তেরো সন্তানের জননী তিনি। তবু ছেলেমেয়েদের সংসারে ঠাঁই হলো না বিধবা বৃদ্ধার। অবিবাহিত এক মেয়েকে নিয়ে প্রায় রাস্তায় এসে দাঁড়ানোর জোগাড় হয়েছিল।
কিন্তু মানবিকতা তো মুছে যায়নি। ফুরিয়ে যায়নি ভাল মানুষও। নব্বুইঊর্ধ্ব বৃদ্ধা বেলারানি দত্ত তাই নতুন ঘর পেয়েছেন। সাকিনা বিবির ঝুপড়িই এখন তাঁর ঠিকানা। আজ শুক্রবার (২৩ নভেম্বর) এমনই এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা।
পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথির খড়কি গ্রামের বাসিন্দা পঁচানব্বই ছুঁই ছুঁই বেলারানি দেবী। বৃদ্ধা জানিয়েছেন, স্বামীর মৃত্যুর পরে তিন ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে জমিজমার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে অশান্তি শুরু হয়। আর তার জেরেই বছর চারেক আগে ছেলে-বউমারা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন বলে বেলারানি দেবীর অভিযোগ। সেই সময় কাঁথির মহকুমা শাসকের কাছে নালিশ জানিয়েও কোনো সুরাহা হয়নি বলে বৃদ্ধার দাবি।
এর পর অবিবাহিত মেয়ে শোভারানিকে নিয়ে জুনপুটের রামপুরের কাছে বাড়ি ভাড়া নিয়ে চলে আসেন বেলারানি দেবী। শোভারানি পরিচারিকার কাজ করতেন। কোনো রকমে মা-মেয়ের চলে যেত। তবে বাদ সাধে শরীর। স্নায়ুর রোগে আক্রান্ত হন শোভারানি। আর পথ দুর্ঘটনায় হাত-পা ভাঙে বেলারানি দেবী। অর্থাভাবে বাড়ি ভাড়া মেটাতে পারেননি। বাড়ি ছাড়তে হয়। আর সেই সঙ্কটকালেই পাশে পান পূর্ব পরিচত ওই মুসলিম পরিবারকে।
কাঁথির উত্তর দারুয়ায় সাকিনা বিবির ঝুপড়ি ঘরেই এখন থাকেন বেলারানি এবং শোভা। সাকিনার স্বামী বাইরে থাকেন। পরিচারিকার কাজ করে, চারাগাছ বেচে বহু কষ্টে দিন গুজরান করেন তিনি। তবু সংসারে আরও দু’টো মানুষকে ঠাঁই দিতে দু’বার ভাবেননি তিনি। সাকিনা বলছিলেন, ‘মাসিমা (বেলারানিকে ওই সম্বোধনেই ডাকেন) আমার স্বামীর পূর্ব পরিচিত। ঠিকমতো খেতে পাচ্ছিলেন না। অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাই আমাদের বাড়িতে এনে রেখেছি।’
বেলারানি দেবী ও শোভাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার কথা অবশ্য মানছেন না তাঁর ছেলে, বৌমা, নাতি-নাতনিরা। এক পুত্রবধূ লক্ষ্মী দত্তের দাবি, ‘মাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়নি। উনি নিজেই মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা বহুবার ফিরিয়ে আনার জন্য গিয়েছি। কিন্তু উনি রাজি হননি।’
বৃদ্ধার এক নাতি মতিলাল দত্তের আবার অভিযোগ, ‘ওই মুসলিম পরিবারের লোকেরা ঠাকুমাকে নানাভাবে ভুল বোঝাচ্ছেন। তাদের বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে।’
কী উদ্দেশ্য তা খোলসা করেননি মতিলালরা। সাকিনা অবশ্য স্পষ্ট ভাবেই বলছেন, ‘মানবিকতার তাগিদেই যা করার করেছি। এর পিছনে অন্য কোনো কারণ নেই।’ গোটা বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের আশ্বাস দিয়েছেন জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইন্দ্রজিৎ বসু।
সাকিনার হাত দু’টো ধরে বসেছিলেন বেলারানি দেবী। চোখে জল। পাশে দাঁড়ানো শোভা বললেন, ‘দাদা-বৌদির সংসারে আমাদের জায়গা হয়নি। কিন্তু সাকিনা আশ্রয় দিয়েছেন। আমরা কৃতজ্ঞ।’ আর বেলারানি বলছেন, ‘সাকিনাই আমার সত্যিকারের মেয়ে।’
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা
