সুনসান পড়ে আছে ইজতেমার দুঃখী ময়দান

শাহ মুহাম্মদ খালিদ ।।

চলতি মাসের পহেলা ডিসেম্বর টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে সংঘটিত হয় তাবলীগের ইতিহাসের স্মরণকালের ভয়াবহতম রক্তপাত। দিল্লির নিজামুদ্দিন-এর মাওলানা সাদের অনুসারী কথিত এতাআতীদের হাতে চরম পর্যায়ের লাঞ্ছনা ও মারধরের শিকার হন সাধারণ তাবলীগের সাথী, ওলামায়ে কেরাম ও কওমি মাদ্রাসার ছাত্রবৃন্দ। সে জীবননাশা হামলায় এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সূত্রে কয়েকজন নিহত হওয়ার সংবাদ এসেছে। নাম-প্রমাণ পাওয়া গেছে একজনের। ঢাকা মেডিকেল, পঙ্গু হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালের বিছানায় পড়ে কাতরাচ্ছেন অসংখ্য আহত ব্যক্তি, যাদের অনেকের অবস্থাই আশঙ্কাজনক।

এতাআতীরা সেদিন ময়দান দখল করলেও পরবর্তীতে প্রশাসনের নির্দেশে তাদেরকেও সেখান থেকে বের করে ময়দান খালি করে দেওয়া হয়। এরপর থেকেই ময়দানে বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা। যেই ময়দান বছরের পর বছর ধরে কোন জামাত/নামাজ আমল বিহীন পার হয়নি, সেই ময়দান এখন কী অবস্থায় আছে তা জানার আগ্রহ অনেকেরই। সেই বিষয়টিই পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে এই প্রতিবেদক আজ (১০ ডিসেম্বর) গিয়েছিলেন ইজতেমা ময়দানে।

গেটে প্রশাসনের নির্দেশনা

বিভিন্ন ভিডিও চিত্রে যেই বাটা গেট ভেঙে এতাআতীদেরকে ঝাঁকে ঝাঁকে মারমুখি হয়ে প্রবেশ করে সাধারণ সাথীদের বেদম প্রহার করতে দেখা যায়, সেই গেটের সামনে এখন কাঁটাতারের বেড়া। গেটও তালাবদ্ধ। ভেতরে আর্মড পুলিশের সদস্যরা পাহারায় বসে আছে।

টঙ্গী স্টেশন রোড বরাবর গেটটা আগ থেকেই বন্ধ। ইজতেমা এবং জোড়ের সময় ছাড়া বাকি সময় সাধারণত টিনশেড মসজিদ সংলগ্ন গেটটাই ময়দানের আমলকারীদের আসাযাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হতো। আজ গিয়ে শুধু ওই গেটটাই খোলা দেখা যায়। গেটের ওপর ডিজিটাল ব্যানারে পুলিশের ঘোষণা ঝুলানো—

‘আসসালামু আলাইকুম, গত ১/১২/১৮ তারিখে তাবলীগের দুই পক্ষ কর্তৃক যে ঘটনা ঘটানো হয়েছে সে বিষয়ে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভাপতিত্বে সকল পক্ষকে নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিকাল ৪টায় একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় পাঁচটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যথা,
১/ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে তাবলীগের কোন পক্ষই টঙ্গী ইজতেমার মাঠে বা দেশের অন্য কোথাও ইজতেমার কোন রকম কার্যক্রম বা প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারবেন না।
২/ অন্তর্বর্তীকালীন এই সময়ে ইজতেমার মাঠ প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
৩/ পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাবলীগের দুই পক্ষ যেভাবে কাকরাইলের মসজিদটি ভাগাভাগি করে ব্যবহার করছেন সেই প্রক্রিয়াটি অব্যাহত থাকবে।
৪/ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তাবলীগের পক্ষদ্বয় নিজেরা বসে বিশ্ব ইজতেমার তারিখ পুনঃনির্ধারণ করবেন।
৫/ আজকে যে ঘটনাটি ঘটেছে তার একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হবে।’

নামাজ পড়ছে একলা পুলিশ …

ময়দানে প্রবেশাধিকার এখনও সংরক্ষিত। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল পুলিশের জলকামান ও রায়টকার। র‌্যাব, পুলিশ ও আর্মড পুলিশের সদস্যরা এদিক সেদিক পাহারায় বসে আছেন। তারা প্রথমে ভেতরে যেতে বাধা দিলেও পরবর্তীতে পত্রিকার কথা বলতে তাদের অফিসার প্রতিবেদককে চেয়ার এগিয়ে দিলেন। কথা হয় পুলিশের এসআই (সাব ইন্সপেক্টর) আরিফের সাথে, যাকে ডিএমপি হেডকোয়ার্টার থেকে এখানে ডিউটিতে পাঠানো হয়েছে। তিনি যেটা জানালেন, পয়লা ডিসেম্বরের রক্তপাতের পর ময়দানের এই মসজিদে নামাজ-কালাম-আযান বন্ধ ছিল। নামাজের জন্য কোন ইমাম ও মুয়াজ্জিনও ছিল না। পুলিশ র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আজান দিয়ে নিজেরাই জামাত করে নিতেন। এরপর গত শনিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলেমদেরকে নিয়ে এখানে আসার পর মসজিদটি জামাতের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে । ওয়াক্ত ভেদে ২০/২৫ জন স্থানীয় মুসল্লী এখন জামাতে শরীক হন। তবে এখনো নামাজের বাইরে তাবলীগের অন্য কোনো কাজকর্ম এখানে হয় না।

টিনশেড মসজিদে প্রবেশ করে দেখা গেল, চারোদিকে ধুলাবালির আবরণ জমে আছে। যোহরের জামাত শেষ হয়েছে প্রায় দেড় ঘণ্টা আগে। একজন পুলিশ সদস্য এক কোণে নামাজ পড়ছেন। একই সময়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অনেককে দেখা যায় জুতা পায়েই মসজিদে চলাফেরা করতে।
টিনশেড মসজিদের পশ্চিম পাশে মুরুব্বিদের কামরা। আর্মড পুলিশের সদস্যরা সেখানে সাবলীল জীবনযাপন করছেন। সারা ময়দানে কেবল একজন দাঁড়িটুপি বিশিষ্ট ব্যক্তি পাওয়া গেল, তিনি অবশ্য পরিচয় দিতে রাজি হলেন না। তার কাছে জানা যায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মসজিদের জামাত আর ময়দানে বিদেশি কামরার পাশে থাকা মাদরাসা চালু করার অনুমতি দিয়ে গেছেন। সেই প্রেক্ষিতে গতকাল তাবলীগের আলমি শুরার কিছু সাথী এসে মসজিদ ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে গেছেন। আগামীকাল থেকে মাদরাসায় ছাত্ররা আসতে শুরু করবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

প্রসঙ্গত, গত শনিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ওলামায়ে কেরাম ও কাকরাইলের আলমি শুরার দায়িত্বশীল সাথীদেরকে নিয়ে ইজতেমার ময়দান পরিদর্শন করেন। এমন বর্বরতা জীবনে কোনদিন দেখেননি বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এরপরই মূলত আজান ও জামাত চালুর পাশাপাশি ময়দানের মাদরাসার কার্যক্রম চালুর প্রক্রিয়া শুরু হয়।

আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এই প্রতিবেদককে ছবি তুলতে বাধা দেয়ার পাশাপাশি দ্রুত ময়দান ত্যাগ করতে তাগাদা দিচ্ছিলেন।

বের হওয়ার আগে পুরো ময়দানে একবার নজর বুলিয়ে দেখা গেল, চারদিক বিরান পড়ে আছে। মাসখানেক আগে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাথীরা এসে বিপুল উদ্দীপনার সাথে ইজতেমার কাজের অংশ হিসেবে যে অজস্র খুঁটি গেড়ে তাতে চটের পর্দা লাগিয়েছিলেন সেগুলো ভেঙেচুরে এদিক-সেদিক ছড়িয়ে পড়ে আছে।

ভাঙ্গাচোরা ছয় থেকে সাতটা প্রাইভেট কার এবং প্রায় এক থেকে দেড়শো মটর সাইকেল গেটের দু’পাশে পড়ে আছে। এগুলোও এতাআতীদের নির্মম আক্রোশের শিকার হয়েছিল সেই নারকীয় তাণ্ডবের দিন। পুলিশ সদস্যরা জানান, গাড়ি আরো ছিল, মালিকেরা এসে পরবর্তী সময়ে নিয়ে গেছেন।

এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নৃশংসতার চিহ্ন …

টিন শেড মসজিদ সংলগ্ন গেট থেকে বের হতে হাতের ডানে এক সাথীর টুপি, রুমাল ও তাবলীগি সিট-বেডিংয়ের দোকান। ভোলা থেকে আগত জয়নাল আবেদীন নামের এই ব্যক্তি জানান, স্থানীয় সরকার দলীয় লোকজনকে চাঁদা দিয়ে এখানে তিনি আট বছর ধরে দোকান করছেন। ঘটনার দিন এতাআতীদের নারকীয়তা স্বচক্ষে দেখে তিনি টঙ্গী থানায় গিয়ে আশ্রয় নেন। শুক্রবার থেকে তিনি এখানে প্রতি ওয়াক্ত নামাজ পড়ছেন। আগামী বৃহস্পতিবার এখানে শবগুজারির আমল শুরু হবে বলে তিনি আশা করছেন, যদিও দায়িত্বশীল কারো থেকে বিষয়টি যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

পহেলা ডিসেম্বর ভয়াবহ আক্রমণ এবং নিরীহ তাবলিগি ও মাদরাসা ছাত্রদের রক্তপাত ঘটানোর পর থেকে ময়দান জুড়ে যে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল এখন তা মোটামুটি স্তিমিত হয়ে এসেছে। আগামী দু’একদিনে মাদরাসা চালুর পাশাপাশি মসজিদেও কমবেশি আমল শুরু হলে পূর্বের নূরানী পরিবেশ কিছুটা হলেও ফিরে আসবে, এমনটাই আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

পূর্ববর্তি সংবাদনামাযের উমরী কাযা বলে কি কিছু নেই?
পরবর্তি সংবাদবন্ধ করা ৫৮টি ওয়েবসাইটই খুলে দেওয়ার নির্দেশ