মাওলানা ইসহাক ওবায়দী। অভিজ্ঞতা ও সান্নিধ্যে ধন্য ৭১ বছর পার করা এক প্রবীণ আলেম-লেখক। নোয়াখালী সেনবাগের মাইজদিপুর গ্রামে নিজ বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেছেন মাদরাসা। আল-মাদরাসাতুল বশিরিয়া। সেখানেই কাটছে তার বার্ধক্যের জীবন। লেখালেখি, কর্ম, আধ্যাত্মিকতা, চিন্তা ও নানামুখি কাজ আর স্বপ্নের চর্চা করছেন নিভৃত সেই গ্রামে বসে। ইসলাম টাইমস-এর পক্ষ থেকে তার সঙ্গে কথা বলেছেন শরীফ মুহাম্মদ।
ইসলাম টাইমস : আপনি দাওরায়ে হাদিস কোথায় পড়েছেন? কোন সনে পড়েছেন?
মাওলানা ইসহাক ওবায়দী : ১৯৭০ সনে দাওরায়ে হাদিস পড়েছি। ফেনী ওলামাবাজার মাদরাসায়।
ইসলাম টাইমস : আপনার পড়াশোনা সবটুকুই ওলামাবাজার মাদরাসায়?
মাওলানা ইসহাক ওবায়দী : শুরুটা হয়েছিল চট্টগ্রামের মোজাহেরুল উলুম মাদরাসায়, তারপর পটিয়া মাদরাসায়। তখন আমার বয়স ৯ বছর। স্কুলে ৪র্থ শ্রেণিতে পড়তাম। আমার আব্বাজান আমাকে পটিয়ায় ভর্তি করিয়ে দেন। আব্বাজানের শায়েখ ছিলেন পটিয়ার মুফতি আজিজুল হক রহ.। আমাকে তিনি তার হাতে তুলে দেন। পরবর্তী সময়ে লেখাপড়ার সিংহভাগ আমার কেটেছে ফেনীর ওলামাবাজার মাদরাসায়।
ইসলাম টাইমস : ৭১ সনে ঢাকায় কীভাবে এলেন?
মাওলানা ইসহাক ওবায়দী : ৭০ সনের নির্বাচনে আমাদের উস্তায ও শায়েখ ওলামাবাজারের মাওলানা আবদুল হালীম রহ. নির্বাচন করেছিলেন। তিনি ছিলেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রার্থী। জমিয়তে উলামা (মুফতি মাহমুদ-হাযারভী গ্রুপ) করতাম তখন থেকেই। ঢাকার মাওলানা শামসুদ্দীন কাসেমী রহ. আমাকে ঢাকায় আসতে বলেন। কিছুদিন গাজীপুরে ছিলাম। গাজীপুরে যখন পাকবাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়- তখন অনেকেই সেখান থেকে সরে পড়েন। আমিও ঢাকায় চলে আসি। মার্চ মাসের কিছুদিন বায়তুল মোকাররমের পাশে বইয়ের দোকান করেছি।
ইসলাম টাইমস : আপনি রেডিওতে ছিলেন কিছুকাল। সেটা কখন থেকে?
মাওলানা ইসহাক ওবায়দী : ৭২ সনের দিকে রেডিওতে ঢুকলাম। আমি তখন নানা রকম গান ও গীতি রচনা করতাম। এগুলো প্রচারের জন্য রেডিওতে যোগাযোগ করতাম। ওইভাবেই যোগাযোগ গড়ে ওঠে। পরে চাকরি হয়ে যায়। হাজরিবাগে আমার এক বন্ধু ছিলেন হাফেজ অ্যাডভোকেট আবু সাঈদ। এ ক্ষেত্রে তিনি আমাকে সহযোগিতা করেন। ৮০ সন পর্যন্ত সেখানে ছিলাম।
ইসলাম টাইমস : রেডিওতে আপনার দায়িত্ব কী ছিল?
মাওলানা ইসহাক ওবায়দী : ওখানে আমি ছিলাম ক্যাজুয়াল আর্টিস্ট পদে। ‘সংবাদ প্রবাহ’ নামে একটি অনুষ্ঠান প্রচার হয়। যেখানে ভিভিআইপি-ভিআইপিদের অনুষ্ঠানের খবর প্রচার হয়। অনুষ্ঠানের কিছু বক্তব্য রেকর্ড করে এনে সেখান থেকে বাছাই করে প্রচার করা হতো। ওই রেকর্ডের কাজে আমি থাকতাম।
ইসলাম টাইমস : এ কারণে তো অনেকের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা-সাক্ষাৎ আপনার হয়েছে?
মাওলানা ইসহাক ওবায়দী : মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব, মরহুম জিয়াউর রহমান সাহেব- তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান কভার করতে হয়েছে। এছাড়াও সরকারের বড় পদে সমাসীন অনেকেরই অনুষ্ঠান কভার করতে হয়েছে। চাকরির নিয়ম হিসেবেই এটা করতে হয়েছে।
ইসলাম টাইমস : দাওরায়ে হাদিস ছাড়া আপনার আর কোনো সার্টিফিকেট ছিল? কীভাবে রেডিওতে চাকরি করলেন?
মাওলানা ইসহাক ওবায়দী : ওই সময় ওই রকম পদে নিয়োগের জন্য সার্টিফিকেট দেখা হতো না। কাজ পারে কি না এটাই দেখা হতো। ওইভাবেই কাজ করতাম।
ইসলাম টাইমস : রেডিওতে থাকাকালে সরকারের কারও সাথে যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল?
মাওলানা ইসহাক ওবায়দী : আওয়ামী লীগের আবদুল মালেক উকিল, আবদুল মান্নান (টাঈাইল), পরবর্তী সময়ে হাবীবুল্লাহ খানের সাথে যোগাযোগ ছিল। হাবীবুল্লাহ খান ৮০ সনের দিকে রেডিওতে আমাকে স্থায়ী নিয়োগ দিতে চেয়েছিলেন। ততদিনে আমার আগ্রহ ফুরিয়ে এসেছে। আমি রেডিও ছেড়ে দিয়েছি।
ইসলাম টাইমস : রেডিওতে থাকাকালে লেখক-কবি কার কার সাথে যোগাযোগ গড়ে ওঠেছিল?
মাওলানা ইসহাক ওবায়দী : কবি জসিমউদ্দিন, তালিম হোসেন ও কাজী নজরুল ইসলামের বন্ধু সুফী জুলফিকারের সঙ্গে পরিচয় গড়ে উঠেছিল। এ রকম নবীন-প্রবীণ বহু লেখক-কবির সঙ্গে রেডিও অফিসে দেখা হতো। পরবর্তী সময়ে তাদের কারও কারও সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে উঠত।
ইসলাম টাইমস : আপনার তো আহমদ ছফার সঙ্গে গভীর যোগাযোগ ছিল। এটা কীভাবে?
মাওলানা ইসহাক ওবায়দী : রেডিওতে থাকাকালে একবার একটা অনুষ্ঠানের নিউজ করতে গিয়েছিলাম। তার অভিনব বক্তব্যে মুগ্ধ হয়েছিলাম। এরপর থেকেই যোগাযোগ ছিল। টোকাইদের জন্য তার একটা স্কুলে আমি ও সাংবাদিক নাজিমউদ্দিন মোস্তান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতাম। সূর্যসেন হলের সামনের মাঠে ওই স্কুলটি বসত। ইসলাম, কমিউনিজম ও পুঁজিবাদ নিয়ে তার বক্তব্যগুলি ভালো লাগত। ইসলামকে প্রাধান্য দিয়ে এমন অনেক কথা তিনি বলতেন, যা সচরাচর কোনো বামপন্থীর মুখে শোনা যেত না।
ইসলাম টাইমস : আপনার রচিত কিছু লিরিক নিয়ে তো একটি ক্যাসেট বের হয়েছিল।
মাওলানা ইসহাক ওবায়দী : আমার লেখা হামদ-নাতগুলো নিয়ে একটি ক্যাসেট বের করেছিলেন শিল্পী বশির আহমদ। ওই ক্যাসেটটির নাম ছিল- লাব্বাইক। আমার বেশিরভাগ লিরিকে তিনিই সুর দিয়েছিলেন।
ইসলাম টাইমস : বড় বড় আলেম-মনীষীর সঙ্গে আপনার তো অনেক যোগাযোগ ছিল। অনেকের সান্নিধ্য-সংশ্রব পেয়েছেন!
মাওলানা ইসহাক ওবায়দী : জীবনের শুরুতেই পটিয়ার মুফতি আজিজুল হক রহ.-এর সান্নিধ্যের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে, ওই বয়সে তার বয়ান শুনলে কাঁদতাম। জিরি মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আহমদ হাসান রহ., জিরি মাদরাসার মুহাদ্দিস মাওলানা আবদুল ওয়াদুদ রহ. ও মেখলের মুফতি ফয়জুল্লাহ রহ.-কে দেখেছি। কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে।
ইসলাম টাইমস : ওলামাবাজার মাদরাসার উস্তাদদের মধ্যে কার কার সান্নিধ্য পেয়েছিলেন?
মাওলানা ইসহাক ওবায়দী : মাওলানা আবদুল হালীম রহ. ছিলেন আমার প্রথম শায়েখ। এছাড়া মাওলানা সাইয়েদ আহমদ রহ. ও শাইখুল হাদিস মাওলানা আহমদ করীম রহ.-এর সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ হয়েছে।
ইসলাম টাইমস : ৮১ সনে হজরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর প্রেসসেক্রেটারি ছিলেন?
মাওলানা ইসহাক ওবায়দী : হজরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর সান্নিধ্যে যখন ছিলাম, তখন হুজুরের সান্নিধ্য তো পাওয়ার সুযোগ হয়েছে। একই সঙ্গে আরও অনেক ওলামায়ে কেরামের সঙ্গেও যোগাযোগ হয়েছে। বিশেষভাবে মাওলানা হাবীবুল্লাহ মেসবাহ রহ.-এর সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠেছিল। আমরা খুব কাছাকাছি ছিলাম। একসাথে সফর করেছি।
ইসলাম টাইমস : আপনি তো আধ্যাত্মিক ধারায় নিজেকে যুক্ত রাখেন। আপনার শায়েখ বা পীর কে?
মাওলানা ইসহাক ওবায়দী : আমার প্রথম শায়েখ ছিলেন ওলামাবাজারের হজরত মাওলানা আবদুল হালীম রহ.। পরে আমি হজরত মাওলানা এহসানুল হক সন্দ্বীপী রহ.-এর কাছে বায়াত হই। প্রায় ২০ বছর হজরতের কাছে আসা-যাওয়া করি। হযরতের ইনতেকালের পর ফেনী লালপোলের মুফতি সাঈদ আহমদ রহ.-এর কাছে বায়াত হই। মুফতি সাহেবের ইনতেকালের পর আমি সম্পর্ক রেখে চলছি হজরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর বিশিষ্ট খলিফা মাওলানা মুমিনুল্লাহ সাহেবের সঙ্গে।
ইসলাম টাইমস : আপনার কোনো শায়েখ আপনাকে খেলাফত দিয়েছেন?
মাওলানা ইসহাক ওবায়দী : জি। হজরত মাওলানা এহসানুল হক সন্দ্বীপী রহ. এবং লালপোলের মুফতি সাঈদ আহমদ রহ. আমাকে এজাযত দিয়েছেন।
ইসলাম টাইমস : এই জীবন ও বয়সে এসে রেডিওর চাকরির সময়টাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
মাওলানা ইসহাক ওবায়দী : এখন এই পরিণত বয়সে এসে এটাই মনে হচ্ছে, ওই চাকরিটা আমার জন্য ছিল অত্যন্ত অপছন্দনীয়। একজন আলেমেদ্বীনের জীবনযাপন পুরোপুরি রক্ষা করা যেত না তখন।
ইসলাম টাইমস : বর্তমানে কওমি সনদের স্বীকৃতি ও আলেমসমাজের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কিছু বলুন।
মাওলানা ইসহাক ওবায়দী : অনেক কিছুই দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে দেখছি। আত্মমর্যাদার সঙ্গে কিছু হলে ভালো। কিন্তু পদলেহনের মতো দৃশ্য তৈরি হলে মনটা বিষণ্ন হয়ে যায়।
ইসলাম টাইমস : সার্বিক বিষয়ে কিছু পরামর্শ…
মাওলানা ইসহাক ওবায়দী : দোয়া, কান্নাকাটি, আল্লাহ তাআলার দিকে মুতাওয়াজ্জুহ হতে হবে। মুসিবতকে মুসিবত মনে করা হচ্ছে না। প্রশাসনের কাছে ছোটাছুটি করে মুসিবত দূর হবে না। ইসলামের দুটি দুর্গ এখন বিপন্নতার পথে। তাবলিগ জামাত সংকটে পড়েছে। উম্মতের একটি আস্থার কেন্দ্রে এই তাবলিগ জামাত।এখানে এখন চিড় ধরানো হয়েছে। আরেকদিকে কওমি মাদরাসাগুলো নিয়ন্ত্রণের প্রস্তুতিও সম্পন্ন হয়েছে। দ্বীনের এ দুটি দু্র্গের সংকটে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি বাড়িয়ে দিতে হবে। আমরা কাঁদতে ভুলে গেছি।
