শরীফ মুহাম্মদ ।।
গত বছর ছিল প্রথম সফর। তখন সফরসঙ্গী ছিল তরুণ আলেম-লেখক সাদ আবদুল্লাহ মামুন। এবারো শীতের শুরুতে দাওয়াত এলো। ইসলাম টাইমসে নিমজ্জনের ভেতর সময় বের করা মুশকিল হবে। তাই প্রথমে বলেছিলাম, কিছু দিন পর দেখি।
এর মধ্যে তাশরীফের পরীক্ষার ছুটি হলো। দেড় দিনের জন্য অফিসেও একটু বিরতি নেওয়ার ব্যবস্থা দাঁড় করানো গেল। তাশরীফের আম্মাকে যখন বললাম, কখনো তো লঞ্চে সফর করোনি। এবার একটা সফরের সুযোগ । চলো, ঘুরে আসি। সেও দেখি তৈয়ার। ওই পাশে জানিয়ে দিলাম-আসছি ইনশাআল্লাহ, সপরিবারে।
পিরোজপুর শহরে নূরে মদীনা কমপ্লেক্সের ভেতরে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। ইমাম আবু হানিফা রহ. ইসলামী রিসার্চ একাডেমি, জামিয়াতুল আহসান দারুল উলূম, ইসলামী ক্যাডেট স্কুল আর বালিকা মাদারাসা। প্রিন্সিপাল হলেন মুফতি রাগিব আহসান। মাদরাসার নাযেমে তালীমাত মুফতী মাহমুদুল হাসান আশরাফী। এই মুফতি মাহমুদুল হাসানই দাওয়াত ও প্রোগ্রামের সমন্বয়টা করে থাকেন। চৌকান্না ও মৃদুভাষী তরুণ। ঝটপট ঢাকা-পিরোজপুরে লঞ্চের টিকিট বুকিং দিলেন এবং আমাকে জানিয়ে দিলেন। প্রিন্সিপাল সাহেব তখন দেশের বাইরে।
২৫ নভেম্বর দুপুরের পরপর বাসা থেকে বের হলাম।মিরপুর১২ থেকে সদরঘাট।অনিষ্পন্ন যানজট আর অশেষ খুড়াখুড়ির উন্নয়নের মধ্যে কয় ঘণ্টা যে লাগতে পারে-ধারণা নেই। তিন ঘণ্টা আগেই বের হলাম। হাতে অঢেল সময়।কিন্তু সদরঘাটের কাছাকাছি পৌঁছে দেখি সময়ে টান ধরেছে। কপালে চিকন ঘাম নিয়েই হাজির হলাম টার্মিনালে। ৬টার জায়গায় সন্ধ্যা ৭টায় লঞ্চ ছাড়বে।একটি ফ্যামিলি কেবিনে গিয়ে উঠলাম। হাম্মাম ও মাগরিবের নামাজ শেষে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম।
ঘণ্টা খানেক পর। বুড়িগঙ্গার কুচকুচে কালো পানির এলাকা পার। দু পাড়ের আলোর ঝলকানি কমে এলো। বারান্দায় বের হলাম আমরা। দিগন্ত শুধু পানির। দূরে আবছা গ্রামের ছবি। আকাশে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ, একটু ফ্যাকাসে। তবুও তো চাঁদ, চাঁদের আলো। তবুও তো নদীর বুক। তবুও তো চলমান লঞ্চ থেকে রাতের প্রকৃতি উপভোগের সুযোগ। বারবার আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করলাম।
এশার নামাজ পড়ে শুয়ে পড়লাম। উঠলাম রাত ১০টার পর। লঞ্চের বারান্দা তখন ফাঁকা। চেয়ারে বসে আছি। হালকা শীত। বাতাসের ঝাপটাটা অবশ্য কড়াই ছিল। তাশরীফের নানারকম প্রশ্ন, টুকটাক উত্তর আমার। আরেকজন তো চুপচাপ বসেই রইলেন। সময় ও প্রকৃতি যে তার ভালই লাগছে-বোঝা যাচ্ছে। মৃদু দুলুনি, পানিকাটার দৃশ্য আর আঁধার কেটে তরতর এগিয়ে যাওয়া। অনুভূতিতে অপূর্ব!
হঠাৎ হঠাৎ একটি-দুটি বড় লঞ্চ দূর থেকে কাছে আসছে। পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। চলমান বড় এক ভবনের মতো। কোনোটা উল্টো দিক থেকে, কোনোটা আমাদের দিক থেকেই। একটু দ্রুত গতিতে ছুটছে। পার হয়ে যাচ্ছে আমাদের।পানির উপর ভাসমান একেকটি বসতি। স্থিরতা, বিশ্রাম, চাঞ্চল্য, ছোটাছুটি। অভ্যস্ত চোখ ও বোধে হয়তো কিছুই না এসব। একটু অন্যভাবে পুরো ব্যাপারটা দেখলে বিস্ময় ও কৃতজ্ঞতায় মন ভরে যায়। পানির উপর চলমান বহু জীবনের একরাতের দাস্তান।
তাশরীফ ও তাশরীফের আম্মাকে নিয়ে এক ফাঁকে ডেকে নামলাম। শুয়ে-বসে থাকা মানুষের সারি ভেদ করে দাঁড়ালাম চায়ের দোকানটার সামনে। পিতা-পুত্রের হাতে চায়ের কাপ। এই রাতে, এই ভীড়ে অপরজন আর চা খাবেন না। ডেকের পেছন থেকে খাবারের হোটেলটা ঘুরিয়ে-দেখিয়ে আনলাম।হোটেলের খাবার প্রায় শেষ। বাসা থেকে আনা খিচুড়ি ছিল আমাদের সঙ্গে। হোটেলের খাবারটা চেখে দেখার সুযোগ পাইনি। হাঁটতে হাঁটতে আরেক তলায় গেলাম। চারদিক সুনসান। শুধু লঞ্চের ইঞ্জিনের শব্দ। শব্দ পানি কাটার ঢেউ ও তরঙ্গের।
মধ্য রাতের পর থেকে রুমে ঘুম নেমে এল। তাশরীফের উঠাবসা শেষ হতেই চায় না। শেষমেশ সে-ও শুয়ে পড়লো পাশে।
ফজরের পরের দৃশ্যটা আরো সুন্দর। গ্রামীণ নদীর প্রকৃতি। একদমই পাতলা কুয়াশা। ছোট ছোট ডিঙি, মাছ ধরার নৌকা, কচুরিপানা আর আকাশ-পানির মিতালি। একটু পরই সূর্য উঠতে শুরু করল। যেন নদীর ভেতর থেকে বড় একটি কুসুম ভেসে ভেসে উঠছে। আমরা দলবেঁধে বারান্দায় দাঁড়ালাম। শীত লাগছে, লাগুক। চোখ ভরে কুদরতের রঙ দেখব আজ।
হুলারহাটে নামতে হলো। তখন সকাল সাড়ে আট। পিরোজপুর শহরের যাত্রীরা এখানেই নামে। মুফতি মাহমুদকে নামতেই পেয়ে গেলাম। সেই হাসিমুখ-স্মিতভাষী মানুষ। অটো ঠিক করা ছিল। পনের মিনিটের মধ্যে তার বাসায়। হৃদয়বিছানো দস্তরখানের পর নূরে মদীনা ভবনে চলে এলাম আমি, সঙ্গে তাশরীফ। তাশরীফের আম্মা রয়ে গেলেন ওই বাসায়।
লেখালেখি, সাংবাদিকতা নিয়ে ছাত্রদের মাঝে তিনটি দরস দেওয়া আমার দায়িত্বে। আগে থেকে ঠিক করা ছিল। অন্যান্য ক্লাস আজ বন্ধ। সকাল ১০টা থেকে জোহর পর্যন্ত চলল, মাঝে একটু বিরতি দিয়ে। জোহরের পর আরেকটি দরস। শরীর-মনে সফরের ক্লান্তি ছিল না। সংক্ষিপ্ত সময় হাতে নিয়েই একেকটি আলোচনা শেষ হলো। লেখালেখির জন্য দরকারি কিছু টিপস, সাংবাদিকতার কিছু বিষয় ও মিশন আর বৈরী পরিবেশে টকশো বা মিশ্র সংলাপের প্রস্তুতি নিয়ে কিছু কথা বলার চেষ্টা করলাম। ঔৎসুক্য ছিল উপস্থিত ছাত্রদের মাঝে। ছিল স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া, জবাব, প্রশ্নোত্তর ও অভিব্যক্তি। জীবন্ত হয়ে উঠেছিল একেকটি মজলিস। ভালো লেগেছে। শিক্ষকদের মধ্যে তরুণ প্রায় সবাই। মুফতি মাহমুদুল হাসান, মুফতি ইদরীস, মুফতি আশেকে এলাহী, মুফতি ইমরান ছিলেন উপস্থিত।
লেখালেখি, সাহিত্য ও সাংবাদিকতা নিয়ে একটি-দুটি মজলিসে কতটুকু কী বলা যায়, কী করা যায়? এটি প্রাসঙ্গিক একটি প্রশ্ন। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, ঢাকার বাইরে দূর শহরেও অনেক প্রস্তুত পাত্র ও প্রাণ লুকিয়ে থাকে। একটু খোঁচা কিংবা উপলক্ষের অভাবে সেসব প্রাণে ঝিমুনি বাসা বাঁধে। তাদের মধ্যে সজাগ-সলতেটা জ্বালিয়ে দিয়ে এলে ছোটবড় কাজ হতে থাকে, বাড়তে থাকে। অনেক স্বপ্ন বীজ বুনতে শুরু করে। চিন্তার সূত্রটা, শব্দ-বাক্যের ধরনটা ধরিয়ে দিলে চলতে থাকার পথ তৈরি করে দিলে চলা শুরু করতে পারে অনেকেই। দুই বছর-তিন বছর পর দেখা যায়- সেসব মজলিসে বসে থাকা নিঃশব্দ ছেলেটিই তার কাজ নিয়ে মুখর হয়ে উঠেছে, ঢাকার বাইরে এবং ঢাকায়। সেজন্যই সুযোগ ও উপযোগিতা দেখলে দু-এক ঘণ্টার লেখালেখি মজলিস বা কর্মশালায় আমি বড় আশা নিয়ে উপস্থিত হওয়ার চেষ্টা করি। ইসলামকে বিষয় হিসেবে গ্রহণ করে লেখা ও সাংবাদিকতা চর্চার জন্য আমাদের তো অনেক অনেক মন ও মেধা দরকার। অনেক অনেক হাত ও কলম দরকার।
ফিরতি লঞ্চ বিকেল পাঁচটায়। ফেরীঘাট থেকে উঠতে হবে। নিজেরা আসরের নামাজ পড়ে চারটার আগেই উঠে পড়লাম অটোতে। শহরে এক চক্কর। ছোট্ট শহর পিরোজপুর। গ্রামের মতো। গাছগাছালি আর খাল। মফস্বলের ভবন-বাসা, দোকানপাট। মুফতি মাহমুদ জানালো, দর্শনীয় একটি পার্ক আছে নদীর পাড় ঘেঁষে। সেখানে আর যাওয়া হয়নি। ফেরীঘাটের পাশে একটি মাঠের পাড়ে এসে লঞ্চ থামে। সেখান থেকেই উঠতে হয়। দশ মিনিটের মতো অপেক্ষা করতেই লঞ্চ চলে এলো।
ঢাকা-পিরোজপুরের লঞ্চগুলো হচ্ছে মাঝারি আকৃতি ও মানের লঞ্চ। তিনতলার উচ্চতা। উপরের দুটি তলায় কেবিন। নিচের তলায় ডেক। ঢাকা-বরিশাল পথে অবশ্য অনেক বড় ও সুন্দর লঞ্চ দেখা গেল। এখনো সে পথে যাওয়া হয়নি আমার। নদীপথে শুধু সেসব লঞ্চের চেহারাটা দেখেছি। লঞ্চের সফরে সময় বেশি কাটে কিন্তু সফরের কষ্টটা কম হয়। প্রকৃতি উপভোগের সুযোগটা বেশি থাকে। ঝড়বৃষ্টির মৌসুমে কিছু ভয়ভীতি থাকলেও শীতের শুরু-শেষে এই সফরের সুখ ও প্রশান্তিটা মনে লেগে থাকে।
রুচি ও প্রয়োজন বুঝতে পারার দক্ষতা মুফতি মাহমুদের অসাধারণ। অসাধারণ তার আন্তরিকতাও। আবারো একটি ফ্যামিলি কেবিনের ব্যবস্থা করে রাখল। লঞ্চে ওঠার আগে রান্না করা খাবারের একটি ব্যাগ জোর করে হাতে গছিয়ে দিলো। লঞ্চে উঠলাম। রুমে ঢুকলাম। লঞ্চ ঘুরতে শুরু করল। বারান্দায় বের হয়ে পাড়ের দিকে চোখ ফেরালাম। মাহমুদ হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। গত বছর তার সঙ্গে দাঁড়ানো ছিল আরেক তরুণ- মাওলানা মাসরুর। এখন সে মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ইসলাম টাইমসে মাঝে মাঝে লেখা পাঠায়।
লঞ্চ ধীরে ধীরে বাঁক বদল করল। মাহমুদের চেহারা আড়ালে পড়ে গেল। সামনে চলে এলো ডুবন্ত সূর্য। টকটকে লাল। আকাশের মেঘের গায়েও তখন রঙের প্রলেপ। পানিতে সেই প্রলেপের ছাপ। আবার একটি লঞ্চ সফর। পানির বুকে চলমান একটি রাত। আকাশে টুক করে ফুটে থাকা একটি চাঁদ। সঙ্গে স্ত্রী, পুত্র, সংসার। মুহূর্তগুলো নিয়েই জীবনের একটি জলসা। সব আল্লাহর দান।#
