আতাউর রহমান খসরু ।। বাংলাদেশে শীতাকালকে বলা হয় ওয়াজ-মাহফিলের মৌসুম। শীতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেশজুড়ে শহর, পাড়া, মহল্লা, গ্রামে-গঞ্জে হয় অসংখ্য মাহফিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব মাহফিলের আয়োজন করেন বিভিন্ন মসজিদ, মাদরাসা, দ্বীনি সংগঠন ও সাধারণ দ্বীনদার মানুষ। মানুষের মাঝে দ্বীনি শিক্ষা প্রচারে এসব মাহফিলের ভূমিকা কম নয়। বিশেষত যেসব মানুষ দ্বীনি শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পাননি এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগও নেই-তাদের জন্য দ্বীন শিক্ষার বড় মাধ্যম এই মাহফিলগুলো।
কিন্তু সব মাহফিলে এই উদ্দেশ্য অর্জিত হয় না। মাহফিলগুলোতে বক্তা ও আয়োজক উভয় শ্রেণির ভিন্ন প্রয়াস দেখা যায় প্রায়শই। নিজস্ব মত ও মতবাদ প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন অনেকেই। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এমন আশঙ্কা বাড়ার সম্ভাবনা আরও বেড়েছে। আর হয়তো সেই চিন্তা থেকেই নির্বাচনকালীন সময়ে ওয়াজ-মাহফিল বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নির্বাচনী প্রচারণা চালানো যাবে না –এমন নির্দেশনা জারি করার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
কমিশন বলছে, বাংলাদেশের নির্বাচনী আইনের আলোকেই এমন নির্দেশনা জারি করছেন তারা। কারণ নির্বাচনী আচরণ বিধিতে বলা হয়েছে, মসজিদ-মন্দির, গির্জা বা অন্য কোনো ধর্মীয় উপাসানালয়ে কোনো প্রকার নির্বাচনী প্রচার চালানো যাবে না।
নির্বাচন কমিশনের এমন সিদ্ধান্তকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন চট্টগ্রাম ওমর গনি এম ই এস ডিগ্রি কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ফ ম খালিদ হোসাইন।
তিনি বলেন, ‘আমি বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখছি। কারণ, একটি মাহফিলে বিভিন্ন চিন্তা ও মতাদর্শের লোক থাকে। একটি বিশেষ দলের পক্ষে প্রচারণা চালালে অন্যরা ক্ষুব্ধ হতে পারে। এতে আয়োজক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার ভয়ও থাকে। তাই এটা বন্ধ হতে পারে।’
তবে বিষয় ভিন্নভাবে দেখেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ। তিনি মনে করেন, ‘রাজনীতি মানুষের ধর্মীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একজন মুসলমান কাকে ভোট দিবে এবং কাকে দিবে না সে বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা রয়েছে। ওয়াজ-মাহফিলে মানুষের সামনে সেই নির্দেশনা তুলে ধরলে তা মাহফিলের উদ্দেশ্য পরিপন্থী হবে বলে আমি মনে করি না। আমি মনে করি, মাহফিলগুলোতে ইসলামি রাজনীতির পক্ষে কথা বলার সুযোগ থাকা উচিত।’
তার মানে আপনি ইসলামি রাজনীতি ও সাধারণ ধারার রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য করতে চাচ্ছেন?
‘হ্যাঁ, আমি পার্থক্য করতে চাই। কারণ, ইসলামি রাজনীতির পক্ষে কথা বলা মাহফিলের পরিবেশ ও উদ্দেশ্যের পরিপন্থী নয়। কিন্তু যার দল ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী নয়, যাদের গঠনতন্ত্রে ইসলাম বিরোধী মূলনীতি রয়েছে তারা কোন যুক্তিতে ধর্মীয় মজলিসে এসে ভোট চাইবে?’-বলেন ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব।
তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি, এই নির্দেশনা জারি হলে ইসলামি দলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, যারা ইসলাম ভালোবাসেন তারাই ওয়াজ-মাহফিলে আসেন। ইসলামি দলগুলো যদি তাদের কাছে ভোট চাইতে না পারে তাহলে কাদের কাছে চাইবে?’
এই পার্থক্যটা কে করবে? অনুমতি থাকলে তো সাধারণ ধারার রাজনৈতিক নেতারা এসেও ভোট চাইতে শুরু করবেন? উত্তরে অধ্যক্ষ ইউনুছ আহমাদ বলেন, ‘এই দায়িত্ব সবার। আয়োজকরা তো খেয়াল করবেনই সাথে সাথে যারা ভোট যাইবেন তাদেরও নৈতিকতার জায়গা থেকে এমন কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত।’
তবে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ এবং উন্মুক্ত থাকলে সুযোগের অপব্যবহারের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেননি এই নেতা।
ড. আ ফ ম খালিদ অবশ্য ইসলামি দলগুলোর নেতাদেরও সাধারণ মাহফিলে নির্বাচন ও রাজনৈতিক বিষয়ের উত্থাপন করা উচিত হবে না বলে মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, ‘মাহফিলের আয়োজক যদি ইসলামি কোনো দল হয় তাহলে সমস্যা নেই। না হলে তারা নিজস্ব রাজনৈতিক প্লাটফর্ম থেকে দলের কথা বলবেন। অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের আয়োজিত মাহফিলে রাজনৈতিক বক্তব্য মাহফিলের পরিবেশ এবং প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারে।’
তবে ড. খালিদ মনে করেন, ‘কোনো প্রার্থী যদি রাজনৈতিক বক্তব্য না রেখে শুধু নিজের জন্য দোয়া চান তবে তাকে সে সুযোগ দেয়া যেতে পারে। শর্ত হলো, এ সুযোগ সবার জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে।’
বিভিন্ন সময় দেখা যায়, স্থানীয় জনপ্রনিধির নাম পোস্টারে বড় করে ছাপানো হয়, তাকে সভাপতি বা উদ্বোধক রাখা হয়। কখনো আয়োজক প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ বিবেচনা করে আবার কখনো প্রাশাসনিক ঝামেলা এড়ানোর জন্য তা করা হয়। ড. খালিদ মনে করেন, ‘নির্বাচনের বাইরের সময়ে এটা দোষণীয় নয়। তবে নির্বাচনের সময় তা নির্বাচনী প্রচার বলেই গণ্য হবে।’
তিনি বলেন, ‘যদি রাজনৈতিক নেতাদের নাম না দিলে যদি মাহফিল করার সুযোগ না থাকে, তবে নির্বাচনের সময় মাহফিল করবে না। না হলে বিশেষ দলের পক্ষাতিত্ব করা হবে।’
