কৃষিসেবা অনেক বড় এক সাধনা

মুনীরুল ইসলাম ।। 

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশে কৃষিকাজের অনেক গুরুত্ব রয়েছে। মূলত কৃষিপণ্য থেকেই সব রকমের খাদ্য তৈরি হয়। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতিটি মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, পথ্য, শিক্ষা সরঞ্জাম, পানি, বিদ্যুৎ, যানবাহন সবকিছুর মূল উৎপাদন কৃষি থেকেই আসে। একথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই এবং কেউ অস্বীকার করবেও না।

কৃষির সঙ্গে কৃষকের সম্পর্ক ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। সমাজে কৃষিকাজের যেমন গুরুত্ব রয়েছে, কৃষির কারিগর কৃষকেরও অনেক মর্যাদা রয়েছে। কৃষকরা ফজর নামাজ পড়ে বেরিয়ে যান কৃষিজমির উদ্দেশে। একমনে কাজ করে যান আগামীর ফসল ফলাতে। তাদের মনে নেই কোনো গর্ব-অহংকার, অলসতা-বিলাসিতা। অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপন করেন তারা। তারা যেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বাণীরই প্রতিফলন ঘটাচ্ছেন। মহানবী বলেছিলেন,‘ফজরের নামাজের পর তোমরা জীবিকা অর্জনের কাজে অমনোযোগী হয়ে আবার ঘুমিয়ে যেয়ো না।’

জোহরের আজান হলে একচিলতে কাপড় বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে যান নামাজি কৃষক। ক্ষেতের আইলই হয়ে যায় তাদের মসজিদ। কারণ দূরের জমিতে গেলে সাধারণত আশেপাশে কোনো মসজিদ থাকে না, এমনকি বাড়িঘরও থাকে না। আবার অনেক ক্ষেত্রে কৃষি উপকরণ ফেলে রেখে মসজিদে যাওয়াও সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই ক্ষেতের আইলেই পবিত্র কাপড় বিছিয়ে নামাজটুকু আদায় করে নেন। তবুও কাজের অজুহাতে তারা নামাজ ছুটে যেতে দেন না।

এরপর দস্তরখান পেতে সেখানেই কোনোরকমে সেরে নেন দুপুরের খাবার। তাদের সকালের নাশতাও হয় ক্ষেতের আইলেই। ছোট ছেলেমেয়েরা সেখানে পৌঁছে দেয় খাবার। কখনো সুবিধামতো তাদের কেউ একজন গিয়ে খেয়ে এসে অন্যদের জন্য নিয়ে আসেন। তবে প্রায় সময়ই তারা সময়মতো খাবার খেতে পারেন না। এভাবেই তারা রোদে পুড়ে, মেঘে ভিজে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে চেষ্টা-সাধনায় ফসল ফলান। তাদের পরিশ্রমের পর ফসল পরিপুষ্ট হলে সংগ্রহ করে ঘরে তোলেন। ফসল ভালো হলে আনন্দিত হন। খারাপ হলে তাদের মন কালো মেঘে ঢেকে যায়। তাদের মাথায় ওঠে কষ্টের হাত। তাদের মাথায় হাত মানে পুরো জাতিরই মাথায় হাত।

এই কৃষিকাজ নতুন কোনো বিষয় নয়। এটা মানুষের আদিপেশা। পৃথিবীতে আগমনকারী প্রায় সব নবী-রাসুলই কৃষিসংক্রান্ত কাজ করেছেন। আদিপিতা হজরত আদম (আ.) পৃথিবীতে এসে প্রথম কৃষিকাজ শুরু করেন। তিনি নিজের হাতে কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিজে কৃষির ফল-ফসল উৎপাদন করেছেন, নিজ হাতে খেজুর গাছ রোপণ করেছেন, সাহাবায়ে কেরামকে কৃষিকাজে উৎসাহিত করেছেন। অনেক সাহাবি ক্ষেত-খামারে কাজ করে, ফলের বাগান করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগে অধিকাংশ মুহাজির এবং আনসারই ছিলেন কৃষক।

আমাদের দেশের কৃষকদের অবদান যে কত বেশি, এটা আমরা একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারব। তাদের উৎপাদিত ফসলই আমরা আয়েশ করে ভক্ষণ করি। তারা ফসল উৎপাদন না করলে এলিটশ্রেণির লোকদের টাকা কিংবা মুদ্রা চিবিয়েই ক্ষুধা নিবারণ করতে হতো।

এত কষ্ট-সাধনার পরও তারা তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য পান না। তাদের শ্রমে-ঘামে উৎপাদিত পণ্যের মুনাফা ভোগ করে সুবিধাবাদিরা। আবার তারা সামাজিক মর্যাদাও পান না। কৃষক বলে তাদেরকে একরকম অবহেলা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়। এরকম মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে তাদেরকে আমাদের সামাজিক মর্যাদা দিতে হবে, তাদের মুখে ফোটাতে হবে ফসলের হাসি এবং দিতে হবে তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য।

দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য কৃষির সঙ্গে শিল্পের বন্ধুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধন তৈরি হওয়া প্রয়োজন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবি (রহ.)-এর মতে- ওই অর্থনীতি কখনো দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না, যেখানে কৃষিকে অবজ্ঞা করে শিল্পকে অস্ত্রের জোরে বা গায়ের জোরে টিকিয়ে রাখা হয়। এরূপ অর্থব্যবস্থার ধ্বংস অবশ্যাম্ভাবী। তাই কৃষির সঙ্গে শিল্পের সেতুবন্ধন তৈরির পাশাপাশি সব সাধকের বড় সাধক কৃষকদের যথাযথ সম্মান ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমাদের এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম

পূর্ববর্তি সংবাদবাবরি মসজিদের নিচে রামমন্দিরের কোনো অস্তিত্ব নেই
পরবর্তি সংবাদ৫৫ থেকে ৬০ আসন পাচ্ছে মহাজোটের শরিকরা