তাবলিগ জামাত : এক নিঃশব্দ আন্দোলন

ইসলাম টাইমস ডেস্ক : গত রবিবার (১৮ নভেম্বর) পাকিস্তানের লাহোর শহরের পাশে রায়বেন্ড এলাকায় তাবলিগ জামাতের আলমি শুরার আমির হাজি আবদুল ওয়াহহাব রহ.-এর জানাজায় পাকিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চল এবং পাকিস্তানের বাইরে থেকেও হাজারো ধর্মপ্রাণ মানুষ শরিক হয়েছিলেন।

হাজি আবদুল ওয়াহহাব দীর্ঘদিন রোগশয্যার পর লাহোরের একটি হাসপাতালে ৯৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।

হাজি আবদুল ওয়াহহাব রহ.-এর জানাজায় শরিক হওয়ার জন্য এত বেশি লোক সমাগম হয়েছিল, যার দরুণ পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা পিআইএ-কে করাচি থেকে লাহোর পর্যন্ত কয়েকটি আলাদা বিমানের ব্যবস্থা করতে হয়।

হাজি আবদুল ওয়াহহাবের দীর্ঘদিনের সহকর্মী পাকিস্তান কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস-এর পরিচালক ড. খালিদ মাসউদ গুন্দল বলেন, হাজি আবদুল ওয়াহহাবের জানাজায় সারা দুনিয়া থেকে উলামায়ে কেরাম এবং তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা শরিক হয়েছিলেন। তবে অনেকেই দূর দূরান্ত থেকে রওনা হয়েও রাস্তায় অসুবিধার কারণে জানাজায় শরিক হতে পারেননি।

তিনি আরও বলেন, হাজি আবদুল ওয়াহহাব তার সারা জীবন তাবলিগের জন্য বিলিয়ে দিয়েছিলেন। আনুমানিক ৭০ বছর ধরে তিনি নিরলসভাবে তাবলিগের কাজে আত্মনিয়োগ করে ছিলেন।

কী এই তাবলিগ জামাত?

তাবলিগ-এর শাব্দিক অর্থ অন্যকে দ্বীনের দিকে দাওয়াত দেয়া, আহ্বান করা।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়,  ১৯২৬ বা ১৯২৭ সালের দিকে হিন্দুস্তানের মাওলানা ইলিয়াস রহ. নামে একজন আলেম সর্বপ্রথম তাবলিগের এ কাজ শুরু করেন।

মাওলানা ইলিয়াস রহ. প্রথমে এ কাজ দিল্লি থেকে আরম্ভ করেন। দিল্লির মেওয়াতে তিনি একটি ইসলামি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দাওয়াতি কার্যক্রম শুরু করেন। কিন্তু কিছুদিন পর তিনি অনুধাবন করলেন, এই শিক্ষার মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মপ্রচার হচ্ছে ঠিকই কিন্তু দ্বীনের মুবাল্লিগ তৈরি হচ্ছে না, যারা অন্যদের কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেবে।

এই চিন্তা থেকে তিনি তার কর্মপদ্ধতি পরিবর্তন করে তাবলিগের কার্যক্রম শুরু করেন এবং দিল্লির নিকটবর্তী নিজামুদ্দিন এলাকায় তাবলিগের কাজ চালু করেন।

যদ্দুর জানা যায়, তাবলিগ জামাতের প্রথম ইজতেমা ১৯৪১ সালে হিন্দুস্তানে অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালের ভারতভাগের পর তাবলিগের কাজ পাকিস্তান ও বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়ে এবং একসময় ধীরে ধীরে তা সারা বিশ্বেই প্রসার লাভ করে। বর্তমানে পাকিস্তান ও বাংলাদেশে তাবলিগের এ কাজ সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়ে আসছে।

ইন্টারনেটের তথ্য মোতাবেক পৃথিবীর প্রায় ২০০টি দেশে তাবলিগের কাজ চলমান এবং বিশ্বের প্রায় আট থেকে দশ কোটি মানুষ সরাসরি এই দাওয়াতি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সে হিসেবে, তাবলিগের এই অসাংগঠনিক দলটিই বিশ্বে মুসলিমদের সবচে বড় সংগঠন।

তাবলিগ জামাতের সবচে বড় ইজতেমা প্রতিবছর বাংলাদেশে হয়ে থাকে। এছাড়া পাকিস্তানের রায়বেন্ডেও বার্ষিক ইজতেমাতেও লাখ লাখ মানুষ অংশগ্রহণ করে থাকেন।

তাবলিগের কাজ কীভাবে চলে?

তাবলিগের এই আন্দোলন ইসলামের ছয়টি উসুলের ওপর ভিত্তি করে দাওয়াত দিয়ে থাকে: কালেমা, নামাজ, ইলম ও জিকির, একরামুল মুসলিমিনি (মুসলিমদের সম্মান ও সাহায্য করা), শুদ্ধ নিয়ত ও তাবলিগ।

তাবলিগের সঙ্গে সম্পৃক্ত লোকদের বর্ণনামতে, এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য হলো পৃথিবীর সকল মুসলমান যেন আল্লাহর হুকুম এবং নবির তরিকামতে জীবন যাপন শিখতে পারে।

সাধারণ মানুষকে তাবলিগের কাজ শেখানোর জন্য তাবলিগ জামাতের নির্দিষ্ট কিছু কর্মসূচি রয়েছে। যেমন প্রাথমিকভাবে কাউকে তিনদিন তাবলিগ জামাতের সঙ্গে বের হতে হয়। পরবর্তীতে চল্লিশ দিনের চিল্লা এবং পরে চার মাসের তিন চিল্লা পূরণ করতে হয়। অনেকে এক বছরের জন্য দেশের বাইরে কিংবা দেশের ভেতরেও সময় লাগিয়ে থাকেন।

তাবলিগ জামাত সাধারণত সুন্নি মতানুসারে পরিচালিত হয়ে থাকে। তবে এ কাজে অন্যান্য মতের মানুষও শরিক হয়ে থাকেন।

এই আন্দোলনের লোকদের দাবি অনুযায়ী, তাবলিগ জামাত সম্পূর্ণ রাজনীতি এবং দল-মত মুক্ত একটি আন্দোলন। তাবলিগের এই কাজে স্বাভাবিকভাবে যে কোনো দল বা মত নিয়ে মতানৈক্য সযত্নে এড়িয়ে চলা হয়।

তাবলিগে এসেছেন খেলোয়াড়, শিল্পী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা

পাকিস্তানে স্বাভাবিকভাবে সব শ্রেণি-পেশার মানুষই তাবলিগের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে এদের মধ্যে প্রতিরক্ষা বাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ডাক্তার এবং সচিব পর্যায়ের ব্যক্তিও রয়েছেন। এছাড়াও শিল্পী ও ক্রীড়াজগতের অনেক তারকা এ কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।

পাকিস্তান ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অনেক খেলোয়াড় তাবলিগ জামাতের সঙ্গে যুক্ত আছেন। তাদের মধ্যে সাঈদ আনোয়ার, মুহাম্মদ ইউসুফ, ইনজামামুল হক এবং সাকলায়েন মুশতাক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

এই আন্দোলেনে যুবকদের অংশগ্রহণও উল্লেখ করার মতো একটি বিষয়। পাকিস্তানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে বেশ জোরে শোরে তাবলিগের কাজ হয়ে থাকে।

অধিকাংশ মানুষ তাবলিগকে একটি নিঃশব্দ আন্দোলন বলে অভিহিত করে থাকেন। তারা বলেন, এই একটি জামাত যারা মানুষের কাছে কোনো বিনিময় চাওয়া ছাড়া নিঃস্বার্থভাবে মানুষকে আল্লাহ এবং ইসলামের পথে আহ্বানের চেষ্টায় কাজ করে যাচ্ছে। আর তাদের সফলতার বড় কারণও সম্ভবত এটাই।

(ঈষৎ সংক্ষেপিত/বিবিসি উর্দু)

পূর্ববর্তি সংবাদযশোর বিএনপির এমপি প্রার্থীর লাশ উদ্ধার
পরবর্তি সংবাদ ২ ফেব্রুয়ারি শুরু হতে যাচ্ছে ২০১৯ সনের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা