আতাউর রহমান খসরু ।।
১৬ বছরের কিশোর আবদুল্লাহ আল কাসিম গাজার ‘জুলিস পাবলিক হাই স্কুল’-এর ছাত্র। প্রতিদিন তার জন্য স্কুলে যাওয়াই এখন চ্যালেন্জের। অথচ এক মাস আগেও তার স্কুলে যেতে সময় লাগতো মাত্র ১৫ মিনিট। গ্রেট মার্চ রিটার্ন (স্বভূমে ফেরা) আন্দোলনের সময় পা হারায় সে। এখন চলতে হয় হুইল চেয়ারে। স্কুলে যেতেও ভীষণ কষ্ট হয় আল কাসিমের।
আল কাসিম গাজার শেখ রেদওয়ানের একটি অ্যাপার্টমেন্টের দোতলায় বসবাস করে। ভবনের ছোট প্রবেশপথ ব্যবহার করেই চলাফেরা করতে হয় তাকে। হুইলচেয়ার দোতলায় উঠানোর ঢালু পথ নেই সেখানে। বড় দুই ভাইয়ের সাহা্য্য নিয়ে দোতলায় ওঠে সে। হুইলচেয়ারও উঠিয়ে আনতে হয় উপরে। স্কুলে যাওয়ার কাঁচা বালুর রাস্তায় চলতে কাসিমের অন্তহীন ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিতে হয়।

স্কুলে যাওয়ার সময় হলে বড় ভাই তাকে বাড়ির নিচের রাস্তায় নিয়ে আসে। একটি ট্যাক্সি স্কুলে পৌঁছে দেয়। স্কুলে পৌঁছানোর পর ড্রাইভার তাকে হুইলচেয়ারে বসতে সাহায্য করে যেন সে নিজেই শ্রেণিকক্ষে যেতে পারে।
অবশ্য স্কুল কর্তৃপক্ষ কাসিম ও তার মতো অক্ষম শিক্ষার্থীদের জন্য নিচতলায় ক্লাসরুমের ব্যবস্থা করেছে। তবে টয়লেট, লাইব্রেরি ও গবেষণাগারের মতো সুবিধাগুলো তারা নিশ্চিত করতে পারছে না। কাসিম স্কুলের সবগুলো ক্লাস করতে পারে না। তিনটি ক্লাস করেই তাকে থেরাপি নিতে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়।
কাসিম বলছিল তার স্বপ্ন নিয়ে, আমার স্বপ্ন ছিল আমি ইলেক্ট্রনিক ইন্জিনিয়ারিং পড়বো। কিন্তু পা হারানোর পর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে- আমি এভাবে আর কতোদিন বাঁচবো। তবে আমার পরিবার আমাকে যেভাবে সহযোগিতা করছে তাতে মনে হয় আমি আমার স্বপ্ন ছুঁতে পারবো।

এ বছরের ৮ জুন ১৫ বছরের ওয়াসিম মাহমুদও গ্রেট মার্চ রিটার্ন বিক্ষোভের সময় আহত হয়। গাজা ইসরাইল সীমান্ত থেকে প্রায় সাতশো মিটার দূরে ছিল সে। অন্যদের সাথে তাল মিলিয়ে শ্লোগান দিচ্ছিল মাহমুদ। হঠাৎ অনুভব করলো ডান পায়ে ভর দিতে পারছে না এবং সে মাটিতে পড়ে আছে। ইসরাইলি স্নাইপাররা গুলি করেছিল তাকে।
মাহমুদ বলছিল, সেদিন আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছিলাম। কোনো ধরনের আক্রমণাত্মক বা বিপজ্জনক কিছু করিনি। এই আন্দোলন আমার জীবন পাল্টে দিল। আমার চলাচলের স্বাধীনতা, আমার স্বপ্ন সবকিছু এখন হুমকির মুখে।
মাহমুদ আল বানিন পাবলিক স্কুলের নাইন গ্রেডের ছাত্র। উত্তর গাজায় অবস্থিত তার স্কুল আর বাড়ির দূরত্ব ছিলো মাত্র এক কিলোমিটার। সে প্রতিদিন পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতো কিন্তু ডাক্তার তার পায়ে রড বসানোর পর ক্রাচের উপর ভর করে হাঁটতেও তার কষ্ট হয়।

তার পক্ষে ট্যাক্সি ভাড়া করে যাওয়া সম্ভব নয়। তিন বছর পূর্বে তার বাবা মারা যায়। এখন তার পরিবার চরম আর্থিক সংকটের মধ্যে। তার পরিবার মাসে ৩৫০ ডলার পেনশন পায়। যা দিয়ে পুরো পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করতে হয়।
আমি প্রতিদিন স্কুলে যেতে চাই। কিন্তু আমার ক্ষতের কারণে আমার পক্ষে তা সম্ভব হয় না। তবে মা আমাকে ঘরে লেখাপড়া করতে সাহায্য করে।
২০০৪ সালে মুহাম্মদ সারশুরের বাবা ইসরাইল বিমান হামলায় মারা যান। ২০১৪ সালে ইসরাইল-হামাস যুদ্ধের সময় তাদের বাড়িতে বোমা ফেলে ইসরাইলি বিমান বাহিনী। তখন থেকেই গ্রেট মার্চ বা ‘স্বভূমে ফেরা’র আন্দোলন শুরু হয়। মুহাম্মদ তার বাবার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।

৮ জুন ফিলিস্তিনিরা যখন মালাকা স্কয়ারে তাদের নিজ ভূমিতে ফিরে যাওয়ার জন্য আন্দোলন করছিল, ইসরাইলি বাহিনী তার তলপেটে গুলি করে। সেই থেকে শরীরে ক্ষত বহন করে চলছে মুহাম্মদ। তার মেরুদণ্ডে এখনও ক্ষত রয়ে গেছে। প্রচণ্ড রকম ব্যথা হয় সেখানে। সে চেয়ারে দীর্ঘ সময় বসে থাকতে পারে না। ডাক্তার বলেছে, ক্ষত সারাতে অপরেশন করলে মুহাম্মদ আজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাবে।
মুহাম্মদের মা তাকে উদ্বুদ্ধ করেছে তার গাজার দারুল আরকাম স্কুলে নাইন গ্রেড সম্পন্ন করতে। কিন্তু সে যেহেতু দীর্ঘ সময় চেয়ারে বসে থাকতে পারে না, তাই তার পক্ষে তা ক্লাসে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
মুহাম্মদ যদিও এখন হুইল চেয়ার ব্যবহার করে না। কিন্তু সে দৌড়াতে বা কোনো ভারী জিনিস উঠাতেও পারে না। কখনো কখনো তার ঘাঁ বেড়ে যায়। তখন সে আর কোথাও যেতে পারে না।
এতো প্রতিকূলতার মধ্যেও মুহাম্মদ স্বপ্ন দেখে। তার স্বপ্ন সে ডাক্তার হবে। মুহাম্মদ বলে, আমি আমার প্রতিবন্ধকতার কথা জানি, তবে তা আমাকে দমিয়ে রাখতে পারবে না ইনশাআল্লাহ!
৩০ মার্চ। স্বভূমে ফেরা আন্দোলনের প্রথম দিন। গাজার আবু সাফিয়া এলাকায় আরাফাত হারবের তলপেটে গুলি করে ইসরাইলি স্নাইপাররা। তখন তার বয়স ১৫ বছর। আরাফাত ইসরাইল-গাজার মধ্যবর্তী কাঁটাতারের বেড়া অতিক্রম করার চেষ্টা করছিল। কাঁটাতার অতিক্রম করার সাথে সাথে তাকে গুলি করে ইসরাইলি বাহিনী। গুলিবিদ্ধ হয়ে সে ইসরাইলের সীমান্তে লুটিয়ে পড়ে।

আরাফাতের স্বপ্ন সে তার পিতৃভূমিতে ফিরে যাবে। ‘আমার চিরদিনের স্বপ্ন আমি আমাদের অধিকৃত ভূমিতে ফিরে যাবো। এই স্বপ্নই আমাকে কাঁটাতারের বেড়া অতিক্রম করতে উৎসাহিত করে। আমি কখনও ভয় পাই না। আমি সেখানে ১৫ মিনিট পড়েছিলাম। আমার রক্ত ঝরছিলো। একজন চিকিৎসক আমাকে উদ্ধার করে ফিলিস্তিনের নিকটস্থ হাসপাতালে ভর্তি করেন।’
বুলেটের আঘাতে আরাফাতের নিম্নাংশে একাধিক ক্ষত তৈরি হয়। তার শরীরে অনেকগুলো অপারেশন করতে হয়েছে। কিন্তু এখনও পুরোপুরি সুস্থ্ হয়ে ওঠেনি সে। উন্নত চিকিৎসার জন্য তার মিসরে যেতে হয়। এজন্য ব্যয় হয় সতেরশো মার্কিন ডলার।
আরাফাত এখন গাজার আত-তাকওয়া পাবলিক হাই স্কুলে দশম গ্রেডে পড়ে। পশ্চিম গাজার শেখ রেদওয়ান জেলায় আরাফাতের বাড়ি। বাবা-মা ও আট ভাই-বোনের সাথে সেখানেই তারা বসবাস করে। আরাফাত এখন হুইল চেয়ার ছেড়ে ক্রাচ ব্যবহার করছে। তবে শরীর খুবই দুর্বল। দুর্বলতার জন্য সে ঠিকমতো চলাচল বা স্কুলে যেতে পারে না।
আহত হওয়ার পর সে স্কুলের কোনো ক্লাসেই অংশগ্রহণ করতে পারেনি। স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষাও তার ছুটে যায়। আরাফাতের স্বপ্ন সে পোশাক ডিজাইনার হবে এবং তার পোশাক তৈরির একটি কারখানা থাকবে। কিন্তু শারীরিক অক্ষমতা তাকে অগ্রসর হতে দিচ্ছে না।
উল্লেখ্য, এ বছর শান্তিপূর্ণ ‘স্বভূমে ফেরা’ আন্দোলনে গাজা উপত্যাকায় এ পর্যন্ত ২১০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়। যার ১৯ ভাগই শিশু। আহত হয়েছে দশ হাজার ফিলিস্তিনি যার মধ্যে আঠারোশোই শিশু। গাজার স্কুলগুলোর রিপোর্ট অনুযায়ী আন্দোলনের পর ৯২টি শিশু স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে আহত হওয়ার কারণে। এখনও নিখোঁজ রয়েছে অনেকে।
মিডল ইস্ট মনিটর অবলম্বনে
