মুকিম আহমাদ ।। মালয়েশিয়া থেকে
প্রবাসে হাসপাতালের অভিজ্ঞতা নেই। তবে সেদিন অভিজ্ঞতা হলো। জানালার কাঁচে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির খানিকটা কেটে যায় । সহকর্মীকে নিয়ে ছুটলাম। পথের ধারে কত ক্লিনিক, প্রায় প্রতিদিনই দেখা হয়। মালয়শিয়ার প্রায় প্রতিটি গ্রামে ক্লিনিক আছে। কিন্তু আজ সব বন্ধ। অগত্যা ছুটতে হলো অল্পদূরের আমপাঙ হাসপাতালে। মাহাদের গাড়িটা সঙ্গে, তাই পরিবহন সমস্যায় পড়তে হলো না।
কুয়ালালামপুর শহরের এক কোণায় বিস্তৃত পরিসর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হসপিটাল আমপাঙ। ঢাকা মেডিকেল থেকে ছোট হবে না। গাড়ি পার্কিংয়ের বিশাল ব্যবস্হা। হাসপাতালের চারপাশের রাস্তাগুলো বেশ চওড়া । বিরক্তিকর যানজট নেই । সাধারণ রোগীদের নিয়ে আসা গাড়িগুলোও দায়িত্ব নিয়ে পার্ক করছে । উন্নত দেশগুলোতে শৃঙ্খলাই মূলকথা। শৃঙ্খলাবিধিই হয়তো উন্নয়নের প্রধান ও প্রথম ধাপ। চালিকাশক্তি। মুমূর্ষু রোগী নিয়ে এ্যাম্বুলেন্সটি পার্কিং বিশৃঙ্খলায় আটকে নেই। ড্রাইভারটি ভিতরের জীবন্মৃত রোগীটির আর্তনাদে সাইরেন বাজানোর পরও লাঠি হাতে গাড়ির জায়গা করে দিতে হচ্ছে না।
সুবিশাল হাসপাতালটিতে রুগীর দ্রুত সেবাদানে শুধু কাউন্টারই আছে ২২টি । ১৭টি ওয়ার্ড ও ৫৬২টি শয্যাবিশিষ্ট । THIS (TOTAL HOSPITAL INFORMATION SYSTEM) সুবিধাযুক্ত প্রথম হাসপাতাল । হাসপাতালের পরিচ্ছন্ন ও সজ্জিত প্রবেশ পথ ধরে ঢুকে গেলাম বিশাল লবিতে । এটিএম বুথসহ আরো বেশ কিছু দোকান । তথ্যানুসন্ধান কেন্দ্র । রোগীদের ভীড় আছে, শোরগোল নেই।
আমরা প্রথমেই দাঁড়ালাম রেজিস্ট্রেশন কাউনাটারে । কর্তব্যরত ব্যক্তিটি আমার হাতে কাপড়ের ব্যান্ডেজ দেখে তড়িঘড়ি কাউন্টার বক্স ছেড়েনিয়ে গেলেন পাশের একটি কক্ষে । এখানে রোগীকে সিরিয়ালে দাঁড়ানোর মত উপযুক্ত করে তোলা হয়, আশঙ্কাজনক হলে জরুরি বিভাগে পাঠানো হয় । অবাক হলাম এই লোকটিও একজন ডাক্তার । হাতের কাপড় সরিয়ে প্রয়োজনীয় প্রলেপন দিয়ে রক্ত বন্ধ করে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলো ।
এরপর আমার তথ্য নথিভুক্ত করে ভেতরের সিরিয়ালে পাঠালো। স্ক্রিনে সিরিয়াল নম্বর ভাসছে। সাউন্ড সিস্টেম গোটা হাসপাতাল। সিরিয়ালের ২য় ধাপে একজন তরুণ ডাক্তার বিস্তারিত জেনে ইন্জেকশান দিয়ে আবারও নতুন সিরিয়ালে অপেক্ষা করতে বললেন । সিরিয়ালে অপেক্ষা করার অভ্যাস গড়ে ওঠেনি । আমি ছাড়া বাকিরা স্থির ও শান্ত ।
দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর ডাক্তারের সাক্ষাৎ পেলাম। বিদেশিদের জন্য ১০০ রিংগিত ভিজিট ফি। ঔষধপত্রসহ যাবতীয় খরচ এর মধ্যেই। ডাক্তারটি অত্যন্ত কোমল স্বরে জানলেন সব। এক্স-রে করতে পাঠালেন। পরিপাটি আরেকটি বিশাল দালান। নির্ধারিত ফি দিয়ে এক্স-রে রুমে গেলাম । অপারেটর অত্যন্ত সতর্কতায় ও সযত্নে হাত ধরছিল । একজন সিজারের রোগীর সঙ্গেও এমন সযত্ন আচরণ আজ পর্যন্ত দেখিনি । শুধু শিক্ষাই মানুষকে এত সেবাপরায়ণ করতে পারে না, ধর্মীয় মূল্যবোধ ব্যতীত।
এক্স-রে রিপোর্ট হাতে পাওয়ার আশায় দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু দেখি ডাক্তার রিপোর্ট হাতে ডাকছেন। পরে বুঝলাম হাসপাতালটি RIS (radiology information system) এবং PACS (picture archiving and communication system ) ব্যবহার করে রোগীর রিপোর্ট সংগ্রহের কষ্ট থেকে বাঁচায়। যা বহুল ব্যবহৃত। ক্ষতস্হান সেলাইয়ে এলো ভিন্ন ডাক্তার । শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শুধু ‘সরি’ (দুঃখিত) শব্দটি ছিল তার মুখে ।
বের হওয়ার পথে দেখা হলো স্ট্রেচারে করে আসা মৃতপ্রায় রোগী। রক্তাক্ত মাথা। পাশে তার স্বজন। সবাই ভীষণ শান্ত। কোন তাড়া নেই, কোন আহাজারি নেই। হাসপাতালের পরিবেশ ও শৃংখলা রক্ষার জন্যই যে তাদের নীরবতা তা বুঝতে আর বাকি থাকলো না।
লেখক : সহকারী প্রিন্সিপাল, মাহাদ আস-সফা লিত-তারবিয়্যাতিল ইসলামিয়্যাহ, সেলাঙ্গার, মালয়েশিয়া।
