দৌহিত্রের স্মৃতিতে মুফতি আমিনী রহ.

আশরাফ মাহদী ।। 

হাসপাতাল থেকে নানাকে বাসায় নিয়ে আসার পর পরিবারের সবাই যখন এক এক করে গ্যারেজে রাখা এম্বুলেন্সটায় উঠে শেষবারের মত কাছ থেকে দেখে বিদায় দিচ্ছিল আজ পাঁচ বছর পরও আমার কাছে সেই মুহুর্তটা একেবারেই আবছা মনে হয়না। সেদিন কাছ থেকে দেখে মনে হচ্ছিল গত রাতেও যেই মানুষটি মুসলিম উম্মাহর চিন্তায় নির্ঘুম কাটালেন আজ তিনি প্রশান্তির ঘুম ঘুমিয়ে আছেন। আল্লাহ তাকে এভাবে ঘুম পাড়ানোর আগে তার এই প্রিয় বান্দাকে দীর্ঘ একুশ মাস গৃহবন্দি অবস্থায় তাহাজ্জুদের অনবরত শিশুর মত কান্নার করতে দেখেছেন। অবশেষে তাকে নিজের কাছে নিয়ে গেছেন। কত সুন্দর একটা বিদায়!

আমার মনে আছে সে রাতে আমি খুব স্পষ্টভাবে নানাকে হাসতে দেখেছিলাম। মনে হচ্ছিল খুব ভাল কোন স্বপ্ন দেখছেন। কাছে গিয়ে একবার কপালে চুমু খেতে ইচ্ছা করেছিল। কিন্তু ছোয়া লাগলে যদি ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে, এই ভেবে আর সাহস করতে পারিনি। গাড়ি থেকে নামার সময় আমি যেভাবে কেঁদেছিলাম এর আগে সেভাবে কান্না আমি আর কারো জন্য করছি বলে মনে পড়েনা। নানাকে কি আমি এতটাই ভালোবাসতাম? কি জানি.. হয়তো এই কান্নাটাও স্বার্থের কারণে ছিল। নানা আমাকে খুব বেশি আদর করতেন। সেই আদর পাওয়ার স্বার্থ হারানোর দুঃখেই হয়তো এভাবে কান্না করেছিলাম।

নানার একটি বিষয়ে আমি অনেককেই অবাক হতে দেখেছি। রাজনৈতিক অস্থিরতা বা সরকারের চাপে যেসব ক্ষেত্রে সাধারণত মানুষের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়, সেখানে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হওয়ার দিনও নানা খুব স্বাভাবিক ও নিশ্চিন্তভাবে বুখারীর দরস শেষ করেছিলেন।
দরস শেষে সেদিন ছাত্রদের শুধু এইটুকু বলেছেন, “আমাকে যদি পুলিশ গ্রেফতার করতে আসে তোমরা কেউ কোন বিশৃঙ্খলা করবে না। এটা আমার নির্দেশ”।

এইটুকু শুনে ছাত্ররা হাউমাউ করে কেদে উঠেছিল। এইভেবে কেদেছিল যে আজ যদি আমাদের শায়খকে গ্রেফতার করে নিয়েও যায় আমাদের শুধু চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। আইনের প্রতি তিনি কতটুকু শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, শৃঙ্খলা রক্ষায় তার এই নির্দেশই তার নমুনা। সেদিন সারারাত ছাত্ররা শাহী মসজিদের চত্বরে অসহায় ছোট বাচ্চার মত কান্নাকাটি করেছে তাদের প্রাণপ্রিয় রাহবারের জন্য। সেরাতে কোন গেট লাগাতেও নিষেধ করে দিয়েছেন মুফতি আমিনী রহ.। যেকোন সময় পুলিশ গ্রেফতার করতে আসলে যাতে বাধার সম্মুখীন না হয়। কিন্তু পুলিশ কার ভয়ে যেন সেদিন মাদরাসার গেট পর্যন্ত এসে ফিরে গেল।

কার ভয়ে!!! মুফতি আমিনীর তো কোন ক্যাডারবাহিনী ছিল না! সরকার নিজেই তো তার বিরুদ্ধে চলে গেছে।
কারণ মুফতি আমিনীর দোষ একটাই। তিনি বলেছিলেন, “যে সংবিধান থেকে আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাসকে উঠিয়ে ফেলা হয় সেই সংবিধানকে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করতে হবে”।
সরকার তার এই কথাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল দাবী করে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। এরপরও পুলিশ কার ভয়ে সেদিন মুফতি আমিনীকে গ্রেফতার করতে পারেনি?

যে বছর মুফতি আমিনী রহ. নারী উন্নয়ন নীতিমালার
কুরআন সুন্নাহর সাথে সাংঘর্ষিক ধারাগুলো বাতিলের দাবীতে আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন সে বছর তার দরসের তাকরীর সম্পর্কে দাওরায় হাদিসের ছাত্রদের বলতে শুনেছি, ” হুজুরের বুখারীর তাকরীর শুনে তো আমরা রীতিমত সন্দিহান হয়ে পড়ি, এই মুফতি আমিনীই কি রাজপথে আন্দোলন করে সরকারের ঘুম হারাম করে রেখেছে? অথচ বুখারীর দরসে যখন তাকরীর করতে বসেন এবং বড় বড় শারেহদের ব্যাখ্যার খোলাসা বলে আবার নিজের সুচিন্তিত অভিমতও ব্যক্ত করেন তখন তো মনে হয় দীর্ঘ মুতালায়া শেষে দরসের তাশরীহ বেশ সময় নিয়ে গুছিয়ে এরপর দারুল হাদিসের মসনদে এসে বসেছেন হুজুর”।

ছাত্রদের এইসব কথা শুনে আমি বছর গুনতাম, শরহে বেকায়ায় তো চলেই এসেছি। আর দুইটা বছর, এরপরই নানার কাছে বুখারী পড়বো।

তাইসির থেকে শরহে জামি, এই ছয় বছর নানাকে কাছ থেকে দেখেছি। প্রতিদিন নিয়ম করে এশার আগে বা পরে নানার সাথে দেখা করতে যেতাম। স্বভাবতই তিনি মুতায়ালায় ব্যস্ত থাকতেন। আমি ঢুকলেই মৃদু হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, “কি নানা? কিছু বলবি?”
আমার জবাব না সূচক হলে ফ্রিজে মিষ্টি বা ফল নিয়ে খেতে বলে আমার মুতালায় ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। মাঝে মাঝে কোন কিতাব কতটুকু পড়ানো হল এই খোজ খবরও নিতেন। দরসে নেযামীর নেসাব কতটুকু কি পড়ানো হল এ ব্যাপারে তিনি নিজেই তদারকি করতেন। হুজুরদের ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করতেন নেসাব শেষ হয়েছে কিনা।

কিতাব পেলে যেন উনার দুনিয়াতে প্রশান্তির ছায়া নেমে আসতো। কারণ তিনি তখন জাগতিক সব ঝুটঝামেলা আর দুশ্চিন্তা ভুলে অন্য জগতে ঢুকে পড়তেন। এটা তার নিজস্ব জগত, যেখানে শুধু তিনি আর তার কিতাব ছাড়া আর কোনকিছুর অস্তিত্ব নেই।
মুফতি আমিনীর মুতালার অদম্য স্পৃহা এবং ও ইলমি গভিরতার কথা তুলে তুলে এমন উলামায় কেরামকেও উদাহরণ পেশ করতে দেখা গেছে যারা তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার সাথে একমত পোষণ করতেন না।

ইলমী গভীরতার সাথে সাথে যেই বিষয়টি তাকে অনন্য করে তুলেছিল তা ছিল দ্বীনের দরদ। মুফতি আমিনী রহ. ছাত্রদের উদ্দেশ্যে প্রায়ই বলতেন। বড় আলেম তো অনেকই আছে, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা সেইসব মানুষের মাধ্যমের তাঁর দ্বীনের বড় বড় খেদমত নিয়েছেন যাদের মধ্যে দ্বীনের দরদ ছিল। আর দ্বীনের দরদ ছাড়া আলেমদের দ্বারা অনেক সময় দ্বীনের ক্ষতিও হয়েছে। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বাদশাহ আকবরের দরবারের আলেমদের কথা বলতেন, যাদের ইলমী যোগ্যতার ধারেকাছে এ যুগের কোন আলেম যেতে পারবে কিনা সন্দেহ। কিন্তু এই মানুষগুলোই বাদসশাহ আকবরকে খুশি করতে দ্বীনে ইলাহী তৈরী করে ইসলাম ও মুসলমানের কত বড় ক্ষতিটাই না করেছে। এ নিয়ে শেষ জীবনে “অসৎ আলেন ও পীর” নামে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কিতাবও লিখে গেছেন।
ছাত্রদেরকে তিনি সেটা মুতালা’ করে নিতে বলতেন।

মুফতি আমিনী রহ. এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা বাংলাদেশে দ্বীনের কতটুকু খেদমত নিয়েছেন তাঁর ব্যাখ্যা নতুন করে দেওয়ার বিশেষ প্রয়োজন হয়তো নেই। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে মুসলমানরা রাজনৈতিকভাবে কোন পরিচয় নিয়ে এগিয়ে যাবে সেই লক্ষ্য স্থির করতে হলে মুফতি আমিনী রহ এর রাজনৈতিক চিন্তা ও কর্মপন্থা নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা করে সেই অনুপাতে রূপরেখা তৈরী করা এখন সময়ের দাবী। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সকলকে, বিশেষত যারা ইসলামী রাজনীতি নিয়ে স্বপ্ন দেখেন তাদেরকে মুফতি আমিনীর রাজনৈতিক আদর্শ পাঠ করার ও বুঝার তৌফিক দান করুক।

পূর্ববর্তি সংবাদসিরিয়ায় বিরোধীমতের লোকদের সম্পত্তি দখল করে নিচ্ছে বাশার
পরবর্তি সংবাদ‘নিরাপত্তা দিতে’ বিএনপির প্রার্থী আশফাককে থানায় নিয়ে গেছে