আবরার আবদুল্লাহ ।।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জোট-সংখ্যাতত্ত্ব এখন বেশ জনপ্রিয়। সংখ্যাতত্ত্বে জোটের পরিধি বড় করতে নীরব প্রতিযোগিতা রয়েছে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগের নিরবাচনগুলোর সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো জোটবদ্ধ আন্দোলন এবং সরকার গঠনে অন্যদলের সমর্থন নিলেও জোটবদ্ধ নির্বাচন করেনি।
২০০১ সালে জোটবদ্ধ নির্বাচন করে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। এই নির্বাচনে ব্যাপক সাফল্য পায় তারা। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ গঠন করে ১৪ দলীয় জোট। বিপরীতে বিএনপি জোটের পরিধি বাড়িয়ে গঠন করে ২০ দলীয় জোট। এভাবে বাড়তে থাকে উভয় জোটের পরিধি।
জোট-সংখ্যাতত্ত্বের কারণে নির্বাচনের আগে ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর গুরুত্ব বাড়ে। বড় দলগুলো মনে করে, ছোট দলের ভোট বেশি না থাকলেও জোটের আকার সাধারণ কর্মীদের উপর প্রভাব ফেলে।
জোট-সংখ্যাতত্ত্বের কারণে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে গুরুত্ব বেড়েছে ইসলামি ধারার দলগুলোরও। প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল তাদের জোটবদ্ধ করতে এখনও তৎপর। এ ক্ষেত্রে বিএনপির তুলনায় আওয়ামী লীগের আগ্রহটাই বেশি মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ। তাদের ভাষায়, আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করছেন, ‘ছোট ছোট ইসলামি দলগুলোকে আওয়ামী লীগের পক্ষে আনা গেলে দলটির ‘ধর্ম বিদ্বেষী’ বদনাম দূর হবে। এতে তাদের ভোট না বাড়লেও কমবে বিএনপির ভোট।
তবে লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, জোটে নিতে ঠিক যতোটা টানাটানি হচ্ছে ইসলামি দলগুলোকে নিয়ে, আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে চিত্রটা ঠিক বিপরীত। এখনও আসন বণ্টন নিয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি পায়নি তারা। সম্মানজনক আসন দেয়া হবে এমন আশ্বাসে সিদ্ধান্ত ঝুলিয়ে রেখেছে।
আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন তারা আসন বণ্টনে সংখ্যানুপাতিক হিসাবে যাবেন না। বরং বিজয়ের সম্ভাবনা দেখেই মনোনয়ন দেবেন। প্রধানমন্ত্রীর এমন ঘোষণায় চাপা হতাশা তৈরি হয়েছে ছোট ছোট দলগুলোর মধ্যে।
অন্যদিকে বিএনপি সম্ভাবনার বিষয়টি খুব বড় করে না বললেও তারাও যে আসন বণ্টনে খুব বেশি উদার হবে না সেটা গণমাধ্যমের বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যাচ্ছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জয়ের সম্ভাবনা সামনে রেখে শরিকদের সঙ্গে কথা বলেই আসন বণ্টন চূড়ান্ত করবে তারা।
আসন বণ্টন নিয়ে প্রধান দুই দলের অস্পষ্টতায় ইতোমধ্যে হতাশার ছাপ দেখা যাচ্ছে ইসলামি ধারার জোটবদ্ধ দলগুলোর মধ্যে। তাদের কেউ জোট ছেড়েছে আবার কেউ জোট ছাড়বে বলে হুমকি দিচ্ছেন। আবার কেউ মনোক্ষুণ্ন হয়েও থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
নির্বাচনের বেশ আগ থেকে ইসলামী ঐক্যজোট মহাজোটের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে নির্বাচন করবে শোনা গেলেও তারা এর মধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে ৬০ আসনে একক নির্বাচন করবে। তাদের একক নির্বাচনের সিদ্ধান্তের পেছনে প্রত্যাশা-প্রাপ্তির ফারাকটাকেই কারণ মনে করছেন অনেকে।
তবে দলের নেতাদের দাবি দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সামনে রেখেই তারা একক নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
বিএনপির শরিক খেলাফত মজলিস জানায়, বিএনপির আচরণে বিরক্ত তাদের কর্মীরা এবং তারা একক নির্বাচনের প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছেন।
এরশাদের নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত জোটের মাধ্যম মহাজোটের শরিক বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। আসন বণ্টন বিষয়ে মনোকষ্ট রয়েছে তাদের। এরশাদের কাছে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের প্রাথমিক দাবি ছিল ৬০ আসন। কিন্তু এরশাদ মহাজোটের সঙ্গে মিলে নির্বাচন করার ঘোষণা দেয়ার পর তারা ১০ আসনে মহাজোটের মনোনয়ন দাবি করেন। কিন্তু তাতেও রাজি হচ্ছে না মহাজোট।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের একজন যুগ্ম মহাসচিব নাম না প্রকাশের শর্তে বলেছেন, ‘আমরা এখন চাচ্ছি ৪-৫টি আসন আর আমাদের দিতে যাচ্ছে ২-৩টি আসন।’
এই নেতা আরও জানান, ২-৩টি আসন পেলেও তারা জোট ছাড়বেন না। কারণ হিসেবে বলেন, ‘একটি জোট করেছি তা টিকিয়ে রাখতে হবে। জোট ছেড়েও বা কি লাভ?’
অন্যদিকে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক ইসলামি দলগুলোকে এক আসনে ইসলামি দলের এক প্রার্থী নীতি অনুসরণের আহবান জানিয়েছেন।
একইভাবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের একজন আলেম নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার আসনটির প্রাপ্তি নিয়েও তৈরি হয়েছে সংশয়।
সব মিলিয়ে জোটবদ্ধ দলগুলো এখনও এক প্রকার হতাশা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে।
চট্টগ্রাম ওমর গণি এম এস ডিগ্রি কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ফ ম খালিদ হোসাইন মনে করেন, ‘ইসলামি দলগুলোর অবমূল্যায়নের দিকগুলো এখন স্পষ্ট। শেষ পর্যন্ত কোনো জোটই ইসলামি দলগুলোকে খুব বেশি মূল্যায়ন করবে না। কারণ, এই দলগুলোর কাছে প্রতিটি আসনের মাঠ পর্যায়ের খবর আছে। বিশেষত সরকারি দলের কাছে তো আছেই। তাই সাংগঠনিক ভিত মজবুত না করলে মূল্যায়ন আশা করা যায় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এভাবে জোট ও নির্বাচন করে ইসলামি দলগুলো ইসলাম ও নিজেদের স্বার্থ কোনোটাই রক্ষা করতে পারবে না। হ্যা, তবে ব্যক্তি বিশেষের স্বার্থ রক্ষা হতে পারে। আমার মনে হয়, ইসলামি দলগুলো একটা নিজস্ব প্লাটফর্ম গড়ে তুলতে পারলে তারা ক্ষমতার প্রশ্নে ফ্যাক্ট হয়ে উঠতে পারবে।’
ড. আ ফ ম খালিদ হোসাইন উদাহরণ টেনে বলেন, ‘মালয়েশিয়ার ইসলামি দলগুলো কোনো বড় দলের সঙ্গে জোট না করে নিজেরা জোটবদ্ধ হয়েছে। এতে সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে তাদের অবস্থান আগের তুলনায় ভালো হয়েছে।’
তিনি মনে করেন, ইসলামি দলগুলো চাইলে এখনও পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে একটি নির্বাচনী সমঝোতা হতে পারে।
দৃষ্টিভঙ্গি ও রুচির মিল-অমিল, নেতৃত্ব ইত্যাদি প্রশ্নের কারণে বারবার ব্যহত হয়েছে ইসলামি দলগুলোর ঐক্যপ্রক্রিয়া। জাতীয় স্বার্থে এবার কি এসব উপেক্ষা করা সম্ভব হবে ইসলামি দলগুলোর পক্ষে?
রাজনীতিবিদরা আশা করছেন দুয়েক দিনের মধ্যেই হয়তো অস্পষ্টতা কেটে যাবে এবং সবাই প্রাপ্যের বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারবে।
