাই বলে থাকে, তার ভুলগুলো কি আসলেই ভুল? মুসা আ.-এর ব্যাপারে এত মারাত্মক কথা তিনি বললেন, এটাও নাকি ভুল না? যারা এ ধরনের কথা বলে, তাদের কাছে ঈমান বড়; না ব্যক্তি বড়? এখন যদি ওলামায়ে কেরাম এ বিষয়গুলো পরিষ্কার করে বলে দেন, তাহলে এটা কারও বিরুদ্ধে শত্রুতাবশত বলা হলো, না কি দ্বীনি দায়িত্বের কারণে বলা হলো? কেন বুঝার চেষ্টা করছি না আমরা?
আর কিছু কট্টর ভাই বলে থাকে, তার ভুলগুলো কি আসলেই ভুল? মুসা আ.-এর ব্যাপারে এত মারাত্মক কথা তিনি বললেন, এটাও নাকি ভুল না? যারা এ ধরনের কথা বলে, তাদের কাছে ঈমান বড়; না ব্যক্তি বড়? এখন যদি ওলামায়ে কেরাম এ বিষয়গুলো পরিষ্কার করে বলে দেন, তাহলে এটা কারও বিরুদ্ধে শত্রুতাবশত বলা হলো, না কি দ্বীনি দায়িত্বের কারণে বলা হলো? কেন বুঝার চেষ্টা করছি না আমরা?
এক তো আমল করতে গিয়ে ভুল করা। আরেকটা হলো বিধান বর্ণনায় হেরফের করা। উলটপালট করা। বেদআত আবিষ্কার করা। বেদআত আবিষ্কার করা এমন পর্যায়ের অপরাধ, এটার ব্যাপারে চুপ থাকা যায় না। এটাকে ছোটখাটো ভুল বলে না। এটা মৌলিক ভুল। সাদ সাহেবের এ ধরনের ভুলগুলোর মধ্যে হলো, নতুন নতুন নীতি-উসুল আবিষ্কার করা।
নতুন মাসআলা বানানো হচ্ছে। নতুন উসুল বানানো হচ্ছে। এগুলো যে কীভাবে হচ্ছে, এটা বিজ্ঞ আলেম ছাড়া সাধারণদের বুঝে আসে না। এ জন্যই তাদের বুঝে আসে না- হুজুররা সাদ সাহেবের বিরুদ্ধে এত নারাজ কেন? এটা সূক্ষ্ম বিষয়। একটা হলো কাজের তারতিব-পদ্ধতি আরেকটা কাজের উসুল-নীতি। তারতিব পরিবর্তন করা যায় মাশওয়ারার মাধ্যমে। যেমন যোহরের নামাজ সোয়া একটায় হবে না কি দেড়টায় হবে? সময় তো আছেই। এটা মাশওয়ারার মাধ্যমে ঠিক করা যায়। এটার নাম তারতিব। তারতিবও খামাখা পরিবর্তন করা যায় না। দরকার হলে পরামর্শ করে পরিবর্তন করতে হয়। এটা নিজের ইচ্ছায় কেউ করে না। প্রয়োজন হলে পরামর্শ করেই পরিবর্তন করতে হয়। তারতিব পরিবর্তনশীল। তবে তরিকা মতো।
মনে রাখতে হবে, উসুল পরিবর্তন করা যায় না। কিন্তু মাওলানা সাদ সাহেব অনেকগুলো উসুলের মধ্যে হাত দিয়েছেন। এ জন্যে আলেমরা তার প্রতি অসন্তুষ্ট। উসুলে হাত দেওয়ার কারণে এতায়াতি ভাইদের তাকে এতায়াত করার কোনো সুযোগ নেই। তারা মনে করছেন, তিনি কিছু তারতিব পরিবর্তন করেছেন, শরিয়তের উসুলে কোনো পরিবর্তন করেননি। বস্তুত, যদি সাদ সাহেব শুধু তারতিব পরিবর্তন করতেন তাহলে এটার জন্য এত কিছু হতো না।
হজরত মাওলানা যোবায়ের সাহেব, হজরত মাওলানা রবিউল হক সাহেব হলেন মাওলানা সাদ সাহেবের পূর্বপুরুষদের তৈরি করা লোক। সাদ সাহেবের অনেক আগ থেকে তারা তাবলিগ করছেন। বড় বড় হুজুররা তাদের তৈরি করেছেন। এখন যদি ওইসব পূর্ববর্তী লোকদের তত্ত্বাবধানে তাবলিগের কাজটা চলে কোনো সমস্যা আছে? কাজ দরকার, না নাম দরকার? কাজ যদি দরকার হয় তাহলে আগের তারতিবে কাজ করেন। মাওলান সাদ সাহেব নতুন যে তারতিব শুরু করেছেন, তিনি মনে করছেন এটা খুব ভালো, কিন্তু সত্য হলো, উসুলে হাত দিয়েছেন আর তারতিব ভেঙেছেন, কোনোটাই তিনি মাশওয়ারা করে করেননি। এ জন্যই নিজামুদ্দিন দুই ভাগ হয়ে আছে। এখন যারা বলেন, নিজামুদ্দিনের এতায়াত করেন, তারা কোন নিজামুদ্দিনের এতায়াত করেন? নিজামুদ্দিন তো দুই ভাগ হয়ে আছে। তো তারা বলে, আমরা তো চার দেয়ালের ভেতরকার নিজামুদ্দিনের এতায়াত করি। এতায়াত করা কি এত সোজা!
এতায়াত একটা আদর্শের নাম। নিজামুদ্দিন একটা আদর্শের নাম। আজকে যদি মাওলানা সাদ সাহেব বাইরে থাকতেন, অন্য হুজুররা নিজামুদ্দিনে থাকতেন তাহলে কী করতেন! এটা কি অসম্ভব কিছু ছিল! তখন ওইসব ভাই নিজামুদ্দিনের নাম নিতেন, না কি সাদ সাহেবের নাম নিতেন? তখন তারা নিজামুদ্দিনের নাম নিতেন, না সাদ সাহেবের নাম নিতেন- দিলে হাত রেখে বলুক তারা।
শরিয়ত ব্যক্তি ও বিশেষ জায়গাকে হকের মাপকাঠি বানায়নি। হকের মাপকাঠি বানিয়েছেন দলিলকে। কোরআন-সুন্নাহ ও সাহাবায়ে কেরামকে বানিয়েছে হকের মাপকাঠি। ব্যক্তি হকের মাপকাঠি নয়, বিশেষ জায়গাও নয়। বাইতুল্লাহ শরিফ দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ফযিলত, বরকত ও মর্যাদার জায়গা। রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তাআলা হেদায়েত নিয়ে পাঠানোর সময় মুশরিকরা কী অবস্থা করে রেখেছিল বাইতুল্লার। তখন বাইতুল্লাহ থেকে তাওহিদের আযান আসত, না কি শিরকের আওয়াজ আসত? বাইতুল্লাহর ফযিলত, বরকত ও মর্যাদার কথা তো কোরআন ও হাদিসে আছে। নিজামুদ্দিনের কোনো ফযিলতের কথা কোরআন-হাদিসে আছে না কি?
নিজামুদ্দিনে হেদায়েতের কাজ হয়েছে। বছরের পর বছর। সেটা ভিন্ন কথা। বাইতুল্লাহর ফযিলত কোরআন-হাদিসে আছে। নিজামুদ্দিনের কথা নেই। তো সেই বাইতুল্লাহর মধ্যে মুশরিকরা বছরের পর বছর শিরকের কাজ করেছে। তখন যদি কেউ বলত, বাইতুল্লাহর কথা তোমাকে মানতে হবে। তখন কি বাইতুল্লাহর কথা মানা ঠিক হতো? কোনোভাবেই না। যেই বাইতুল্লাহর ফযিলত প্রমাণিত, কোরআন-সুন্নাহর বিধান দ্বারা, তো সেই বাইতুল্লাহর মধ্যে যদি কোরআন-সুন্নাহর ভিন্ন কিছু এসে যায়, তখন কোরআন-সুন্নাহর বিধানকেই প্রাধান্য দিতে হয়, জায়গাকে নয়। তো যে জায়গার ফযিলতের কোনো কথা নেই, সে জায়গার এতায়াত কীভাবে করা যায়?
এটাই হলো পার্থক্য। আমি পরিষ্কার বলি, আলেমদের আমলের ত্রুটির কোনো শেষ নেই। কিন্তু এই বুঝ আল্লাহ তাআলা আলেমদের দিয়েছেন। আজকে দেশে অনেক বড় বড় মাদরাসা। ধরেন ঢাকার লালবাগ মাদরাসা। অনেক প্রাচীন মাদরাসা। তো সেই মাদরাসা এ রকম কোনো আকিদা বা শরিয়তের কোনো বিধানে হাত দিক, দেখবেন, সব হুজুররা তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। কিন্তু কেউ যদি বলে, আরে, আমি তো লালবাগ মাদরাসায় পড়াশোনা করেছি। আমার বাবা পড়েছেন, আমার দাদা পড়েছেন লালবাগে। এখন আমি লালবাগের বিরুদ্ধে কীভাবে বলব? এটা হুজুররা করে না। এই কাজ আলেমদের দ্বারা হয় না। সাধারণ মানুষদের মধ্যে এই দুর্বলতা আছে। হ্যাঁ, এতদিন ওখান থেকে হেদায়েতের কথা শুনছি, এতদিন তাদের খান্দান থেকে হেদায়েতের কথা শুনছি, এখন তাকে কীভাবে ছাড়ি!
আলেমরা আল্লাহর রহমতে এ বিষয়ে মজবুত। আগেই বলেছি উসতাদের বিষয়ে, পীরের বিষয়ে, আমাদের খতিব সাহেবের পীর আছে না? পীর সাহেব উল্টাপাল্টা বলুক না! আপনারা এই মসজিদেই তখন পীরের বিরুদ্ধে বয়ান শুনবেন। হুজুরদের এক-দুজন ভ্রান্তির শিকার হয়ে যায়, তখন বাকি সব হুজুরকে আল্লাহ তাআলা দাঁড় করিয়ে দেন। তারা বলেন না, এটা তো আমাদের হুজুর, আমাদের প্রতিষ্ঠান, এর বিরুদ্ধে কীভাবে বলব? আকিদার হেফাজতের সময় এগুলো তারা বিবেচনায় আনেন না।
আমাদের প্রতিষ্ঠান ততক্ষণ, যতক্ষণ সেটা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের কথা বলছে। যতক্ষণ হক কথা বলেছে। যখন গোমরাহির কথা আসা শুরু হয়েছে, কেউ বলবেন সব কি আর গোমরাহ কথা হয়! আমরা বলি না, সব কথা গোমরাহির। কিন্তু যে কয়টা গোমরাহির কথা হয়েছে এগুলো কোনো ছোটখাটো কথা নয়। মারাত্মক বিষয়। এগুলোর বিষয়ে চুপ থাকা যায় না।
জায়গাকে মানদণ্ড বানানো হচ্ছে হকের। এটা একটা নতুন মাসয়ালা। এক ব্যক্তিকে হকের মানদণ্ড বানানো হচ্ছে। নতুন মাসয়ালা। এ রকম নতুন নতুন মাসয়ালা আবিষ্কার করা হচ্ছে এখন। বিধানেও হাত দেওয়া হচ্ছে।
তিন জন ফয়সাল চলছে তাবলিগ জামাতে ১৯৯৫ সাল থেকে। হজরতজি এনামুল হাসান রহ.-এর ইনতেকালের পর মজলিসে শুরা চলছে। আর কোনো একজনকে আমির বানানোর সুযোগ হয়নি। তারা তিনজনকে দায়িত্ব দিয়েছেন। পালাক্রমে ফয়সালা করে তারা দায়িত্ব পালন করবেন। কিছুদিন পর আরও দুজনকে যুক্ত করে পাঁচ জন করা হয়েছে। হজরত মাওলানা উমর পালনপুরী রহ. ও মিয়াজি মেহরাব হোসেন সাহেবকে পরে যুক্ত করা হয়েছে। আগে ছিলেন মাওলানা ইজহারুল হাসান সাহেব রহ., মাওলানা যোবায়েরুল হাসান সাহেব রহ. ও হজরত মাওলানা সাদ সাহেব।
একজন একজন করে ইনতেকাল করার পর শেষে বাকি থাকলেন দুজন। হজরত মাওলানা যোবায়েরুল হাসান সাহেব ও হজরত মাওলানা সাদ সাহেব। ২০১৪ সালে মাওলানা যোবায়েরুল হাসান সাহেব ইনতেকাল করেন। এখন সেই পাঁচ জনের মধ্যে কেবল মাওলানা সাদ সাহেব আছেন। নতুন মাসয়ালা বানানো হয়েছে, ফয়সালের সদস্যরা মারা যাওয়ার পর যিনি বাকি থাকেন, তিনি আমির হয়ে যান। এটা নতুন মাসয়ালা। কোনো ফতোয়ার কিতাবে এ ধরনের কথা নেই।
একটা হলো, আমি আমির দাবি করলাম। আরেকটা হলো, মাসয়ালা বললাম- এভাবে হলে আমির হয়ে যায়। শরিয়তের বিধান নাকি এটা? একটা ব্যাপার হলো, আমি বললাম, আমি আমির। এটা জবরদস্তি দাবি। এটা একটা দোষ। আরেকটা হলো এ কথা বলা- মাসআলাই এটা। তিন জন ফয়সালের দুজন ইনতেকাল করলে জীবিত ব্যক্তি অটো আমির হয়ে যায়। এটাকে বিধান হিসেবে বলা, এটা একটা নতুন মাসয়ালা আবিষ্কার করলেন তিনি। এটা বিদআত। যদি শুধু আমির হওয়ার দাবি করতেন, তাহলে এটা ছিল এক অপরাধ। এখন বলছেন, বিধানই এটা। তিনিও বলছেন, তার ভক্তরাও বলছেন।
ওয়াসিফুল ইসলাম সাহেব নিজামুদ্দিন থেকে লেখা এনে আমার কাছে পাঠিয়েছেন। ওই লেখাতে এই মাসয়ালার কতা বলা আছে। আমার কাছে ওই কাগজ এখনো আছে। এ রকম এক-দুই মাসয়ালা না, একটা অসত্যকে ঢাকার জন্য ১০টা দলিলের মধ্যে বিকৃতি করা হচ্ছে। ১০টা নতুন মাসয়ালা বানানো হচ্ছে। ১০টা মিথ্যা দ্বীনের নামে লাগানো হচ্ছে। একটা হলো ব্যক্তির ওপর অপবাদ, আরেকটা হলো শরিয়তের ওপর মিথ্যা কথা আরোপ করা।
আমাদের অন্তরে কী জ্বালা, সেটার দশ ভাগের এক ভাগ যদি আপনারা অনুভব করতেন বেহুশ হয়ে যেতেন। শরিয়তের বিধানে হাত দেওয়া হচ্ছে একের পর এক। কোন কোন বিধানে হাত দেওয়া হয়েছে, এটার তালিকা লম্বা। আমি দুয়েকটির কথা বললাম। একটা হচ্ছে গোড়া থেকে যেগুলো হচ্ছে, সেগুলোর তালিকাই লম্বা, আর প্রতি দেশে, যারা তার তরফদারি-পক্ষপাতিত্ব করছেন, বিশেষ করে বাংলদেশে যারা তার পক্ষপাতিত্ব করছেন, তারা নতুন নতুন কত কিছু যে আবিষ্কার করছেন! সেটার কোনো হিসাব নেই। কীভাবে যে বিকৃতির পর বিকৃতি করে যাচ্ছে!
ব্যস ভাই, অনেক হয়েছে। আমি মনে করি, যদি বোঝার ইচ্ছা থাকে, তাহলে এতটুকু কথাই যথেষ্ট। আমি শেষ কথা বলছি। মাওলানা সাদ সাহেব শরিয়তের উসুলে হাত দিয়েছেন। কিছু ভাই বলেন, তিনি তারতিবে হাত দিয়েছেন। যদি তিনি শুধু তারতিবে হাত দিতেন, তাহলে নতুন তারতিবের জন্য এত মাথা ঘামানো কেন?
হজরত ইলিয়াস রহ. থেকে নিয়ে ৮০ বছর পর্যন্ত যেই তারতিবে তাবলিগ চলল, শেষ ১০ বছর বাদ দিলে, ৭০ বছর পর্যন্ত যেই তারতিবে তাবলিগ চলছে, সেই তারতিবের সঙ্গে আপনাদের এত দুশমনি কেন? ওই তারতিবের ওপর কাজ করেন। ওলামায়ে কেরাম বলছেন, সমস্যাটা দিল্লির নিজামুদ্দিনে দেখা দিয়েছে। ওখানে এটার হল হোক। হজরত মাওলানা সাদ সাহেব নিজের এসলাহ করার পর তার ওপর আস্থা অর্জন হোক। তিনি তার ভুলগুলোর গোলমাল রুজু করেন। একটা থেকে রুজু করলে আরেকটা বলেন। এ কারণে তার ওপর যে আস্থা থাকছে না, এই আস্থাটা ফেরত আসুক।
২০১৮ ফেব্রুয়ারিতে ছিল আওরঙ্গবাদের ইজতেমা। এক-দেড় মাস পরে ওটার এক বছর হয়ে যাবে। লন্ডনে ইজতেমা হলো এক মাসও হয়নি। মাত্র ২ সপ্তাহ হলো। ওই বয়ানও আমি শুনেছি। ওই বয়ান শুনলে আপনারা বলবেন, ওয়াহ, ওয়াহ। আর আমি বসে বসে কেঁদেছি। কারণ সূক্ষ্ম বিষয়।
ওখানে তিনি বলেছেন, দেখো, একটা হলো কাজ আরেকটা হলো ইন্তেজাম-ব্যবস্থাপনা। ব্যবস্থাপনাগত বিষয়ে সবার সঙ্গে মাশওয়ারা করা হয়। কিন্তু দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ তো সিরাতের অধীন। এবং কাজ করনেওয়ালা কাজের অধীন।’ বলবেন, কত সুন্দর কথা তিনি বলছেন! ব্যবস্থাপনাগত বিষয়ে মাশওয়ারা হয়। দাওয়াতের কাজে কীসের মশওয়ারা! ওটা তো এক-দুজন কথা বলে ফায়সালা করে দেবে বাকিরা সবাই মানতে হবে। সাধারণ মানুষ এটা ধরতেই পারবে না- এই কথাটা কত বড় ভুল এবং এটার মধ্যে কতগুলো ভুল! কখনো ধরতে পারবে না তারা। কথাটা শুনতে সুন্দর শোনা যায়। কিন্তু এ কথাটা আগাগোড়া ভুল। এবং এই ভুলটা হলো এমন একটা নতুন কায়দা, নতুন নিয়ম, যেটা তিনি আবিষ্কার করেছেন, যেই নতুন নিয়মটা ধরে দ্বীনের মধ্যে তিনি যা ইচ্ছা তা আবিষ্কার করতে থাকবেন।
এটা হলো দ্বীনের উসুলি বিষয়। দ্বীনের উসুলকে তিনি পরিবর্তন করে দিয়েছেন। আরেক বার বলেছেন, ‘তোমরা মাশওয়ারা করতে বলো। মাশওয়ারা তো ব্যবস্থাপনাগত বিষয়ে হয়। আর দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ তো মানসুস। শরিয়তের নস-দলিলের মধ্যে সব আছে। ওটাতে কীসের মাশওয়ারা!’
হজরত মাওলানা ইলিয়াস রহ. বলেছেন, তাবলিগের কাজ বিষয়ে তার প্রতি ইলহাম হয়েছে। তিনি মাশওয়ারা করেছেন। আর সাদ সাহেব বলছেন, তাবলিগের কাজ সব মানসুস। শরিয়তেই সব আছে। একটা হলো দাওয়াত আরেকটা দাওয়াতের পদ্ধতি। দুটার মধ্যে পার্থক্য আছে। পদ্ধতি কত রকম হতে পারে! মোবাহ ও বৈধ পদ্ধতি অনেক রকম হতে পারে। বিশেষ পদ্ধতিতে দাওয়াত ও তাবলিগের যে কাজ, এটা নিয়ে মাওলানা ইলিয়াস রহ. দশ জনের সঙ্গে মাশওয়ারা করেছেন। বারবার যাচাই করেছেন- কোরআন-সুন্নাহর বিপরীত কিছু নেই তো এটার মধ্যে? তারপর এ কাজ অগ্রসর হতে থেকেছে আস্তে আস্তে। আর সাদ সাহেব বলছেন, কাজ সব মানসুস। সিরাতের মধ্যে সব আছে। সিরাতের মধ্যে আছে এর কী দৃষ্টান্ত? যেসব জায়গায় তিনি পরিবর্তন করেছেন সেসব জায়গায় তিনি সিরাতের হাওয়ালা দেন। এবং প্রত্যেকটার মধ্যে সিরাতের ভুল হাওয়ালা দেন।
তবকাতের জোড় বন্ধ করেছেন সিরাতের হাওয়ালা দিয়ে। তবকাতের জোড় বন্ধ হওয়া নাকি সিরাতের দাবি! অথচ সিরাত তবকার জোড়ের পক্ষে, বিপক্ষে নয়। তিনি যেটার উদ্ধৃতি দিয়েছেন সেটা গলত। কবে পড়ে রেখেছেন কে জানে। দুই ঘটনা থেকে এক ঘটনার একটু আরেক ঘটনার আরেকটু নিয়ে জোড়াতালি দিয়ে বলেছেন তবকার জোড় বন্ধ।
এ রকম যেখানেই তিনি পরিবর্তন এনেছেন, তারতিব হিসেবে বলেন না। তিনি সেটাকে বলেন, নস। স্পষ্ট শরিয়ত। বলেন, সিরাতের মধ্যে আছে, দলিলের মধ্যে এ কথা স্পষ্ট আছে।’ আরে, বলছেন তো আপনি, আপনার বুঝ। আর আপনি বলছেন, শরিয়তের মধ্যে এটার দলিল স্পষ্ট আছে। এটা শরিয়তের বিধানে হাত দেওয়া এবং এটা নীতি তৈরি করা।
শরিয়তের নীতি তৈরি বা নির্ধারণ করা যায় না। শরিয়ত নিজেই নীতি নির্ধারণ করে দেয়। শরিয়ত কাকে বলে? তিনি বলছেন, ব্যবস্থাপনাগত বিষয়ে মাশওয়ারা হবে, দাওয়াত ও তাবলিগের কাজের মধ্যে কোনো মাশওয়ারা নেই। এসব কথা বলে তিনি শরিয়তের নির্ধারিত-নীতির মধ্যে পরিবর্তন সাধন করছেন। এ বিষয়টা নিয়ে এখন বিস্তারিত বলার সময় নেই।ঘণ্টাখানেক আলোচনা করলে এ বিষয়টাও আপনাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। শুনতে এ কথাটা কত সুন্দর। সাধারণ মানুষ এ কথা শুনে বলবে, ওয়াহ, ওয়াহ। আর আমি শুনে কাঁদতে থেকেছি। কীভাবে শরিয়তের গোড়ায় তিনি হাত দিচ্ছেন!
এসব হালাত থেকে বুঝা যায় তিনি শুরা মানবেন না। কারণ, শুরা তো তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে। কারণ, শুরার মধ্যে সবাই বড় বড় আলেম। সেখানে তার উসতাদরা রয়েছেন। যারা তার পিতারও উসতাদ। এ জন্য তিনি শুরা মানতে চান না। কারণ শুরা তার ভুল কথা মানবে না। আর তিনি তাদের কথা মানতে রাজি না। তিনি হলেন এমন লোক, যেটা বুঝে আসবে সেটা বলবেন।
এসব হালাত থেকে বুঝা যায় তিনি শুরা মানবেন না। কারণ, শুরা তো তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে। কারণ, শুরার মধ্যে সবাই বড় বড় আলেম। সেখানে তার উসতাদরা রয়েছেন। যারা তার পিতারও উসতাদ। এ জন্য তিনি শুরা মানতে চান না। কারণ শুরা তার ভুল কথা মানবে না। আর তিনি তাদের কথা মানতে রাজি না। তিনি হলেন এমন লোক, যেটা বুঝে আসবে সেটা বলবেন।
প্রিয় ভাইয়েরা! সাদ সাহেবের সঙ্গে ওলামায়ে কেরামের কোনো শত্রুতা নেই। যেসব বড় বড় আলেম ও আকাবির নিজামুদ্দিন থেকে চলে গেছেন তাদের সঙ্গে ওলামায়ে কেরামের বিশেষ কোনো দোস্তি নেই। তারা আমাদের চেনেনও না। মাওলানা সাদ সাহেবের সঙ্গে তো আমি দেখা করেছি নিজামুদ্দিনে। যখন তিনি শুনেছেন আমি শায়েখ আবদুল ফাত্তাহর শাগরিদ, সাথে সাথে তিনি বলেছেন, ‘ওহ! শায়েখ আবদুল ফাত্তাহর শাগরিদ! সুসংবাদ তার জন্য, যে তাকে দেখেছে, তিনি যাকে দেখেছেন।’ এত খুশি হয়েছেন তিনি আবদুল ফাত্তাহর শাগরিদ শুনে।
যা হোক! আমি শেষ কথা যেটা বলেছি, সেটা হলো, সাদ সাহেবের সঙ্গে আলেমদের কোনো শত্রুতা নেই। শুধু দ্বীনি দায়িত্বের কারণে তারা কথা বলছেন। আমরা বোঝার চেষ্টা করি। যতক্ষণ বুঝে না আসে ততক্ষণ কমপক্ষে এতটুকু করি, জবান হেফাযত করি। জবান তো সবসময়ই নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এখনো করি। তাহলে গুনাহ কম হবে। অপরাধ কম হবে। দুই অপরাধের পর এই তৃতীয় অপরাধ, যেটার শত শত শাখা। এই এক বিভক্তির অপরাধকে যদি আমরা লাগামহীন বানাই, তাহলে দিনরাত গুনাহ হতে থাকবে। এখন তো তাই হচ্ছে।
কেরানীগঞ্জে একটা ইজতেমা হলো না? আমি আপনাদের জিজ্ঞেস করি, যদি কাকরাইলের শুরার মধ্যে কোনো বিভক্তি না হতো, সবাই মিলে ফায়সালা করা হয়েছে, এ বছর বিশ্বইজতেমার আগে কোনো ইজতেমা হবে না। যদি তারা এটা মানতেন, তাহলে সবাই এটা মানত। তো এটা মানতে তাদের কী সমস্যা ছিল? এখন কোন নেকনিয়তে এগুলা করা হচ্ছে? তো ওই ইজতেমা থেকে ৩০ জনের একটা জামাত গেছে আগারগাঁও-এর দিকে এক মসজিদে। জামাতের অধিকাংশ সাথী ওই এলাকার। ওখানে গিয়ে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেম, কমিটির লোকজনকে পর্যন্ত মেরেছে। গায়ে হাত তুলেছে। আজিব! ইজতেমা করে এসে মারামারি। তাদেরকে জিজ্ঞেস করেছে শুধু, কাকরাইলের পরচা-কাগজ আছে কি না? এই জিজ্ঞাসা করাটা কি এমন দোষ, যেটার জন্য কাউকে মারা যায়?
মুশফিক সাহেবের জামাত এলে জিজ্ঞাসা করা হতো না, কাকরাইলের পরচা আছে কি না? কেন জিজ্ঞেস করতেন? ওরাও তো দ্বীনের কথা নিয়ে এসেছিল। ওরা তো মসজিদে এসে গুনাহর কথা বলত না। ওদের কাছে কেন কাকরাইলের পরচা চাওয়া হতো? কাকরাইলের পরচা না থাকলে কেন বের করে দেওয়া হতো। মুশফিক সাহেবের লোকদের তো আকিদার কোনো ভুল ছিল না। তারা কোনো বিধানের ওপর হাত দেয়নি। ওরা শুধু শৃঙ্খলার মধ্যে সমস্যা করছিল। তারপরও ওলামায়ে কেরাম তাদের বারণ করেছেন। আমার কাছেও এসেছিলেন মুশফিক সাহেব। কত বড় মুরুব্বি মানুষ! তাবলিগের কাজে কত বড় অবদান তার! আমিও বলে দিয়েছি, না। আপনি এ পদ্ধতিতে যাবেন না। তাকেও আমরা সঙ্গ দিইনি। কেন? অথচ তার আকিদার কোনো সমস্যা ছিল না। শুধু শৃঙ্খলায় সমস্যা ছিল।
এখন আপনারা এতায়াতি। এতায়াতি নামে কোনো কিছু ছিল? এই নাম তখন দিয়েছেন, যখন এতায়াতের মানদণ্ড ক্ষুণ্ন হয়ে গেছে। শরিয়ত বলেছে, এতায়াত হয় বৈধ কাজে। জায়েজ কাজের মধ্যে। নাজায়েজ কাজের মধ্যে এতায়াত বৈধ নয়। যেখানে সাদ সাহেবের এতায়াত করা জায়েজ নেই, সেখানে এতায়াতের নাম আপনার আবিষ্কার করেছেন। তো নাম বের করে ভালোই করেছেন। ভিন্ন নামে ভিন্ন জামাত- এতায়াত। কীভাবে নিজেদের ঐতিহ্যবাহী নামকে বাদ দিয়ে রাখলেন এতায়াতি জামাত! যাদের এতায়াত সহিহ ছিল, তাদের এতায়াত করা হয়েছে। কিন্তু এতায়াত শব্দ তখন বলা হয়নি। যেখানে এতায়াতের মানদণ্ড শেষ হয়ে গেছে, এখন সেখানে এসে বলা হচ্ছে এতায়াত।
আল্লাহর ওয়াস্তে হক মানার মতো ঈমানি শক্তি না থাকলে কমপক্ষে নিজের জবানকে হেফাজত করি। উভয় দিক থেকে করি। যারা হকের ওপর আছেন তারাও। হকের ওপর থাকা মানে এই নয়, যা ইচ্ছা তা বলা। জিদাজিদি করা গুনাহ।
হজরত থানভি রহ. একটা ঘটনা লিখেছেন। আমাদের এক আকাবির। যুদ্ধের ময়দানে অনেক কষ্ট করে শত্রুকে কাবু করেছেন। এখন তাকে শাস্তি দেবেন। ওইসময় সে মুখে থুথু মেরেছে। তার রাগ উঠে গেছে। চিন্তাভাবনা করে তাকে ছেড়ে দিয়েছেন। ওই লোক বলল, আমাকে এত কষ্ট করে কাবু করে এখন ছেড়ে দিলেন? তিনি বললেন, তোমাকে শাস্তি দিব তো আল্লাহর জন্য। কিন্তু তুমি থুথু মারার পর তোমার উপর আমার রাগ উঠেছে। এখন তোমাকে মারলে আমার নফসের জন্য মারা হবে। আল্লাহর জন্য হবে না। তাই ছেড়ে দিয়েছি।
ওই লোক বলল, তোমাদের দ্বীন এত সুন্দর! এত সুন্দর শিক্ষা দেয় তোমাদের দ্বীন! এরপর ওই লোক ইসলাম গ্রহণ করেছে। তাই হকের ওপর থাকলেও জিদ করা যাবে না। জবানের নিয়ন্ত্রণ হারালে আপনারও গুনাহ হবে। হকের ওপরে থাকার সওয়াব পাবেন। কিন্তু জিদাজিদি করে জবানের নিয়ন্ত্রণ হারালে এটার জন্য গুনাহ হবে। এটা আমরা সবাই খেয়াল রাখি। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন।
অনুলিখন : সাদ আবদুল্লাহ মামুন
