ড. রমেশ কুমার ভানকুয়ানী ।।
ড. রমেশ কুমার ভানকুয়ানী পাকিস্তানের হিন্দু ধর্মালম্বী একজন পার্লামেন্ট সদস্য। ১২ রবিউল আউয়াল বুধবার পাকিস্তানের বহুল প্রচারিত জং পত্রিকায় তার একটি কলাম প্রকাশিত হয়। কলামটি অনেকের দৃষ্টি কাড়ে। ইসলাম টাইমস –এর পাঠকদের জন্যে কলামটির অনুবাদ-সংক্ষেপ প্রকাশ করা হল।
বার-রবিউল আউয়াল উপলক্ষে আমার এই কলাম সেই মহান সত্তার সমীপে নযরানা যিনি সারা জাহানের জন্য আগাগোড়া এক রহমত। সমগ্র মানবজাতির জন্য যার গোটা জীবনজুড়ে রয়েছে এত শিক্ষা ও আদর্শ যে, যুগ যুগ ধরে দুনিয়া জুড়ে বড় বড় সব মনীষী তার প্রশংসা করেছেন।
আমি মনে করি, তিনি তাঁর কথা ও কাজের মধ্য দিয়ে প্রমান করেছেন যে, মানুষ সবাই সমান। আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বো্ত্তম যার কাজ সবচেয়ে উত্তম।
মক্কাবাসী তাকে কত কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু তিনি যখন বিজয়ীবেশে মক্কায় প্রবেশ করলেন সবার জন্যে তিনি সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিলেন। এভাবে সকলের মন জয় করে নিলেন।
তায়েফের লোকেরা তাকে পাথর মেরে রক্তাক্ত করেছে। ফেরেশতা এসে বললেন, আপনি তাদের জন্যে বদ দোয়া করুন। তাদেরকে ধ্বংস করে দেওয়া হবে। তিনি তাদের জন্যে মঙ্গলের দোয়া করলেন।
এক বুড়ি তাঁর চলার পথে কাঁটা বিছাত। যখন বুড়ি অসুস্থ হয়ে পড়ল, তিনি গেলেন তার সেবা করার জন্যে।
বদর যুদ্ধের বন্দীদের সাথে তিনি কত না দয়ার আচরণ করেছেন! শুধু মদীনার শিশুদেরকে লেখাপড়া শেখানোর বিনিময়ে তিনি তাদের অনেককে মুক্তি দিয়ে দিলেন।
তিনি পশুপাখির সাথে সদয় ব্যবহার করতে বলতেন। তাদেরকে কষ্ট দিতে নিষেধ করতেন।
শয়তান মনুষকে প্রতিশোধ নিতে প্ররোচিত করে। কিন্তু তিনি মানুষকে রাগ হজম করতে ও ক্ষমাসুন্দর আচরণ করতে বলতেন। তিনি বলেছেন, একজন পূর্ণ মুসলিম সে-ই যার হাত ও মুখ থেকে অপর ভাই নিরাপদ থাকে।
তিনি দুর্বল অসহায় লোকদের সাহায্য করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করতেন। তার শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু ছিল মানুষকে মুক্তির পথ দেখানো। তিনি গোটা জীবন মানুষের মাঝে কল্যাণের শিক্ষা প্রচার করার জন্যে ব্যয় করেছেন।
তিনি বিদায় হজ্জের ভাষণে যে শিক্ষা দিয়েছেন তা সোনার হরফে লিখে রাখার মতো। তিনি বলেছেন, কোনো আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই অনারবের উপর। কোনো শ্বেতাঙ্গের শ্রেষ্ঠত্ব নেই কৃষ্ণাঙ্গের উপর। তোমরা সবাই আদমের সন্তান। আর আদম মাটির তৈরি।
তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, শ্রেষ্ঠত্ব হয় কাজের মাধ্যমে, বংশের মাধ্যমে নয়। তিনি সামাজিক বিভিন্ন মন্দ আচার সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, তোমাদের সবাইকে একদিন খোদার সামনে হাজির হতে হবে। এবং নিজ নিজ কাজের জন্যে জবাব দিতে হবে। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের কাজের জন্যে দায়িত্বশীল।
তিনি তার বিদায় হজ্বের বক্তব্যে সুদকে চিরতরে হারাম ঘোষণা করেছেন।
তাঁর মদীনায় আগমনকালে সেখানে বিভিন্ন গোত্রের বসবাস ছিল। তিনি সকলের মাঝে ঐক্যসাধনের জন্যে মদীনা সনদ নামে একটি শান্তি চুক্তি করেন, মানব ইতিহাসে যার কোনো নজির নেই।
আমি মনে করি, এই শান্তিচুক্তি আজও বাস্তবায়ন হতে পারে। সেই চুক্তিতে তিনি মুসলিম দেশে বসবাসকারী অমুসলিমদেরকে নাগরিক অধিকার প্রদানের নিশ্চয়তা প্রদান করেছিলেন। বহি:শত্রুদের হামলার মোকাবেলায় সকলে ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।
তিনি অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে ভিন্নধর্মাবলম্বীকে নিজ ধর্ম পালনে স্বাধীনতা দিতেন।
আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি পাকিস্তানও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইসলামের নামে। কায়েদে আযম তার বক্তৃতা বিবৃতিতে এ বিষয়টা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্যেই মূলত পাকিস্তানের অস্তিত্ব। কিন্তু আফসোস, আজ পাকিস্তানের জন্মের সত্তর বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে, এখনো এখানে রাজনীতির নামে জ্বালাও পোড়াও চলে।
যেখানে ইসলামের নবী রাস্তা থেকে কাঁটা দূর করতে বলেছেন, সেখানে এখন রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। ইসলামের নবীর নির্দেশ, যুদ্ধের ময়দানেও যেন নারী ও শিশুর কোনো ক্ষাতি না হয়। কিন্তু এখন এখানে সাধারণ অবস্থাতেও কাউকে রেহাই দেওয়া হয় না।
তিনি ধোঁকা, চোরাকারবারি, মজুতদারি, সুদ ইত্যাদি থেকে বারণ করেছেন, কিন্তু আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়ছে সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, ধোঁকাবাজি, চোরাকারবারি। ইসলামী দেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপদ থাকার কথা কিন্তু আজ পাকিস্তানে দুর্বল অমুসলিম সংখ্যালঘুদেরকে উপর হামলা হচ্ছে।
বারই রবিউল আউয়ালের এই মোবরক দিনে আমি সবার কাছে দরখাস্ত করব, আসুন আমরা ইসলামের নবীর শিক্ষা মনে প্রাণে কবুল করে নিই।
সবশেষে আমি নবীর শানে রচিত এক হিন্দু কবির কবিতা দিয়ে আমার লেখা শেষ করছি –
তুমি আমার হৃদয়ের স্পন্দন, আমার চোখের আলো
তুমিই অসহায়ের সহায়, তুমি খোদার প্রিয়
আমাদেরকে তুমি পর মনে করে দূরে ঠেলে দিও না
তুমি যেমন তাদের নবী, তেমনি তুমি আমাদেরও নবী
তুমি মানুষকে ভালোবাসার সবক শিখিয়েছ
তুমি দুনিয়ায় পবিত্র ধর্ম প্রচার করেছ।
তুমিই নদী, তুমি সাগর, তুমিই কিশতী, তুমি নাবিক
তুমিই আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
অনুবাদ: এনাম হাসান
