মাহফিলের আলোচনায় অতি প্রশংসা ও অতি উত্তেজনা কোনোটাই থাকা উচিত নয় : মুফতি হিফজুর রহমান

বাংলাদেশের সাধারণ মুসলমানের মধ্যে দ্বীন প্রচারের অন্যতম মাধ্যম ওয়াজ-মাহফিল। দ্বীন ও দ্বীনি শিক্ষার প্রসারে যুগ যুগ ধরে মাহফিলের প্রচলন রয়েছে এদেশে। সাধারণ মানুষের দ্বীনি চাহিদা সামনে রেখে সর্ব সাধারণের সহযোগিতায় এসব মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। বক্তারা নিজের জ্ঞান ও যোগ্যতা অনুযায়ী দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। কুরআন-হাদিস ও শরয়ি জ্ঞান মাহফিলের প্রধান অনুষঙ্গ হলেও বক্তার সুর, বাচনভঙ্গি, শব্দচয়ন ও উপস্থাপনার বিশেষ প্রভাব রয়েছে মাহফিলে।

উপস্থাপনার ত্রুটির কারণে বক্তার যুক্তিপূর্ণ ও উপকারী আলোচনা যেমন মূল্যহীন হয়ে যেতে পারে, তেমনি বাক্যশৈলী ও বাকসংযম বক্তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দিতে পারে কয়েক গুণ। একজন বক্তার ভাষা কেমন হবে সে নির্দেশনা দিয়েছেন জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া প্রধান মুফতি ও সিনিয়র মুহাদ্দিস মুফতি হিফজুর রহমান।  কুরআন-হাদিস ও আকাবিরদের অনুসৃত পথ থেকে বক্তার শব্দ-বাক্য কেমন হবে তার একটি উত্তম দৃষ্টান্ত ‍তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন তিনি।  তার সঙ্গে কথা বলেছেন আতাউর রহমান খসরু

ইসলাম টাইমস : মাহফিলে বক্তাদের আলোচনার ভাষা ও ধরন কেমন হবে?

মুফতি হিফজুর রহমান : একজন বক্তা মানুষকে জান্নাতের সুসংবাদ দেবেন এবং জাহান্নামের ভয় প্রদর্শন করবেন। জান্নাত ও জাহান্নামের বর্ণনা এমন ভাষায় করা দরকার যেন তার দৃশ্যপট মানুষের চোখের সামনে ফুটে ওঠে। রাসুলুল্লাহ সা. যখন মানুষকে নসিহত করতেন, তখন কখনও কাঁদতেন, কখনও মুচকি হাসতেন আবার রাগের বিষয় আসলে রাগান্বিতও হতেন। তবে এর কোনোটাই সীমার অতিরিক্ত করতেন না। কৃত্রিমতা থাকতো না।

ইসলাম টাইমস : অনেক তরুণ বক্তাকে দেখা যায় উত্তেজনাপূর্ণ কথা বলে মাহফিলের পরিবেশ সংকটপূর্ণ করে তুলেন।

মুফতি হিফজুর রহমান : প্রয়োজনে বক্তার বক্তব্যে রাগ ও ক্রোধ প্রকাশ পেতে পারে। কিন্তু তা যেন সীমা অতিক্রম না করে। মাহফিলের পরিবেশ নষ্ট না করে। স্থান-কাল-পাত্র বুঝে বক্তব্য দেয়াও বক্তার দায়িত্ব। আল্লামা শামি বলেছেন, ‘যে যুগের অবস্থা সম্পর্কে সচেতন নয় সে মূর্খ’।

এমন কথা বলা উচিত নয় যাতে মাহফিল বন্ধ হয়ে যায়, মাহফিলের প্রতি মানুষ বিমুখ হয় অথবা আয়োজকদের সমস্যা হয়। কেননা তা প্রজ্ঞার পরিপন্থী। আর আল্লাহ তায়ালা তার পথে মানুষকে প্রজ্ঞার সাথে দাওয়াত দিতে বলেছেন।

ইসলাম টাইমস : আবার এর বিপরীতে দেখি, অনেক বক্তা বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা মহলকে খুশি করার জন্য অতিরিক্ত স্তুতিমূলক কথাও বলেন।

মুফতি হিফজুর রহমান : উপযুক্ত ব্যক্তির প্রশংসা দোষের না। কিন্তু প্রশংসা যদি হয় কোনো ফাসেক ব্যক্তির, প্রশংসা যদি হয় ব্যক্তি স্বার্থে তাহলে তা দোষণীয়। ব্যক্তি উপযুক্ত হলে প্রশংসা তার জন্য অনুপ্রেরণা হবে আর ব্যক্তি অযোগ্য হলে প্রশংসা তাকে ধ্বংস করবে। হাদিসে আছে, ফাসেক ব্যক্তির প্রশংসা করলে আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে। কতো মারাত্মক কথা।

আরেকটি বিষয় হলো, কোনো আলেম যদি কোনো সাধারণ মানুষের অতিশয় প্রশংসা করে তবে তার মধ্যে অহঙ্কার পয়দা হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। তখন সে অন্যদের তো মূল্যায়ন করবেই না, এমনকি আলেমদেরও মূল্যায়ন করতে চাইবে না।

কোনো আলেম যখন সাধারণ মানুষের প্রশংসা করবে, তখন সে নিয়ত করবে আমার প্রশংসা এই লোকের ভেতর দ্বীনের অনুপ্রেরণা তৈরি করবে। এই লোক খুশি হলে আমার স্বার্থ হাসিল হবে এমন নিয়ত থেকে প্রশংসা করা ঠিক হবে না।

ইসলাম টাইমস : আলোচনার সময় বক্তার কোন কোন বিষয় থেকে বিরত থাকা দরকার?

মুফতি হিফজুর রহমান : শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য হাস্য-কৌতুক করা, মিথ্যা গল্প বলার ব্যাপারে হাদিসে কঠোরে নিষেধ রয়েছে। অবান্তর গল্প ও জাল হাদিস বর্ণনা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। যারা এমন কথা বলেন, তারা মনে করেন এসব কথায় হয়তো মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারে। কিন্তু আসলে তাতে কোনো হেদায়েত নেই। হেদায়েত আছে আল্লাহর কুরআন ও হাদিসে। হাদিসের অনেক কথা সাদামাটা মনে হয়। কিন্তু তাতে আল্লাহ হেদায়েতের নুর রেখেছেন কোনো সন্দেহ নেই।

ইসলাম টাইমস : বক্তার আলোচনায় সুর প্রয়োগের মাত্রা নিয়ে কিছু বলবেন?

মুফতি হিফজুর রহমান : সুর অনেক সময় আলোচনার সৌন্দর্য্য বাড়ায়। তবে সুরসর্বস্ব আলোচনা মানুষের উপকারে আসে না। হাদিসে এসেছে, মানুষ কুরআন তেলাওয়াত করবে সুললিত কণ্ঠে। সে হিসেবে কুরআন তেলাওয়াত সুন্দর কণ্ঠে তেলাওয়াত করবে, হাদিস পাঠের সময় উচ্চারণের বিশুদ্ধতার প্রতি লক্ষ্য রাখবে, এটা দোষের না। কিন্তু সুর যদি হয় গানের মতো তা তো ঠিক হবে না।

সুরের অতি প্রয়োগ আমাদের আকাবিররা পছন্দ করতেন না। মেখল মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মুফতি আজম মুফতি ফয়জুল্লাহ রহ. বেশি বেশি শে’র বলা, টেনে টেনে কথা বলা অপছন্দ করতেন।

ইসলাম টাইমস : তিনি কেনিএসব অপছন্দ করতেন?

মুফতি হিফজুর রহমান : তিনি বলতেন, মানুষের হেদায়েতের জন্য কুরআন-হাদিস সর্বোত্তম উপাদান। ওয়াজের ক্ষেত্রে রাসুল সা. সর্বোত্তম আদর্শ। তিনি তার কথায় শে’র বা কবিতা আনতেন না। নসিহতের মধ্যে কয়েকটি শে’র আশআর আসতে পারে। কিন্তু কারো কারো কথায় সুর থাকে, শে’র বা কবিতা থাকে কিন্তু কুরআন হাদিস থাকে না। এ বিষয়গুলো থেকে বাঁচার জন্যই তিনি হয়তো বিষয়গুলো থেকে নিরুৎসাহিত করতেন।

ইসলাম টাইমস : আকাবিরদের মধ্যে কার আলোচনা আপনার ভালো লাগতো এবং কেন?

মুফতি হিফজুর রহমান : আমি মেখল পড়ার সময় মুফতি ফয়জুল্লাহ রহ.-এর বাড়িতে একটা মাহফিল হতো। সেখানে সারা দেশের বড় বড় আলেম ও মুহাদ্দিস উপস্থিত হতেন। হাটহাজারী মাদরাসার শায়খুল হাদিস থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের প্রধান প্রধান আলেমরা সেখানে উপস্থিত হতেন। মুফতি ফয়জুল্লাহ রহ.-এর বয়ানটা তারা খুব মনোযোগসহ শুনতেন। মাথা নিচু করে এমনভাবে বসতেন যেমন হাদিসে বলা হয়েছে –সাহাবায়ে কেরাম রা. এমনভাবে রাসুল সা.-এর আলোচনা শুনতেন যেন তাদের মাথার উপর পাখি। আমি এই দৃশ্য সেখানে দেখেছি। আলেমরা তার বয়ান থেকে পাথেয় নিয়ে যেতেন। অন্য জায়গায় তারা বয়ান করার সময় মুফতি ফয়জুল্লাহ রহ.-কে উদ্ধৃত করতেন।

আমরা দেখতাম, তিনি মেশকাত বা বুখারি শরিফ সাথে নিয়ে আসতেন। একটা হাদিস পাঠ করে সাধারণ ভাষায় অনুবাদ করতেন। সাথে সংশ্লিষ্ট আয়াত ও হাদিস বলতেন এবং জরুরি মাসায়েল বলতেন। মুফতি ফয়জুল্লাহ রহ.-এর কথায় কোনো সুর ছিলো না। খুব সাদাসিধে ভাষায় কথা বলতেন।

আমরা কারী ইবরাহিম রহ. সম্পর্কে শুনেছি, ‘তিনি কোথাও গেলে একমাস থাকতেন। সেখানে তিনি একপারা করে প্রতিদিন কুরআনের মশক করাতেন। প্রয়োজনীয় দ্বীনি তালিম দিতেন। কুরআনের মশক শেষ হলে সেখানে মাহফিলের আয়োজন হতো এবং তিনি কথা বলতেন। আমাদের উস্তাজরা বলেছেন, কারী ইবরাহিম রহ.-এর পা যেখানে পড়েছে আল্লাহ তায়ালা সে গ্রামকে দ্বীনের জন্য আবাদ করেছেন। সেখানে মাদরাসা-মসজিদ হয়েছে, আলেম-উলামা হয়েছে, মানুষের দ্বীনদারি বেড়েছে। উনাদের আবাদ করা ক্ষেত্রগুলো এখন আমরা ধরে রাখতে পারছি না।

এ বিষয়ে আরেকটি সাক্ষাৎকার পড়ৃন : যোগ্যতার বিচারে ওয়াজ করার বাধ্যবাধকতা থাকলে সুরের বাজার গরম হতো না : মাওলানা সাজিদুর রহমান

ইসলাম টাইমস : আমরা কেন পারছি না?

মুফতি হিফজুর রহমান : এক হলো অর্থচুক্তি। আমাদের আকাবিররা চুক্তি করে যেতেন না। এখন তো লক্ষাধিক টাকার চুক্তিও হয়। আমি বলছি না যে, ওয়াজ করে টাকা নেয়া নাজায়েয। তবে একজন বক্তাকে যখন নির্ধারিত পরিমাণ টাকার চুক্তি ছাড়া কোনো মাহফিলে নেয়া না যায় তবে তখন তার ব্যাপারে শ্রোতাদের আস্থার জায়গাটা কোথায় যায়? আমার মনে হয়, মানুষ তার ব্যাপারে হেদায়েতের আশা হারিয়ে ফেলে।

হাটহাজারী মাদরাসা প্রতিষ্ঠাতাদের একজন মাওলানা আবদুল হামিদ রহ. একটা কাপড়ের মধ্যে শুকনা খাবার নিয়ে বের হতেন এবং নিজের খেয়ে মসজিদে মসজিদে ঘুরে ঘুরে বয়ান করতেন। তার বয়ানে বহু মানুষ দ্বীনদার হয়েছে। আমরা টাকা নেব, কিন্তু তাই বলে এতো টাকা এবং এভাবে চুক্তি করে! এগুলো তো মানুষের চাঁদার টাকা। কষ্টের টাকা। অর্থলিপ্সু বক্তাদের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এবং তাদের কথার প্রভাব কমিয়ে দিচ্ছে।

এছাড়া নিজের আমলের দিকে খেয়াল না রাখা , কুরআন-হাদিসের বাইরে বেশি আলোচনা করা ইত্যাদি বিষয়গুলোও আলোচনার প্রভাব কমার ক্ষেত্রে কারণ হিসেবে কাজ করছে।

পূর্ববর্তি সংবাদনির্বাচনের আগে গণফোরামে যোগ দিলেন ১০ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তা
পরবর্তি সংবাদবিএনপির যাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে তাদের কে কে নিরপরাধ? : ওবায়দুল কাদের