তবে কি তিনিই সঠিক?

আবদুল করীম শাহেদ ।।

তিনি আলোচক ও আলোচিত, সমালোচক ও সমালোচিত এক ব্যক্তিত্ব। তার ব্যক্তিত্বের নানা রঙ নিয়ে এখানে আলোচনার প্রয়োজন নেই। শুধু একটি বিষয় নিয়েই আজকের কথা থাকুক।

নিজের বক্তব্যে তিনি নিজে বলছেন, তার অনুসারীরাও তাদের লেখাজোখায় চারমুখে বলতে শুরু করেছেন যে, তিনি যে বিষয়টি আগে বুঝেন জমহুর আলেমদের সে বিষয়টা বুঝতে বুঝতে অনেক বছর লেগে যায়। বাংলাদেশে সচেতন আলেম, সবচেয়ে বুদ্ধিমান দূরদর্শী আলেম যদি কেউ থেকে থাকেন তাহলে তিনিই। অন্যদের যা বুঝতে অনেক দেরি হয় এবং পরে তারা অবস্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হয় তিনি সেটা আগেই বুঝেন। এজন্য তার অবস্থানটা বরাবরই সঠিক হয় এবং ভিন্ন হয়। তাই তার প্রতি সবার শ্রদ্ধা থাকা উচিত। জমহুর আলেমদের অনুসারীরা একথাটা মানতে চান না বা বুঝতে চান না।

প্রশ্ন হচ্ছে, তার কিংবা তার অনুসারীদের এ জাতীয় দাবি কতটা সঠিক?

আসলে কে সঠিক বা কোন দাবিটা সঠিক- এ বিষয়টা বোঝার জন্য তো বিশেষ বুদ্ধির দরকার হয় না। পেছনের কিছু নজির সামনে আনলেই চলে ।

ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ওলামায়ে কেরাম যখন সংগ্রাম করেছেন তখন গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর ফতোয়া ছিল, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা হারাম। পরের ঘটনা হলো, পদে পদে ব্রিটিশরা জয়ী হয়েছে। আলেমদের সংগ্রাম আসলে তাৎক্ষণিকভাবে সফল হয়নি। রক্ত ঝরেছে, আলেমরা বিপন্ন হয়েছেন। তাহলে কি বলতে হবে, গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর বুদ্ধি, সিদ্ধান্ত ও ফায়সালাই সঠিক ছিল?

আরেকটা উদাহরণ । ১৮৫৭ সালে যখন গোটা ভারত জুড়ে সিপাহী বিপ্লব চলছে, তখন দারুল উলুম দেওবন্দের যারা প্রথম সারির আকাবির- হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কী, কাসিম নানুতবী, রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রহ.- তারা তখন বৃটিশদের বিরুদ্ধে শামেলীর ময়দানে জিহাদ করেন এবং ব্রিটিশদের থেকে কয়েকটা থানা দখল করে নেন। সে অঞ্চলে ইসলামী হুকুমতও কায়েম করেন। পরবর্তী সময়ে কিন্তু তারা আবার পরাজিত হন। অসফল হন। ব্রিটিশরা তাদের থেকে থানাগুলো দখল করে নেয়।

সিপাহী বিপ্লব যেভাবে দমন করা হয়, ঠিক সেভাবেই শামেলীর ময়দানের যারা মুজাহিদ ছিলেন তাদেরকেও দমন করা হয়। তারা পরাজিত হন। হাফেয যামেন রহ. সেখানে শাহাদাত বরণ করেন। থানাভবনের মাকবারায় তার কবর আছে। হাজি ইমদাদুল্লাহ রহ. ছিলেন শামেলির স্বল্পকালীন ইসলামি সরকারের আমীরুল মুমিনীন। অসফল হয়ে তিনি ভারত বর্ষ ছেড়ে মক্কায় হিজরত করেন। কাসিম নানুতবী রহ., রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রহ. পলাতক জীবন যাপন করেন। এরই নয় বছর পর তারা দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতে তখনও ব্রিটিশই ছিল ক্ষমতাসীন। তারা আক্রমণাত্মক শক্তি হিসেবেই ছিল।
তো আমাদের আকাবিরদের এত বড় বড় ব্যক্তিত্ব যখন এ সকল বিপ্লব করেছেন, ঠিক ওই সময়েই স্যার সৈয়দ আহমদের অবস্থান ছিল উল্টো। তিনি ব্রিটিশদের অনুকূলে ছিলেন। তিনি ছিলেন আলীগড় বিশ্বদ্যিালয়ের প্রতিষ্ঠাতা।তিনি মনে করতেন, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করা অনুচিত। ব্রিটিশকে বরং সহযোগিতাই করা উচিত।

দেখা গেল, যারা দারুল উলুমের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তারা লড়াই করেছেন, পরে পরাজিত হয়েছেন এবং তার পরে কিছুটা আত্মগোপন করে, পালিয়ে বেড়িয়ে ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। এবং এভাবেই তারা তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছেন। তাহলে কি এখন বলতে হবে, স্যার সৈয়দ আহমদের অবস্থানটাই সঠিক ছিল? বলতে হবে, দারুল উলুম দেওবন্দের যারা প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তাদের আসলে স্যার সৈয়দের মতো বুঝবুদ্ধি ও কাণ্ডজ্ঞান ছিল না? তাদের চিন্তা এবং হিসাবটা ভুল ছিল?

মনে করতে হবে যে, তাদের সবার চেয়ে স্যার সৈয়দ আহমদ বেশি বুঝেছিলেন?

কাছের অতীতে হজরত হোসাইন আহমদ মাদানী রহ. অখণ্ড ভারত রক্ষার জন্য আন্দোলন করেছেন। আঘাত ও নিন্দা সয়েছেন। ভারত অখণ্ড থাকেনি, ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছে। এতে কি হজরত মাদানীর সংগ্রাম ও ত্যাগের সবকিছুই ব্যর্থ হয়ে গেছে? ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিস্ঠার স্বপ্ন নিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে অসাধারণ ত্যাগ ও শ্রম দিয়েছেন হজরত শাব্বীর আহমদ উসমানী রহ. ও হজরত যফর আহমদ উসমানি রহ.। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হলেও তাদের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। এতে কি তাঁদের সব সংগ্রাম ব্যর্থতায় ডুবে গেছে? হজরত আতহার আলী রহ. ইসলামি আন্দোলন করে সাড়া ফেলেছেন, হজরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. ‘তওবার রাজনীতি’ করে ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করতে চেয়েছেন। তাঁরা কেউ বাহ্যিকভাবে মঞ্জিলে পৌঁছতে পারেননি।তবে কি বলতে হবে, তাঁদের সবার সংগ্রাম, চেষ্টা ও সিদ্ধান্ত-গ্রহণ ক্ষমতা দুর্বল ছিল?

বাহ্যিক সাফল্য দেখে যিনি আর যার অনুসারীরা দেশের প্রায় সব আলেমকে দুর্বলবুদ্ধির মানুষ হিসেবে সাব্যস্ত করছেন-তারা আসলে ইতিহাস ও বর্তমানের প্রভাব ও ফলাফল নিয়ে ভাবার কষ্টটাই করতে চান না। করলে যে নিজেদের বুদ্ধির বেলুনটা ফুটা হয়ে যায়!

আপনি সাহাবীদের যুগ থেকে নিয়ে হেফাযতের শাপলা পর্যন্ত মুসলমানদের মার খাওয়ার অনেক ইতিহাস দেখতে পাবেন, যেখানে মনে হবে প্রতিবাদী আলেমদের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল, আর বিপরীত দিকে যারা তাগুতের পক্ষ হয়ে, স্বৈরাচারী শক্তির পক্ষ হয়ে, জালেম শক্তির পক্ষ হয়ে মুসলমানদের লড়াই-সংগ্রামের বিরুদ্ধে কথা বলেছে, মনে হবে-তাদের অবস্থানটা সঠিক ছিল। কারণ জয় তো তাদের হয়েছে। দুনিয়াবী দৃষ্টিকোণ থেকে বিজয় তাদেরই অর্জিত হয়েছে। তারপরও কি আপনি বলবেন, তাগুতের পক্ষে যারা ছিল, স্বৈরাচারী শক্তির পক্ষে যারা ছিল, জালেমের পক্ষে যারা ছিল, তাদের অবস্থানটাই সঠিক? ইতিহাস কি এভাবেই চিহ্নিত হয়? হবে? মানুষের সুস্থ জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার মাপকাঠি কি দুনিয়ার এই সাফল্য আর ব্যর্থতা দিয়ে এভাবেই মীমাংসিত হয়?

তিনি সারা বাংলাদেশের প্রায় সব ও শ্রেষ্ঠ আলেমদেরকে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী এবং জ্ঞানের ক্ষেত্রে পশ্চাদপদ চিহ্নিত করার জন্যে এবং নিজের সিদ্ধান্তটাকে সফল ও সঠিক প্রমাণ করার জন্যে এই যে একটা সহজ হিসাব পেশ করে দিলেন, এতে কি ইতিহাসে যতগুলো ন্যায্য ব্যর্থ সংগ্রাম আছে, যতগুলো অসফল সংগ্রাম হয়েছে, মার খাওয়ার সংগ্রাম রয়েছে, এদের সবাইকে খাটো করা হলো না? সত্যপন্থি অসফল সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে যারা বক্তব্য রেখেছে, তাদের অবস্থানকে যারা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, তাদের পক্ষেই অবস্থান নেওয়া হলো না?

আমি জানি না তারা একটু পেছন ফিরে চিন্তাটা করেছেন কি না। সামান্যতম চিন্তা করলেও তো সমাধান পেয়ে যাওয়ার কথা। না কি ইসলামের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে যারা মজলুম হয়, সেই মজলুমরা যেন আগে-পরে কোনোভাবেই নড়াচড়া করতে না পারে-এরকম একটা চিন্তা লালন করেন বলেই তিনি এবং তার অনুসারী মুষ্টিমেয় লোক এ ধরণের কথা বলছেন? এপ্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই।

তাঁর কান্ডজ্ঞান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে প্রশংসা করা হচ্ছে, ইসলামের চৌদ্দশ বছরে যতগুলো মার খাওয়ার ইতিহাস আছে, পরাজয়ের ইতিহাস আছে – ইমাম হুসাইন রাদি.-এর কথাই বলুন, বলুন আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাদি.-এর কথা, সবগুলোই তো তার দৃষ্টিতে তাহলে ভুল হিসেবেই সাব্যস্ত হতে বাধ্য। অথচ ইতিহাসে তো সেইসব বীরেরাই বরেণ্য। ইতিহাসে তো তাঁরাই প্রশংসিত। তিনি কিংবা তার মতো চিন্তার লোকেরা নন।

আমার মনে হয়, এখান থেকে সব শ্রেণীর পাঠক ও চিন্তাশীল দেশবাসী সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন- কাণ্ডজ্ঞানটা কার সঠিক, কার ভুল? সিদ্ধান্তটা কার সঠিক আর কে মরীচীকার পেছনে ছুটছেন তার আঙুলে গোনা অনুসারীদের সঙ্গে নিয়ে?

পূর্ববর্তি সংবাদনির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করতে ব্যর্থ হচ্ছে: ফখরুল
পরবর্তি সংবাদনির্বাচনী সহিংসতা : ভোটারদের ওপর কেমন প্রভাব ফেলছে