এই তো কওমি মাদরাসার রোদমাখা মুখ

সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর ।।  

দুই দিনের সংক্ষিপ্ত সফরে কুষ্টিয়া-মেহেরপুর যাওয়া হয়েছিল দিন কয়েক আগে। মাকতাবাতুল আযহার, মাকতাবাতুল ইসলাম, নবপ্রকাশসহ আরও কিছু সমমনা প্রকাশনীর উদ্যোগে আঞ্চলিক কিতাবমেলার আয়োজন ছিল কুষ্টিয়ায়। লেখালেখি এবং প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত থাকি বলে এর আগে এমন একাধিক মেলায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। বিচিত্র এবং অভাবিত নানা অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছি। এবারকার কুষ্টিয়া মেলার অভাবনীয় কিছু অভিজ্ঞতার কথা বয়ান করি।

১০ নভেম্বর মেলায় হাজিরা দিবো বলে আগে থেকেই আমরা কয়েকজন তৈয়ার হয়ে ছিলাম। খুলনার ট্রেন সুন্দরবন এক্সপ্রেসে চড়ে পোড়াদহ গিয়ে নামবো, সেখান থেকে দুলকি চালে হাজির হবো কুষ্টিয়া শহরের মোমতাজুল উলুম মাদরাসার প্রাঙ্গনে। কিতাবমেলার আয়োজন হচ্ছে ওখানে।

কিন্তু ভাগ্যের ফেড়ে ট্রেনের টিকেট পাওয়া হলো না। অগত্যা ৯ নভেম্বর শুক্রবার ঢাকার কল্যাণপুর থেকে রাত্রিকালীন কোচে উঠে বসলাম আমরা চারবন্ধু-মনযূরুল হক, এহসান সিরাজ, আসাদ খান এবং আমি নাচিজ। কুষ্টিয়া পৌঁছতে পৌঁছতে পরদিন সকাল সাড়ে ছয়টা।

শহরের মজমপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে অটো করে পৌঁছলাম মোমতাজুল উলুম মাদরাসায়। মাদরাসায় গিয়ে কিতাবমেলার স্টল নজরে এলো কিন্তু মেলার লোকজন কাউকে পেলাম না। মানে প্রকাশনীর লোকজন কারো টিকি খুঁজে পেলাম না। কী মুসিবত! এই দূর প্রবাসে ভাই-বান্ধব ছাড়া কার কাছে কিছু পুছি!

মোমতাজুল উলুম মাদরাসা তিনতলা। নিচতলায় মসজিদ, বাকি দুই তলায় মাদরাসা। উপরে নির্মাণাধীন আরও দুই তলা। আমরা মসজিদের সামনে গোবেচারার মতো এসে দাঁড়ালাম। দাঁড়াতেই সবুজ জুব্বাপরা এক তালিবে এলেম এগিয়ে এলো। দৃষ্টিতে উৎসুক, মুখে জড়তা। কথা কিছু বলতে চায় কিন্তু তমিজের কারণে বলতে পারছে না।

আমিই আগে বাড়লাম, ‘কিতাবমেলার লোকসকল কই?’

তালিবে এলেম সাহস পেলো, ‘তারা নদীর পাড়ে খেলতে গেছে। আপনারা ঢাকা থেকে আসিছেন?’

‘হ, আসিলাম তো!’

‘বড় হুজুর আপনাদের জন্য দোতলায় এন্তেজাম করে রাখছে।’

যাক, এন্তেজামিয়া কমিটির তোয়াজের তারিফ করতেই হয়।

এই তালিবে এলেমের নাম রিদওয়ান। দেখতে শ্যামবরণ, পড়ে মাদরাসার হেদায়াতুন্নাহু জামাতে। এখনো কৈশোরে, দাড়ি-গোফ উঠি উঠি করছে। সে আমাদের বড় হুজুরের খাসকামরায় নিয়ে গেলো। গিয়ে দেখি, মেঝেতে লম্বা করে চারখানা বিছানা পাতা, সঙ্গে পাতলা কম্বল। দেখে জার্নির ক্লান্তি নিমেষেই উবে গেল। ব্যাগ-পত্তর রেখে আগে টান টান হয়ে শুয়ে একবার হাত-পায়ের কল-কব্জার জড়তা ছাড়িয়ে নিলাম।

এরই মধ্যে রিদওয়ান জানালো, আপনাদের জন্য মৌবন হোটেলে নাস্তার অর্ডার দেয়া আছে। বললেই নিয়ে আসবো। সে আর বলতে! জলদি নিয়ে আসো। রিদওয়ান দ্রুত প্রস্থান করলো।

 

দুই

কিছুক্ষণ পরই রিদওয়ান নানা পদী নাস্তার এন্তেজাম নিয়ে হাজির হলো। আমরা হাভাতের মতো গিলতে লাগলাম। রিদওয়ান হাঁটু মুড়ে বসে এটা সেটা এগিয়ে দিচ্ছিল। কোনো কিছু লাগবে কি-না, আস্তে গলায় জিজ্ঞেস করছিল। বুঝতে পারছি, আমাদের সামনে বসে থাকতে ইতস্তত লাগছে তার, বার বার উঠে বাইরে যাবার কোশেশে ব্যস্ত। আমরা জোর করে সামনে বসিয়ে রাখলাম। খেতে বললাম আমাদের সঙ্গে, কিছুতেই খেলো না। খেতে বলায় মরমে মরে যাচ্ছিল যেন।

সেদিন পুরোটা দিন এবং পরদিন সকাল পর্যন্ত ছিলাম কুষ্টিয়ার এই মাদরাসায়। রিদওয়ানসহ আরও দু-তিনজন ছেলে আমাদের আপ্যায়ণ-জিম্মাদারির আঞ্জাম দিয়েছে। মেহমানদের প্রতি সম্মান, বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং পারস্পরিক আচার-ব্যবহারে যে বিনয় তাদের মধ্যে দেখেছি, পৃথিবীর আর কোথাও সুলভে এই শ্রদ্ধা ও বিনয় আপনি পাবেন না। শ্রদ্ধা ও সম্মানের এই অমূল্য রতন একমাত্র কওমি মাদরাসায়ই উৎপন্ন হয়। কওমি মাদরাসার এটা একক গর্বের ধন। পৃথিবীর আর কোনো শিক্ষাব্যবস্থা, কোনো ধর্মীয় আশ্রম কিংবা বিদ্যায়তনে এমন দীক্ষা মেলে না।

অথচ কওমি মাদরাসার ছাত্রদের এসব কিছু শিখিয়ে দিতে হয় না। একজনকে দেখে আরেকজন শেখে, শিক্ষককে দেখে ছাত্র শেখে। এই ধারাবাহিকতা চলে আসছে রাসুলের সময়কাল থেকে। এটাই কওমি মাদারাসার সঙ্গে মদিনার ইলমের সবচে বড় কানেকশন। বিরাট বিরাট ডিগ্রির নিশ্চয়তা দেয়ার দায়িত্ব কওমি মাদরাসার না, কওমি মাদরাসা থেকে সেই জিনিস শিক্ষা দেয়া হয় যেটা পৃথিবীর আর কোথাও শিক্ষা দেয়া হয় না। সেটা হলো গুরুভক্তি, বড়কে শ্রদ্ধা, শিক্ষককে সম্মান করার বিরল দীক্ষা। এখানেই কওমি মাদরাসার স্পেশালিটি। কওমির এই স্পেশালিটি দিয়েই বিশ্বজয় করা সম্ভব!

 

তিন

ফেসবুকসহ বিভিন্ন স্যোসাল মিডিয়ায় বেশ কিছুদিন ধরে রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক নানা বিষয় নিয়ে বহু বিতর্ক হয়ে আসছে। হয় অনেক কুৎসিত-কদাচার চর্চা। অনেক পিতাতুল্য আলেমকে বিশ্রীভাষায় গালি দেয়া হয়, অনেক শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিকে দালাল- এজেন্টও বলা হয়, অনেক ইসলামি নেতার নাম-চেহারা বিকৃত করে চরমভাবে অপমানিতও করা হয়।এর যেন কোনো শেষ নেই। এর যেন কোনো জবাবদিহিতা থাকার দরকারই নেই!

বাংলাদেশের ৪০ লাখ মাদরাসার ছাত্র বা শিক্ষক কয়জন ফেসবুক চালায়-আমার জানা নেই। তবে সার্বিক বিচার-বিশ্লেষণ করে একটা স্বাভাবিক হিসাবমতে বলতে পারি, বড়জোর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কওমি আলেম বা ছাত্র-শিক্ষক হয়তো ফেসবুকে সক্রিয় থাকে। কিন্তু সারা বাংলাদেশের ৮৫ থেকে ৯০ ভাগ মাদরাসাছাত্র বা শিক্ষক ফেসবুকের ব্যাপারে অজ্ঞ বা অনাগ্রহী।

সুতরাং যারা ফেসবুককে কওমির নামে নিজস্ব মতযুদ্ধের প্রধানতম হাতিয়ার মনে করে ফেসবুক-জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়েন, মনে রাখতে হবে, তারা কওমির খুব সামান্য অংশের প্রতিনিধিত্ব করেন। সামগ্রিক কওমি মাদরাসার ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে তাদের অঙ্গীভূত করা নিতান্ত অনুচিত। ফেসবুক বা স্যোসাল মিডিয়ায় তাদের প্রদত্ত গরম মশলা সদৃশ বক্তব্য কখনোই কওমি মাদরাসাকে রিপ্রেজেন্ট করে না। কুষ্টিয়ার একজন রিদওয়ান কিংবা ভোলার একজন তারেক হলো কওমি মাদরাসার আদি ও আসল পাহারাদার; একজন আলেম কিংবা গুরুজন কাউকে দেখলেই যার মুখে আপনা থেকেই শ্রদ্ধায় সালাম বেরিয়ে আসে।

৬৮ হাজার গ্রাম-বাংলাজুড়ে যে অসংখ্য কওমি মাদরাসা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, নীরবে নিভৃতে যেখানে অহর্নিশ চলছে ধর্মরক্ষার সুরেলা সবক-সেইসব মাদরাসাই বাংলাদেশের কওমি মাদরাসার প্রতিনিধিত্ব করে। সেখানকার যে ছাত্রটি বাপের বয়সী যে কোনো মানুষ দেখলে শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়ে, সেই ছাত্রটিই সত্যিকারের কওমিয়ানের প্রতিচ্ছবি। মেহেরপুরের গাংনী কিংবা সুনামগঞ্জের দূর হাওড়ের পাড়ে গড়ে ওঠা টিনের চালার যে মাদরাসাটি বছরের পর বছর শত প্রতিকূলতা ছাপিয়ে ইলমে দ্বীনের বাতি জ্বেলে রেখেছে, ওখান থেকেই উদ্গত হয় কওমি মাদরাসার মূল স্পিরিট। ওটাই বাংলাদেশের দেওবন্দ। ওখানেই জাগ্রত আছে সত্যিকারের দেওবন্দিয়্যাত।

ফেসবুকে বিতর্কপ্রিয়, গুরুজনকে গালমন্দকারী, আলেমদের অসম্মানকারী, বাবার বয়সী ব্যক্তিকে তুচ্ছ করা যেসব কওমি বেশধারী লোকজনকে আমরা দেখি, তারা কওমির রিপ্রেজেন্টেটর নন। কোনোভাবেই হতে পারেন না। তিনি যদি সত্যিকারার্থে কওমিয়ান হন তাহলে হোসাইন আহমদ মাদানির সেই বিনয় কই? কাসেম নানুতাভির শ্রদ্ধাবোধ কই? কারি তৈয়্যব রহমাতুল্লাহি আলায়হির সেই ‘খোদ কো মিটানা’র আচার-আচরণ কই?

কথা বলার অধিকার আর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে বলেই আপনি গুরুজনকে গালি দিয়ে মহান কওমিয়ান পদবীধারী সাজতে পারেন না। আলেমদের তুচ্ছজ্ঞান করা কিংবা অপমান করা নিশ্চয় কওমি মাদরাসার ঐতিহ্যের ধারা নয়। আপনাকে আপনার শেকড়ের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে হবে। যেই শেকড় বাংলাদেশের প্রতিটি জনপদে আজও  নিবিড় শক্তভাবে ছড়িয়ে আছে। আপনাদের ব্যক্তিস্বার্থ আর লাইক-কমেন্ট পাবলিসিটির জন্য কওমি মাদরাসার সেই পবিত্র শেকড়কে কলুষিত করবেন না।

ফিচার ইমেজ : গৌরব সুদ/ফ্লিকার

পূর্ববর্তি সংবাদজাপার দাবি : সারা দেশে ১০০, ঢাকায় ৪ আসন
পরবর্তি সংবাদ৯ ডিসেম্বর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন