জোটবদ্ধ নির্বাচনে আদর্শহীনতার চেহারাটা প্রকট হয়ে ওঠে : মুফতি আবুল হাসান আবদুল্লাহ

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। এ নির্বাচনে লড়ার জন্য বড় দুটি দল জোট গড়ে তুলেছে। দিন দিন বড় হচ্ছে সেসব জোটের পরিসর। তৈরি হচ্ছে ডান-বামের নানা মাত্রিক মেরুকরণ। অনেক ক্ষেত্রে আদর্শ ও নীতির সব রকম সীমানাও মুছে যাচ্ছে। জোটবদ্ধ নির্বাচন ও রাজনীতির এই আদর্শ-শূন্যতা নিয়ে মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা-র রঈস, মাসিক আলকাউসার সম্পাদক মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহর সঙ্গে ইসলাম টাইমসের পক্ষ থেকে কথা বলেছেন শরীফ মুহাম্মদ 

ইসলাম টাইমস : জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। বড় দুটি দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি জোট বেঁধে নির্বাচনে নেমেছে। জোটের পরিধি বড় করার চেষ্টাও করছে দলদুটি। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

মুফতি আবুল হাসান আবদুল্লাহ : ভিন্ন ভিন্ন দল থাকা সত্ত্বেও জোটের প্রশ্নটি আসে আদর্শহীনতা থেকে। রাজনীতিকে বলা হয় রাজার নীতি। নীতি ও আদর্শ লালন করা রাজনীতিকদের দায়িত্ব। প্রতিটি দল পৃথক পৃথক নীতি-আদর্শ প্রচার করে। দলগুলো একে অন্যের চেয়ে স্বতন্ত্র থাকে। জোট করার সময় কয়েকটি দল যখন একসঙ্গে হয়ে যায়- তখন আদর্শের সীমারেখা মুছে যায়। আদর্শহীনতার প্রশ্নটিই বড় হয়ে সামনে আসে। জোট করার অর্থ যদি হয় ভিন্ন ভিন্ন দলের একসঙ্গে মিশে যাওয়া তাহলে একটি দল এবং একটি আদর্শের মধ্যেই তো তারা চলে আসতে পারে।

আপনি লক্ষ করলে দেখবেন, জোট প্রবণতার চর্চাটা বেশি হয় এই উপমহাদেশে। এটা মূলত আদর্শ থেকে সরে যাওয়া ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির একটি উদাহরণ। ক্ষমতার সিঁড়ি পাওয়ার জন্যই এসব জোট করা হয়। প্রতিটি দলের পরিচয় ভিন্ন, কিন্তু জোটে এসে তারা মিশে যায় ক্ষমতাকে টার্গেট করে।

ইসলাম টাইমস : জোটের রাজনীতিতে আদর্শহীনতার বিষয়টি বড় হয়ে আসে- কথাটিকে আরেকটু ব্যাখ্যা করবেন?

মুফতি আবুল হাসান আবদুল্লাহ : স্বাধীনতার পর ক্ষমতাসীন বড় দল ছিল আওয়ামী লীগ। তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতি আছে। যেমন : ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি । স্বাধীনতার পর পর ওই বড় দলের শক্ত প্রতিপক্ষ ছিল জাসদসহ কয়েকটি বামদল। একসময় বামেরা দুর্বল হয়ে যায়। ৭৫-এর বিয়োগান্তক পট পরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। ওই দলেরও নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতি সামনে আসে। ধর্মীয় দল ও গোষ্ঠীর প্রতি নরম আচরণ, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, বহুদলীয় গণতন্ত্র ইত্যাদি। বহু বছর পর্যন্ত এ দুটি দলই মুখোমুখি চলে এসেছে। দুটি ধারা ও মূলনীতি তারা বহন করেছে। জনগণও তাদের ওভাবেই দেখে এসেছে। মাঝে এরশাদ এসেছেন। জাতীয় পার্টি গঠন করেছেন। তার দলের সুনির্দিষ্ট কোনো নীতি বা আদর্শের কথা সামনে আসেনি। ক্ষমতার জন্য যখন যেমন চলা যায়- তারা চলেছেন। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনের পেছনে ছুটেছেন।

দেখুন, বিগত কয়েকটি নির্বাচনে আপনি বড় দুটি দলের মধ্যে জোট নির্ভর নির্বাচন ও রাজনীতির একটি অনুশীলন দেখবেন। এতেই কিছু আদর্শিক বৈপরীত্ব চোখে পড়তে থাকে। একসময় আওয়ামী লীগের ঘোর সমালোচক ও প্রতিপক্ষ ছিল যেসব বামদল তারাও আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়। কিন্তু জোটবদ্ধ হওয়ার পর একসময়ের প্রতিপক্ষ কোনো দলই ঘোষণা করে না যে, আমাদের আগের অবস্থান ভুল ছিল। বড় দলও বলে না, জোটে আসা ছোট দলগুলোও তাদের আগের দূরত্ব সম্পর্কে কোনো ব্যাখ্যা দেয় না। বরং ক্ষমতাকে টার্গেট করে যে যার জায়গায় থেকেই জোটবদ্ধ হয়। এখানেই নীতি ও আদর্শের প্রশ্নটা শূন্য হয়ে যায়। একই অবস্থা বিএনপি ও তার সঙ্গে জোটবদ্ধ দলগুলির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ভিন্ন ভিন্ন আদর্শ ও নীতি ধারণ, পরস্পর বিরোধিতার অতীত নিয়ে তারা কেউ কোনো ব্যাখ্যা দেয় না। তাদের নীতি ও আদর্শটাও যে এখন কাছাকাছি হয়ে গেছে- এমন কোনো অবস্থানের কথাও তারা জানায় না। ফলে সেখানেও ক্ষমতার জন্য আদর্শের প্রশ্নটি স্থগিত হয়ে যায়।

ইসলাম টাইমস : আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষে তো জোটবদ্ধ নির্বাচন ও রাজনীতির পরিস্থিতি আরও চরমে পৌঁছেছে। এবারের জোটবদ্ধতা সম্পর্কে কিছু বলবেন?

মুফতি আবুল হাসান আবদুল্লাহ : এবারের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যেসব জোটবদ্ধতার খবর এসেছে, তাতে আদর্শহীনতা ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির চেহারাটা আরও বেশি প্রকট হয়েছে। এক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর কথাই ধরুন। বিএনপি প্রতিষ্ঠাকালে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে ছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগের বিপরীতে বিএনপির রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শের কথা তিনি সবচেয়ে উঁচু স্বরে বলেছেন। যুক্তি-তর্ক দিয়ে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের নীতি ও রাজনীতির বিরুদ্ধে জোরালো ভাষায় কথা বলেছেন। সংসদের বাইরেও বলেছেন। তিনি যে পর্যায় ও মাত্রায় আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেছেন, বিএনপির অন্য কেউ তা করতে পারেনি।

এমনকি ২০১৪ সনের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে বিএনপি সরকারের যেটুকু সমালোচনা করতে পারেনি, মিছিল-মিটিং করতে পারেনি, বি চোধুরী সাহেব সে সময়েও ঘরোয়া বিভিন্ন প্রোগ্রামে কঠোর ভাষায় সরকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরেছেন। বৈঠক করেছেন। সরকারের বিরুদ্ধে জোটের উদ্যোগ নিয়েছেন। এখন দেখতে পাচ্ছি, তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বেঁধেছেন এবং ২৪/২৫টার মতো আসনে মনোনয়ন চেয়েছেন।

এই যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তিনি জোট বাঁধছেন, তিনি কি এখন পেছনের আওয়ামী লীগ বিরোধী সব বক্তব্যকে ভুল বলছেন? এখানে তো একটি পক্ষের অন্তত বলার কথা, আমরা এতদিন যা বলেছি, ভুল বলেছি। অথবা বড় দলটির বলার কথা, আমরা আগে যে ভুল করেছিলাম, সেগুলো থেকে সরে এসেছি। কিন্তু কেউ তার অবস্থান বদলের স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন না, অথচ জোটবেঁধে একসাথে হচ্ছেন। এটাই তো নীতি ও আদর্শের জায়গাটাকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।

ইসলাম টাইমস : একই কথা তো ভিন্ন জোটের ক্ষেত্রেও খাটে। বিএনপি আর ড. কামালের জোটবদ্ধ হওয়া- এখানেও তো আমরা এমন কিছু দেখছি না?

মুফতি আবুল হাসান আবদুল্লাহ : অবশ্যই, একই রকম চিত্র দেখা যাচ্ছে এক্ষেত্রেও। ড. কামাল তো আগাগোড়া আওয়ামী লীগের নীতি-আদর্শ ধারণকারী মানুষ। ধর্মনিরপেক্ষতাপন্থী, বামঘরানার লোক হিসেবে পরিচিত। আওয়ামী লীগের হয়ে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও করেছেন। আজ বিএনপি যে তার সঙ্গে জোটবদ্ধ হলো, কোন আদর্শের ভিত্তিতে হলো? গণফোরাম, নাগরিক ঐক্যের লোকদের নিয়ে ক্ষমতায় গেলে বিএনপি কোন আদর্শের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করবে? জিয়ার রেখে যাওয়া নীতি অনুযায়ী না কি ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি অনুযায়ী? এসব জোটের শেষ কথা কি শুধুই ক্ষমতা? ক্ষমতাকেন্দ্রিক ছুটে চলা? যদি তা-ই হয় তাহলে এসব জোট থেকে জনগণ বা ভোটারদের প্রাপ্তিটা কী?

ইসলাম টাইমস : জোটবদ্ধ রাজনীতি ও নির্বাচনের এই বৈপরীত্ব ও আদর্শিক শূন্যতা থেকে উত্তরণের উপায় কী?

মুফতি আবুল হাসান আবদুল্লাহ : যে কোনো দলের এককভাবে নির্বাচনে যাওয়া। ভোটের পর অবশ্য মিলতে পারে। সুনির্দিষ্ট শর্ত ও পয়েন্টে জোটও গড়তে পারে। ভোট করা দরকার নিজ দলের আদর্শ ও নীতি সামনে নিয়েই। ইনু-মেনন সাহেবরা জোটবদ্ধ রাজনীতির কারণে যেসব আসন থেকে পাস করে আসেন ওইসব এলাকার ভোটাররা বামপন্থাকে ভোট দেন না। ভোট দেন বড় দলের মার্কায়। কিন্তু এতে একটা ভুল বার্তা তৈরি হয় যে বামপন্থীরাও এ দেশে ভোটে পাস করে। অথচ বাস্তবতা এমন নয়। তারা ভোটের আগে নাহিদ সাহেবের মতো হয়ে যাক- এ সংকট থাকবে না তখন। নাহিদ সাহেব যেমন সিপিবি ছেড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগে চলে এসেছেন। এসব কারণেই আদর্শের শূন্যতাও তৈরি হয়, আদর্শের গোঁজামিলেরও সৃষ্টি হয়।

ইসলাম টাইমস : নির্বাচনের আগে জোট তো করা হয় বিজয়ের জন্যই। সেক্ষেত্রে একক নির্বাচনে তো বিজয় হাতছাড়া হয়ে যাবে…?

মুফতি আবুল হাসান আবদুল্লাহ : এ জন্যই তো এসব জোটবদ্ধ নির্বাচনে আদর্শিক কোনো ফলাফল পাওয়া যায় না। একেক জায়গায় এমন একেকজন পাস করে এসে যায়- ভোটাররা যাকে তার আদর্শের জন্য, নীতির জন্য ভোট দেয়নি। নৌকা প্রতীক নিয়ে একজন বাম রাজনীতিক সংসদে চলে আসেন। আর বলাবলি হয় বামরাজনীতিক জনগণের ভোটে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। বাস্তবে ব্যাপারটা তো এমন নয়। উল্টোভাবে দেখুন, ধানের শীষ নিয়ে একটি লোক নির্বাচন করল, ইসলামপ্রিয় বহু মানুষ তাকে ভোট দেওয়ায় সে পাস করল। বলা হতে থাকল, ওই এলাকায় বিএনপির এত ভোট। বাস্তবে এমন নয়। যদি প্রত্যেক দল আলাদা নির্বাচন করত, তাহলে যার ভোট সে পেত এবং ভুল প্রতিনিধিত্বের হিসাব দাঁড়িয়ে যেত না।

ইসলাম টাইমস : নির্বাচনের আগে জোট ও আদর্শের শূন্যতার বিষয়টিকে এত বড় করে দেখছেন কেন?

মুফতি আবুল হাসান আবদুল্লাহ : আসলে সংসদ নির্বাচনে ব্যক্তির চেয়ে দলকে বড় করে দেখা হয়। দেখা হয় দলের নীতি-আদর্শ। স্থানীয় নির্বাচনে ব্যক্তির ইমেজটাই থাকে মুখ্য। যদিও এখন স্থানীয় নির্বাচনকেও দলীয় রাজনীতির ব্যানারে নিয়ে আসা হয়েছে এবং এখানেও একটা নীতি ও আদর্শগত জটিলতা তৈরি করা হয়েছে। তো জাতীয় নির্বাচনে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করলে কে কেন কত ভোট পেয়েছে- এ বিষয়টা অস্পষ্ট থেকে যায়। আর এতে বিভিন্ন জনের মধ্যে প্রাপ্ত ভোট নিয়ে আদর্শিক দাবি তৈরি হতে দেখা যায়। এটা তো ঠিক না।

ইসলাম টাইমস : জোটবদ্ধ নির্বাচনে তাহলে আদর্শ-শূন্যতার ক্ষেত্র তৈরি হয় এবং রাজনীতিতে আদর্শহীনতার পথ প্রশস্ত হয়?

মুফতি আবুল হাসান আবদুল্লাহ : একেবারেই সঠিক। হালের একটি উদাহরণ হলো, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বুধবার বলেছেন, বিএনপির অনেক নেতা আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। নেত্রী সবুজ সংকেত দিলেই তারা চলে আসবে। প্রশ্ন হলো, ওরা কেন আসবে? আওয়ামী লীগই বা তাদের কেন নেবে? এখানে কে কার আদর্শ গ্রহণ করবে? রাজনীতিতে ক্ষমতার লড়াইয়ে নীতি-আদর্শের জায়গাটা এত ঠুনকো হয়ে গেলে তো মুশকিল। চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মঞ্জুর আলমের কথাই ধরুন। আগে আওয়ামী লীগ করতেন, পরে বিএনপির সমর্থনে মেয়র হন। এখন আবার আওয়ামী লীগের টিকিটে সংসদ নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন। এখানে নীতি-আদর্শের বিষয়টি কোথায় থাকলো?

রাজনীতিকরা দেশ পরিচালনা করেন, নেতৃত্ব দেন। মানুষকে আদর্শ শেখান। এসব নীতিচ্যুত রাজনীতি থেকে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কী শিখবে? নীতি ও আদর্শের এই দেউলিয়াত্ব তো নতুন প্রজন্মের চিন্তায় নেতিবাচক প্রভাবই তৈরি করবে।

ইসলাম টাইমস : এবার তো ইসলামি ব্যক্তি ও দলগুলি বড় দুটি জোটের সাথে লেগে আছেন। এ ব্যাপারে কিছু মূল্যায়ন করবেন?

মুফতি আবুল হাসান আবদুল্লাহ : আরেকদিন ইনশাআল্লাহ। এ বিষয়টি একটি স্বতন্ত্র বিষয়। স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করা যাবে।

ইসলাম টাইমস : দীর্ঘ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক শুকরিয়া।

মুফতি আবুল হাসান আবদুল্লাহ : আপনাকে এবং ইসলাম টাইমসকেও অনেক শুকরিয়া।

পূর্ববর্তি সংবাদঅর্পিত দায়িত্ব পালন করবে সেনাবাহিনী : সেনাপ্রধান 
পরবর্তি সংবাদসিরাজদিখানে টেঁটাযুদ্ধে আহত ৩০