মাওলানা ফয়যুল্লাহ ফাইয়ায ।।
শুক্রবার রাত থেকে আমরা শুনছিলাম সাদপন্থীরা মাঠ দখল করতে আসবে। সংবাদ শুনে মুরব্বিরা গেটের নিরাপত্তা কিছুটা বাড়িয়ে দেন। এর বাইরে আর তেমন কোনো উদ্যোগ নেননি তারা। ফজরের নামাজের আজানের সময় আমরা শুনলাম মিরপুর-৬ থেকে ৩টি বাস এবং মিরপুর-১২ থেকে ২টি বাস ভরে সাদপন্থীরা মাঠে আসছে।
ফজরের নামাজ পরেই আমরা গেটে উপস্থিত হলাম। প্রত্যেক গেটে হাজারের উপর সাথী ছিলেন। ফজরের কিছুক্ষণ পর সাদপন্থীরা আসতে শুরু করে। দিন বাড়ার সাথে সাথে তাদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এতে আমাদের উদ্বেগও বাড়তে থাকে।
মুরব্বিরা আমাদের আগ থেকে লাঠি বহন এবং তা প্রদর্শন করা থেকে নিষেধ করে দেন। আমরা অনুরোধ করেছিলাম আমরা লাঠিগুলো নিয়ে নিচে রেখে দেই। কিন্তু তারা সেই অনুমতিও দেননি। তারা বলেছেন, সেখানে চুপচুপ থাকতে এবং উত্তেজক কোনো কথাবার্তা না বলতে।
আমরা দায়িত্বশীল পুলিশ অফিসার– যিনি এই গেটের দায়িত্বে ছিলেন- তাকে আমাদের আশঙ্কার কথা জানালাম। তিনি বললেন, ভয়ের কিছু নেই। আমরা আছি। এরা কিছুক্ষণের মধ্যে চলে যাবে। মন্ত্রণালয়ে শীর্ষ মুরব্বিদের মধ্যে বৈঠক হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সমাধান পাওয়া যাবে।
অন্যদিকে সাদপন্থীরা লাঠি দেখিয়ে, বিভিন্ন কটূমন্তব্য করে আমাদের উত্তেজিত করার চেষ্টা করছিলো। তবুও আমরা ধৈর্যসহ অপেক্ষা করতে লাগলাম। ১০টা কি সাড়ে ১০টার দিকে সেই পুলিশ অফিসার (সম্ভত টঙ্গী থানার ওসি) আমাদের বললেন, আপনার পূর্বদিকে ফেরেন। মানে গেটের দিকে পেছন দিয়ে বসেন। অন্যদিকে তাদের বললেন, গেটের দিকে এগিয়ে আসতে। আমরা আপত্তি করলে বললেন, ‘আমরা তো আছি। চিন্তা করছেন কেনো?’
হঠাৎ দেখি সাদপন্থীরা গেটের উপর আক্রমণ করে বসলো। আর পাহারায় থাকা পুলিশ গেটের দুই পাশে সরে গেলো। গেট পাহারায় ৩০ থেকে ৩৫ জন পুলিশ ছিলো। সাদপন্থীদের সরাতে তারা একবার বাঁশিতেও ফুঁ দিলো না। তারা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই গেট ভেঙ্গে ফেললো। আমাদের সাথীরা ছিলো একবারে প্রস্তুতিহীন। মুরব্বিদের নিষেধ ও পুলিশের আশ্বাসের কারণে প্রতিরোধের প্রস্তুতি তাদের ছিলো না। তাই ওরা গেটে ঢোকার সাথে সাথে গেটের সাথীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
গেটের পাশে তাদের এক গাড়ি ইট আনা ছিলো। আমার ধারণা এটা ওদের পরিকল্পনার অংশ। তারা ইট ভেঙ্গে আমাদের গায়ে মারতে শুরু করলো। যার কারণে গেট থেকে আমাদের সরে আসতে হলো। কিন্তু আমাদের হাতের কাছে প্রতিরোধের মতো তেমন কিছু ছিলো না। অন্যদিকে তাদের সব ধরনের প্রস্তুতি ছিলো। তারা মাঠে ঢুকেই বেধড়ক পিঠানো শুরু করলো। ছাত্র-শিক্ষক-বয়স্ক-বৃদ্ধ কেউ তাদের হাত থেকে রক্ষা পেলো না।
তাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিলো মাদরাসার ছাত্র ও শিক্ষক। ছাত্র-শিক্ষকদের পেলেই তাদের দলবদ্ধভাবে আক্রমণ করছিলো আর অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করছিলো। কাউকে হাতের কাছে পেলেই প্রথমে তাদের মাথায় আঘাত করছিলো। কোনো রকম মাথা রক্ষা করতে পারলে পায়ে আঘাত করছিলো। যাতে পালিয়ে বাঁচতে না পারে। কেউ মাটিতে পড়ে গেলে তার আর রক্ষা নেই। যারা টয়লেটে বা অন্য কোথাও আশ্রয় নিয়েছিলো তাদের খুঁজে বের করে করে মেরেছে ওরা।
সবগুলো গেট দিয়ে একযোগে আক্রমণ করেছিলো তারা। সবদিক থেকে পেটাতে পেটাতে তারা সাধারণ সাথী, উলামা-তলাবাদের মাঠের মধ্যখানে জড়ো করে এবং দলে দলে ভাগ হয়ে একেকজনকে বেদম প্রহার করে। অনেক বৃদ্ধ তাদের পায়ে ধরেও নিজেদের রক্ষা করতে পারেন নি। আমাদের মাদরাসার একাধিক ছাত্র ও শিক্ষক আহত হন। আমাদের মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা আবদুল্লাহ মিয়াজির মাথায় আঘাত পেয়েছেন। তার মাথা ফেটে গেছে।
তাকে নিয়ে আমরা কোনো রকম নদীর পাড়ে আসলাম। আমরা নদীর পাড়ে এসে দেখি জীবন বাঁচাতে অনেকেই নদী সাঁতরে পার হচ্ছেন। তাদের দিকে অশ্লীল মন্তব্য আর ইট ছুঁড়ে মারছে তারা। আমাদের পেছনে ধাওয়া করে একদল সাদপন্থী হাজির হলো। আমাদের সাথে সাথে দু’জন ছাত্র ছিলো। তাদের বললাম, তোমরা নদী পার হয়ে জীবন বাঁচাও। তারা সাঁতার কেটে নদী পার হয়ে গেলো।
সাদপন্থীরা এসেই আমাদের মারতে উদ্ধত হলো। তখন আবদুল্লাহ মিয়াজিকে দেখিয়ে বললাম, ইনি একজন আলেম। আপনারা তো উনাকে মেরেছেনই। মাথা ফেটে গেছে আর মারলে মারা যাবেন। আমাদের কথায় একজন থেমে গেলেন। তিনি আমাদের আশ্বস্থ করতে চাইলেন। কিন্তু তার সাথের লোকগুলো আমাদের আহত-রক্তাক্ত দেখার পর থামতে চাইল না। বারবার মারতে আসতে লাগল।
নদী পার হয়ে যাওয়া আমাদের ছাত্ররা ওপাড়ে গিয়ে একজনকে অনেক অনুরোধ করে আমাদের জন্য তার নৌকা নিয়ে আসে। নৌকা দেখে আবার লোকগুলো মারমুখী হয়ে ওঠে। নৌকা আসার পর তারা মাওলানা আবদুল্লাহ মিয়াজিকে উঠতে দিলেও আমাকে উঠতে দেবে না। আমাকে রেখে দিতে চাইলো। আমি বললাম, লোকটির চিকিৎসা করা দরকার। আমাকে যেতে দিন।
আল্লাহর মেহেরবানি! শেষ পর্যন্ত আমিও নৌকায় উঠতে পারলাম। আমরা এপাড়ে এসে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। নদী পার হওয়ার পর এপাড়ের লোকেরা আমাদের জানালো, টঙ্গী মাঠের ভেতরের মাদরাসার (যা মূলত কাকরাইল মারকাযের মাদরাসা) শিশুবিভাগের ছাত্র-শিক্ষকদের করুণভাবে পেটানো হয়েছে। ছোট ছোট ছাত্রদের মাটিতে ফেলে কয়েকজন মিলে পা দিয়ে আঘাত করছিলো। নদীর পাড়ের মহিলাদের ভাষ্য হলো, আমরা শিশুদেরকে এমন নির্দয়ভাবে কখনও মারতে দেখিনি। আমরা চিৎকার করার পরও তারা শিশুদের মারছিলো।
আমরা নদী পার হয়ে মাওলানা আবদুল্লাহ মিয়াজিকে মুজতবা আলী হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি করাই। হাসপাতালে আমাদের যাওয়ার আগে ও পরে অনেক আহত মানুষ চিকিৎসা নিতে যায়। তাদের কাউকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ অন্যান্য হাসপাতালে পাঠানো হয়।
জরুরি চিকিৎসা নেয়ার পর আমরা যখন ফিরছি তখনও দূর থেকে দেখলাম তারা লাঠি হাতে বিভিন্নজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। দুয়েক জনকে বাড়িও মারছে। আমরা দেখলাম, পুলিশ সাদপন্থীদেরকে মাঠে একত্র করলো এবং কিছু কথা বললো। এর পর সাদপন্থীরা আবার মাঠে ছড়িয়ে পড়লো। তখনও মাঠের বাইরে অনেককে বিক্ষিপ্তভাবে ছোটাছুটি করতে দেখা যাচ্ছিলো। হয়তো তারা কাফেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বা তাদের কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ।
আসার পথে গাড়িতে আরেকটা প্রতারণার খবর শুনলাম। নারায়ণগঞ্জের একজন আলেম নদী পার হয়ে এ পাড়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তাকে সাদপন্থীরা বললো, হজরত আসুন! আপনার সামানপত্র নিয়ে যান। তিনি সরল মনে ওপাড়ে যাওয়ার সাথে সাথেই বেদম প্রহার করতে শুরু করে।
